ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

ওপেন কাপল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের এক সাহসী মঞ্চায়ন

প্রকাশিত: ১৩:০০, ৩১ জানুয়ারি ২০১৯

ওপেন কাপল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের এক সাহসী মঞ্চায়ন

২৬ জানুয়ারি শনিবার শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নাটক ওপেন কাপলের সফল মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হলো। নাটকটি গত বছর ১৫ এপ্রিল নাগরিকের ৪৫তম প্রযোজনা হিসেবে ঢাকার মঞ্চে প্রথমবার আসে। এ যাবত দেশে বেশ কয়েকটি এবং বিদেশের মাটিতে লন্ডনেও দুটি সফল মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরই মধ্যে নাটকটি দর্শক মহলে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে। নোবেল বিজয়ী ইতালীয় নাট্যকার দারিও ফো এবং তার স্ত্রী ফ্রাঙ্কা রামে নাটকটির মূল রচয়িতা। এটিকে বাংলাদেশের উপযোগী করে রূপান্তর এবং নির্দেশনা দিয়েছেন গুণী নির্দেশক ও অভিনেত্রী সারা যাকের। অবাক এবং বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশের মতো রক্ষণশীল সমাজে এ রকম একটি সাহসী মঞ্চায়ন কীভাবে সম্ভব হলো? নাগরিক এবং নির্দেশক সারা যাকের সেটি সম্ভব করে দেখিয়েছেন। যে কথা এর আগে ঢাকার মঞ্চে কেউ বলেনি সারা সেটি বলার চেষ্টা করেছেন। আমি বলব তাঁর এ প্রয়াস শতভাগ সার্থক হয়েছে। নাটকের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে নারী-পুরুষের নিষিদ্ধ সম্পর্ক যে, দাম্পত্য জীবনকে কতটা জটিল করে দিতে পারে সেটিকে উপজিব্য করে। নাটকটি শুরু“হয় স্ত্রী আয়শার হতাশাপূর্ণ দাম্পত্য জীবনকে কেন্দ্র করে। বিবাহের মতো একটি নিষ্পাপ সামাজিক বন্ধন যেন তার স্বামীকে কোনভাবেই দমিয়ে রাখতে পারে না। স্ত্রীর প্রতি অবহেলা আর উদাসীনতায় যেন স্বামীর অন্যতম আরাধনা। স্ত্রী যেন এক পচাবাসি উচ্ছিষ্ট খাবার। দিনের পরদিন চলে যায় স্বামী-স্ত্রীর জৈবিক সম্পর্ক অনুপস্থিত থেকে যায়। স্ত্রী ভাবেন স্বামী তাঁর কর্মব্যস্ততা এবং বয়সজনিত কারণে আগের মতো সম্পর্কে আগ্রহ দেখান না।কিন্তু একটি পর্যায়ে স্ত্রী জানতে পারেন যে ঘটনা অন্য। স্বামীর বহুগামীতার সমস্যা আছে। একাধিক পর নারীর প্রতি আসক্তি এবং নিয়মিত অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত। এজন্য তার নিজ স্ত্রীর সঙ্গে জৈবিক সম্পর্ক প্রয়োজন হয় না। মধ্য বয়স্ক স্বামীর পর নারীর প্রতি আসক্তি এবং বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে স্ত্রী আয়েশা অনেকবার সুইসাইড করতে যান। কখনও বহুতল ভবন এপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করে আবার কখনও বা পিস্তলের গুলিতে নিজেকে শেষ করে দেয়ার মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হন। এভাবেই নাটকের কাহিনী এগিয়ে যায়। বহুগামী স্বামী নিজেকে যেমনভাবে তৈরি করেছিলেন, তেমনি স্ত্রীকেও অনেকটা বাধ্য করতেন বিভিন্ন সঙ্গীর সান্নিধ্যে যাওয়ার। তবে এ ধরনের সম্পর্কে অস্বস্তির পাশাপাশি ভীষণ বিব্রত হতেন স্ত্রী। তবে স্বামী অবলীলায় অন্য নারীর সঙ্গ উপভোগ করতেন। একপর্যায়ে স্বামী উপলব্ধি করে যে তার স্ত্রী বহু পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে চাইছে না। তবে বিশেষ একজনের প্রতি তার আসক্তি তৈরি হয়েছে। এ ঘটনায় চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন স্বামী। এই আসক্তি স্বামী কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। স্ত্রীকে ওপথ থেকে ফেরাতে সুইসাইড নাটকসহ নানা চেষ্টা করে যান। অবশেষে নানা নাটকীয়তায় দুজন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে বিবাহ বহির্ভূত নয়; বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ দাম্পত্য সম্পর্কই সত্যিকারের আদর্শ। নাটকে স্বামী এবং স্ত্রী দুটি মাত্র চরিত্র। স্ত্রী চরিত্রে নির্দেশক সারা যাকের নিজে এবং স্বামী চরিত্রে অভিনয় করেছেন জিয়াউল হাসান কিসলু। দুজনেই ঢাকার মঞ্চের জ্যেষ্ঠ অভিনেতা-অভিনেত্রী। নাটকে তাদের সুঅভিনয় জ্যেষ্ঠতার পরিচয় বহন করতে সক্ষম হয়েছে। সংলাপ রচনাতে সারা মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। অত্যন্ত সহজ, সাবলীল এবং কৌতুকপূর্ণ সংলাপ দর্শকের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে দারুণ সহায়ক হয়েছে। নির্দেশক সারা যাকেরের ভাষায় বলতে হয়, ‘ভীষণ কৌতুকের মধ্য দিয়ে দারুণ সাহসী উচ্চারণ।’ নাটকের যে কাহিনী তাতে ভারিক্কি সেট ও প্রপস করার সুযোগ নেই বলে সেটি করাও হয়নি। আলোর ব্যবহারেও আহামরি কিছু দেখানোর সুযোগ নেই। সব মিলিয়ে একটি সাধারণ প্রযোজনা অসাধারণ বার্তা বহন করতে সক্ষম হয়েছে বলে আমার মনে হয়। পৃথিবীতে এমন অনেক কাহিনী আছে যেগুলো কোন একটি নির্দিষ্ট দেশ বা কালের নয় বরং উর্ধে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় এদেশের মঞ্চ দর্শককে মৌলিক নাটকের পাশাপাশি এমনই অনেকগুলো দেশ-কালের উর্ধে থাকা বিদেশী নাটকের বাংলাদেশী রূপায়ণ করে সফল মঞ্চায়নের মাধ্যমে স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ করে দিয়েছে। ওপেন কাপল সে রকমই একটি নাটক। এটি একটি ভিনদেশী নাটকের কাহিনী হলেও আমাদের সমাজব্যবস্থাতেও বিষয়টি জোরালোভাবে বিদ্যমান। আশপাশে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলেই আমরা শুনতে পাই এ ধরনের নিষিদ্ধ সম্পর্কের কথা। কিন্তু সব সময়ই যেন এটি একটি অনুচ্চারিত প্রসঙ্গ হিসেবেই থেকে গেছে। একটি চারাগাছ রোপণ করে পরিচর্যার অভাবে যেমন সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না ঠিক তেমনই দাম্পত্য সম্পর্কও পরিচর্যার অভাবে ভালভাবে চলতে পারে না। নাটকে এই সত্যটিই উঠে এসেছে। পরিচর্যাহীন এবং এই নিষিদ্ধ সম্পর্ক বহু দাম্পত্য জীবন ভেঙ্গে যাবার প্রধান কারণ। নির্দেশক সারা যাকের একটি নিষিদ্ধ এবং অনুচ্চারিত সম্পর্ককে মঞ্চে উপস্থাপন করে এক দারুণ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। যেন তিনি মঞ্চের মাধ্যমে এক সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সারা যাকেরের এই সাহসকে এবং সেই সঙ্গে ঢাকার মঞ্চে এ রকম একটি সাহসী প্রযোজনা উপহার দেয়ার জন্য নাট্যদল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়কেও সাধুবাদ জানাই।
×