ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে ঐক্যফ্রন্ট শরিক গণফোরামের

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ৩১ জানুয়ারি ২০১৯

বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে ঐক্যফ্রন্ট শরিক গণফোরামের

রাজন ভট্টাচার্য ॥ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব থেকে ড. কামাল হোসেনকে সরিয়ে দেয়া উচিত- বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদের এমন মন্তব্যের পর বিএনপির সঙ্গে গণফোরামের দূরত্ব আরও একধাপ বাড়ল। এমনিতেই গণফোরামের নির্বাচিত দুই সাংসদের শপথের সিদ্ধান্ত নিয়ে উভয় দলের মধ্যে টানাপোড়েন যাচ্ছে। এরমধ্যে নতুন সঙ্কট হয়ে সামনে এসেছে হাফিজের মন্তব্য। যদিও গণফোরামের একাংশ দুই সাংসদের শপথের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অবশ্য নির্বাচিত দুজনেই শপথের বিষয়ে একমত। কামাল হোসেনকে নিয়ে বিএনপির অন্যতম এই শীর্ষ নেতার এই মন্তব্যের পর উভয় দলে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বিএনপি ও গণফোরামের একাংশ মনে করে পরিকল্পিতভাবেই এই মন্তব্য করা হয়েছে। তাই এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার পরামর্শ অনেকের। আবার একটি পক্ষ হাফিজ উদ্দিনের মন্তব্যকে পাত্তা না দিয়ে বিষয়টিকে একেবারেই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে কারও কারও বক্তব্য হাফিজ উদ্দিনের মন্তব্যের কারণে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে ভাঙ্গন দেখা দিতে পারে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ইস্যুতে দূরত্ব বেড়েছে উভয় দলের মধ্যে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব থেকে ড. কামাল হোসেনকে সরিয়ে, বিএনপির কাউকে দায়িত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। একটি বেসরকারী টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি এ মন্তব্য করার পর রাজনীতির মাঠে এখন নানান আলোচনা-সমালোচনা চলছে। তিনি বলেন, বিএনপির উচিত পরীক্ষিত বন্ধুদের জোট বিশ দলকে, আরও গুরুত্ব দেয়া। তবে, ঐক্যফ্রন্ট তথা গণফোরামের কার্যকরী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেছেন, কারও ব্যক্তিগত মন্তব্যে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। তাছাড়া এ বিষয়টিতে তিনি খুব একটা আমলে নিতে চান না বলেও জানান। এদিকে বুধবার গণফোরামের ৫ম কাউন্সিলের প্রস্তুতি সভায় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব পরিবর্তন নিয়ে হাফিজ উদ্দিনের বক্তব্যের বিষয়টি আলোচনায় ওঠে আসে। তখন তৃণমূলের নেতারা এই মন্তব্য প্রত্যাহার করার দাবি জানান। অন্যথায় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বিএনপিকে বাদ দেয়ার দাবি জানান তারা। সভা সূত্রে জানা গেছে, কেন হাফিজ উদ্দিন এমন মন্তব্য করলেন আনুষ্ঠানিক চিঠির মাধ্যমে তার জবাব চাওয়ারও দাবি ওঠে। যদিও দলের শীর্ষ নেতারা বিষয়টি দেখবেন বলে সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন। একটি বেসরকারী টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাতকারে হাফিজ উদ্দিন আরও বলেন, ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা একেবারেই ভুল ছিল। এতে জনসমর্থহীন ছোট ছোট দলগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বর্তমান বিএনপির নেতৃত্বের দূর্বলতা বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই মন্ত্রী। কামাল হোসেন প্রশ্নে হাফিজ বলেন, উনার বয়স হয়েছে। ফিটনেস নেই। তাই নেতৃত্ব পরিবর্তন করতে হবে। তাছাড়া গণফোরাম থেকে নির্বাচিত দুই সাংসদের শপথ নেয়ার বিষয়ে তিনি শুরু থেকেই ইতিবাচক ছিলেন। এটি দল ও জোটগত সংহতির বিরুদ্ধ আচরণ বলেও মনে করেন তিনি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে বিএনপির কাউকে রাখার প্রস্তাব জানিয়ে তিনি বলেন, ঐক্যফ্রন্টে নেতৃত্বে বিএনপির নেতা হতে হবে। অথবা এই জোটের কোন প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির যাওয়া উচিত হয়নি। জবাবে সুব্রত চৌধুরী বলেন, ঐক্যফ্রন্ট গঠন সঠিক হয়েছে কি হয়নি এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হতে পারে। তবে সামগ্রিক বাস্তবতা হলো এই জোট রাখতে হবে। মানুষের কাছে এই জোটের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সবাই মিলে জোটের পরিধি বাড়াতে হবে। এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এই জোটকে। চলার পথে নানা ধরনের সমালোচনা জোটকে আরও এগিয়ে নেবে বলেও মনে করেন তিনি। গত বছরের ১৩ অক্টোবর বিএনপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ কামাল হোসেন। নানা নাটকীয়তার পর নির্বাচনে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এই জোট। এর বড় কারণ হলোÑ ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। পর পর দু’বার নিবন্ধিত কোন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নিলে আইন অনুযায়ী নিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়। তাই নানা কৌশল অবলম্বন করে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা আসে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে। জোট গঠনের আগে ২০ দলীয় জোটে জামায়াত থাকায় বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করবেন না এমন কথা বহুবার বলেছেন, বঙ্গবন্ধু সরকারের সাবেক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপির এক সময়ের সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক মিত্র বি. চৌধুরীকে বাদ দিয়ে তিনি সেই দলের ঘরে পাত পাতেন। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয় কামাল হোসেনকে। সর্বশেষ বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হয় ফ্রন্টের পক্ষ থেকে। একই প্রতীকে জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের শরিক ও গণফোরাম তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা নির্বাচনে অংশ নেন। ২৫ আসনে জামায়াতের প্রার্থীরা নির্বাচন করে। এ নিয়েও সারাদেশে তুমুল বিতর্কের ঝড় ওঠে। কিন্তু নির্বাচনে মাত্র আট আসন পায় ঐক্যফ্রন্ট। এরমধ্যে ৬টি বিএনপির। বাকি দুটি গণফোরাম থেকে। জামায়াতের সঙ্গে ঐক্যের ইস্যুতে কামাল হোসেন যখন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর এ নিয়ে নতুন ভাবনা তৈরি হয় গণফোরামে। দলের পক্ষ থেকে একাধিক সংবাদ সম্মেলন করে কামাল হোসেন বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে তাদের কোন ঐক্য নেই। জামায়াতের রাজনৈতিক দর্শনও বিশ্বাস করে না গণফোরাম। বিএনপির সঙ্গে তাদের ঐক্য আছে, থাকবে বলেও জানান তিনি। সব মিলিয়ে জামায়াত নিয়ে বিএনপির সঙ্গে গণফোরামের ঠা-া লড়াই নির্বাচনের আগে থেকেই আঁচ করা যাচ্ছিল। গণফোরামের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বিএনপির সঙ্গে ঐক্যের প্রশ্নে জামায়াত ইস্যুতে দলটির তৃণমূল নেতাদের আপত্তি রয়েছে শুরু থেকেই। তারা বলছেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল জামায়াতের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির কোন আপোস হতে পারে না। যদি বিএনপি জামায়াতকে ছেড়ে আসে তাহলেই একসঙ্গে পথচলা হতে পারে। গণফোরামের অপর একটি সূত্রে জানিয়েছে, ঐক্যফ্রন্টের যাত্রা শুরুর সময় কামাল হোসেনকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল জামায়াতকে সবকিছু থেকে আলাদা রাখা হবে। এছাড়া জোটের শরিক দলগুলো নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে। তারপর গণফোরামের অনেকটা অগোচরেই ধানের শীষ প্রতীকে সবাইকে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি, যার মধ্যে জামায়াতও ছিল। এ নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন কামাল হোসেন। জানা গেছে, বিএনপির তীব্র আপত্তির মুখেও গণফোরাম থেকে নির্বাচিত দুই সাংসদ এখনও শপথ নেয়ার পক্ষে। ইতোমধ্যে তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন শপথ নেয়ার কথা। যে কোন সময় তারা শপথ নিতে পারেন। বুধবার গণফোরামের সম্মেলন প্রস্তুতি সভায় মোকাব্বির হোসেন এলেও যোগ দেননি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। আলোচনা আছে আওয়ামী লীগের সাবেক এই নেতা ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা সুলতান মনসুর গণফোরামের প্রার্থী হলেও নির্বাচিত হয়েছেন ধানের শীষ প্রতীকে। অপরদিকে সিলেট-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসীনা রুশদীর লুনার প্রার্থিতা হাইকোর্ট বাতিল করলে গণফোরামের প্রার্থী মোকাব্বির খানকে উদীয়মান সূর্য প্রতীকে সমর্থন দেয় বিএনপি। নির্বাচনের পর থেকেই তাদের শপথ নিয়ে রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনার জন্ম হয়। শুরুতেই নির্বাচিত দুজনেই শপথ নেয়ার পক্ষে একমত ছিলেন। কিন্তু দল ও জোটগত বিরোধিতার কারণে এক পর্যায়ে তারা পিছু হটেন। যদিও নানা নাটকীয়তা শেষে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়। সোমবার নির্বাচিত এমপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর শপথ নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দু’জন শপথ নেব। তবে তাড়াহুড়োর কিছু নাই। এখনও সময় আছে। ৯০ দিনের মধ্যে শপথ নিলেই হবে। ধানের শীষ প্রতীকে আপনি নির্বাচিত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আইনী কোন সমস্যা হবে কি-না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, এটা কোন সমস্যা হবে না। বিএনপি যদি সংসদে যেত, আর আমি যদি তাদের বিরুদ্ধে সংসদে ভোট দিতাম সেক্ষেত্রে সমস্যা হতো। এখন যেহেতু বিএনপি সংসদে যাচ্ছে না। তাই আমার শপথে কোন সমস্যা হবে না। আমি তো গণফোরামের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। নিয়ম অনুযায়ী, সংসদ শুরুর তার পরের ৯০ দিনের মধ্যে কেউ শপথ নিয়ে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর না করলে তার আসন শূন্য ঘোষণা করে সেখানে উপ-নির্বাচন দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।
×