ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হোল্ডার যেন গোবরে পদ্মফুল

প্রকাশিত: ১১:৪৭, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯

হোল্ডার যেন গোবরে পদ্মফুল

ওয়েস্ট ইন্ডিজের সোনালি সময়ের কথা ভাবলে অনেকেরই কষ্ট হয়। এই তো কিছুদিন আগে বিশ্বকাপের টিকেট পেতে বাছাই খেলতে হয় সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের। অর্থের অভাব, বোর্ডের সঙ্গে সিনিয়র ও তারকা ক্রিকেটারদের দ্বন্দ্ব, র‌্যাঙ্কিংয়ে ক্রমাবনতি, সর্বত্র হতাশার ছাপ। জৌলুস হারানো ক্যারিবীয় ক্রিকেটে ব্যতিক্রম কেবল জেসন হোল্ডার। ক্রান্তিকালে অধিনায়কের দায়িত্ব নিয়েছিলেন মূলত পেসার হিসেবে। টেল-এন্ডে ব্যাটিংটাও টুকটাক করতে পারতেন। সেই তিনি এখন ‘নাম্বার ওয়ান!’ ব্রিজটাউন টেস্টে আট নম্বরে নেমে হাঁকিয়েছেন ডাবল সেঞ্চুরি। অপরাজিত ২০২ রানের পথে রেকর্ড বইয়ের অনেক সমীকরণই নাড়িয়ে দিয়েছেন। ২৭ বছর বয়সী বার্বাডিয়ান নাম লিখিয়েছেন স্বদেশী গ্রেট স্যার গ্যারি সোবার্সের পাশে। সোবার্সের পর দীর্ঘ ৪৫ বছরে কোনও ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অলরাউন্ডার হিসেবে উঠে এসেছেন টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বরে। সত্যি অসারধারণ। নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাওয়া দল ভাল না করলেও হোল্ডার অনন্য। ব্যতিক্রম উদাহরণ। ক্রিকেটে যে আশ্চর্য বলে কিছু নেই, সেটি আরও একবার দেখল বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন। প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান আর ইতিহাসের মাত্র তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে আট নম্বর বা তার নিচে নেমে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকালেন জেসন হোল্ডার! ব্রিজটাউন টেস্টের দ্বিতীয় দিনে ১২৭ রানেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৬ উইকেট তুলে নিয়ে খেলায় ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছিল ইংলিশরা। কিন্তু তাদের হতাশায় ডুবিয়েছেন হোল্ডার-ডওরিচ। আরও কোনও উইকেট না হারিয়ে অবিচ্ছিন্ন জুটিতে ২৮৮ রান যোগ করেছেন দুজনে। হোল্ডার ৭ আর ডরওরিচ নেমেছিলেন ২৭ রান নিয়ে। ২৮৪ বলে ২৩ চার ও ৮ ছক্কায় হোল্ডার অপরাজিতই থেকে গেছেন ২০২ রান করে, ডওরিচ তার ৩৪৩ বলে ১১৬* রানের ইনিংসটি সাজিয়েছেন ১১ চার ও ১ ছক্কায়। সপ্তম উইকেটে টেস্ট ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৯৫* রানের জুটি গড়েন হোল্ডার-ডওরিচ। তাঁদের অপরাজিত এই জুটিতে ভর করে ৮৯ বছর আগের এক কীর্তিও নতুন করে লেখায় ক্যারিবীয়রা। ১৯৩০ সালে জর্জটাউন টেস্টে এই ইংল্যান্ডকেই ৬১৭ রানের লক্ষ্য দিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাঁদের টেস্ট ইতিহাসে এতদিন এটাই ছিল প্রতিপক্ষ দলকে দেওয়া সর্বোচ্চ রানের লক্ষ্য। কাল সেই রেকর্ডটি নতুন করে লিখিয়েছেন হোল্ডার-ডওরিচ। প্রথম ঘণ্টায় বেশ সাবধানী ব্যাটিং করেছেন দুজন। এরপর বাজে বল পেলে আর ছাড়েননি। হোল্ডার ফিফটি তুলেছেন ৬০ বলে, এরপর সেঞ্চুরি তুলে নিতে খেলেছেন আরও ৩৯ বল। দেড় শ’ রানের কোটায় পৌঁছাতে একটু সময় নিয়েছেন হোল্ডার। এই পথ পর্যন্ত আসতে তিনি খেলেছেন আরও ৮৬ বল। তবে ‘ডাবল’ তুলে নেওয়ার বাকি পথটুকু বেশ দ্রুতই টপকে গেছেন তিনি। দেড় শ’ থেকে দুই শ’ তুলতে তাঁর লেগেছে মাত্র ৪৪ বল। সব মিলিয়ে ২২৯ বলে ২০০ রান করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় দ্রুততম ‘ডাবল’ তুলে নেন হোল্ডার। শুধু কী তাই? দ্বিতীয় ইনিংসে ছয় কিংবা তার পরে ব্যাট করতে নেমে এর আগে ‘ডাবল’ সেঞ্চুরি করেছিলেন শুধু একজনই। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান! হোল্ডার এদিন ইতিহাসের এই খেরোখাতায় ব্র্যাডম্যানেরই পাশে নাম লিখিয়েছেন। ১৯৩৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সাতে ব্যাট করতে নেমে ২৭০ রান করেছিলেন প্রয়াত স্যার ডন। হোল্ডার-কীর্তির এখানেই শেষ নয়। এই ইনিংসে ৮টি ছক্কা মেরেছেন হোল্ডারÑ যা টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোন ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানের ইনিংসে সর্বোচ্চ ছক্কা। আটে কিংবা তার নিচে ব্যাট করতে নেমে হোল্ডারের আগে ডাবল সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন শুধু দুজন পাকিস্তানের ওয়াসিম আকরাম (২৫৭, জিম্বাবুয়ে, ১৯৯৬) ও ইমতিয়াজ আহমেদ (২০৯, নিউজিল্যান্ড, ১৯৫৫)। ক্যারিবীয় অধিনায়ক হোল্ডার এদিন ডাবল সেঞ্চুরি তুলে দারুণ এক তালিকাতেও জায়গা করে নিয়েছেন। টেস্ট ইতিহাসে কোনও ক্রিকেটার তার নিজের ক্যারিয়ারে ব্যাট হাতে ডাবল সেঞ্চুরি আর ম্যাচে ১০ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়লেন মাত্র তিন অধিনায়Ñইমরান খান, এ্যালান বোর্ডার ও হোল্ডার! ক্যারিবীয় অধিনায়ককে মূলত পেসার হিসেবে সবাই জানলেও তাঁর ব্যাটিং সামর্থ্যের প্রমাণ সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানÑ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাত টেস্টে হোল্ডার ৫৪৩ রান করেছেন ৫৪. ৩০ গড়ে, যা একই সময়ে ১৪ টেস্ট খেলা বিরাট কোহলির ব্যাটিং গড়ের চেয়ে বেশি! সত্যি অনন্য, অসাধারণ। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাটে-বলে অসাধারণ ধারাবাহিকতা। মাঠে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পুরস্কার জেসন হোল্ডার পেয়েছেন র‌্যাঙ্কিংয়ে। টাইগার তারকা সাকিব আল হাসানকে পেছনে ফেলে উঠে গেছেন আইসিসি টেস্ট অলরাউন্ডারদের র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে। হোল্ডারের এই অর্জনে ৪৫ বছর পর আবারও টেস্টের শীর্ষ অলরাউন্ডার পেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সবশেষ ১৯৭৪ সালের মার্চে অবসরের বছর শীর্ষে উঠেছিলেন সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার বলে বিবেচিত গ্যারি সোবার্স। টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন, প্রথম ইনিংসে উইকেট নিয়েছিলেন দুটি। এটির আগে হোল্ডারের সবশেষ টেস্টে ভারতের বিপক্ষে হায়দরাবাদে ছিল ফিফটি ও ৫ উইকেট। তার আগে বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ৫ উইকেট, দ্বিতীয় টেস্টে ১১টি। ব্যাট হাতে ছিল কার্যকর ইনিংস। বাংলাদেশ সিরিজের আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও ব্যাটে-বলে পারফরম্যান্স ছিল দুর্দান্ত। হোল্ডারের রেটিং পয়েন্ট এখন ৪৪০। দুইয়ে থাকা সাকিবের পয়েন্ট ৪১৫, তিনে রবীন্দ্র জাদেজা ৩৮৭ পয়েন্ট নিয়ে। বার্ডাডোজে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে মাত্র ৫ রান করলেও বল হাতে ২টি উইকেট নিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ হোল্ডার। আর দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ২০২ রান করেন তিনি। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে কোনও উইকেট পাননি। ইংল্যান্ডকে ৩৮১ রানে হারিয়ে প্রথম টেস্ট জিতে সিরিজে ১-০ তে এগিয়ে যায় ক্যারিবীয়রা। দ্বিতীয় ইনিংসে ৮ উইকেট নিয়ে ইংলিশদের নাড়িয়ে দেন অকেশনাল স্পিনার রোস্টন চেইস। তবে ম্যাচসেরার পুরস্কার ওঠে রেকর্ডম্যান অধিনায়ক হোলান্ডেরর হাতেই। আর এই পারফর্মেন্সের সুবাদেই দীর্ঘ সাড়ে চার দশকে প্রথম কোনও ক্যারিবিয়ান ওঠেন আইসিসি অলরাউন্ডার র‌্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বরে। গো এ্যাহেড জেসন।
×