ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতার নানা দিক;###;শেখ শাহ্রিন আক্তার চাঁদনী

আলো ছড়ানো তারকারা

প্রকাশিত: ১১:৪৬, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯

আলো ছড়ানো তারকারা

জাতীয় এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতার পর্দা নামল শুক্রবার, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। এই আসরে ৪টি রেকর্ড হয়েছে। শেষ দিনে রেকর্ড হয় ১টি। ১৬ সোনা, ১৩ রূপা ও ১৭ তা¤্রসহ ৪৬ পদক নিয়ে দলীয়ভাবে সেরা হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। দ্বিতীয় হওয়া নৌবাহিনী পায় ১৫ সোনা, ২১ রূপা ও ৯ তা¤্রসহ ৪৫ পদক। ২ স্বর্ণ, ১ রৌপ্য এবং ৪ তা¤্রসহ মোট ৭টি পদক নিয়ে তৃতীয় হয় বাংলাদেশ জেল। এই আসরে ৪টি নতুন জাতীয় রেকর্ডের মধ্যেই ৩টিই নৌবাহিনীর অর্জন (১০০ মিটার পুরুষ, শটপুট পুরুষ ও ২০০ মিটার মহিলা)। আর ১টি বিকেএসপির (৪০০ মিটার ইভেন্টে)। তিন দিনব্যাপী প্রতিযোগিতায় ৩৬ ইভেন্টের জন্য ৪৯ দলের ৪২২ এ্যাথলেট অংশ নেন (৩১৯ পুরুষ ও ১০৩ মহিলা)। আসরের সেরা পুরুষ এ্যাথলেট হন বিকেএসপির জহির রায়হান। তিনি ১টি রেকর্ডসহ ২টি স্বর্ণপদক জেতেন। আর সেরা নারী এ্যাথলেট হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুমি আক্তার (৪টি স্বর্ণপদক)। * কোন্ ইভেন্টে কে সেরা ॥ মহিলাদের ১০০ মিটার হার্ডেলসে বাংলাদেশ জেলের সুমিতা রানী, পুরুষদের ১৫০০ মিটার দৌড়ে সেনাবাহিনীর আল-আমিন, পুরুষদের শটপুটে নৌবাহিনীর মোহাম্মদ ইব্রাহিম, মহিলাদের হাইজাম্পে বাংলাদেশ জেলের উম্মে হাফসা রুমকি, মহিলাদের শটপুটে আনসারের শ্রাবণী মল্লিক, পুরুষদের ৫০০০ মিটার দৌড়ে সেনাবাহিনীর আল আমিন, পুরুষদের হাইজাম্পে নৌবাহিনীর মাহফুজুর রহমান, পুরুষদের ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে নৌবাহিনীর রাকিবুল হাসান, সাইফুল ইসমাইল খান, মেজবাহ আহমেদ এবং মোহাম্মদ ইসমাইল, মহিলাদের ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে নৌবাহিনীর সোহাগী আক্তার, শিরিন আক্তার, আইরিন আক্তার এবং তামান্না, পুরুষদের ম্যারাথনে সেনাবাহিনীর ফিরোজ খান, মহিলাদের লং জাম্পে নৌবাহিনীর রিংকি খাতুন, পুরুষদের জ্যাভলিন থ্রোয়ে সেনাবাহিনীর মোঃ মনিরুজ্জামান, পুরুষদের হ্যামার থ্রোয়ে নৌবাহিনীর মাহফুজ হাসান, পুরুষদের ১১০ মিটার হার্ডেলসে সেনাবাহিনীর মির্জা হাসান, পুরুষদের লং জাম্পে নৌবাহিনীর আল আমিন, মহিলাদের জ্যাভলিন থ্রোয়ে সেনাবাহিনীর পাপিয়া আক্তার, পুরুষদের ৩০০০ মিটার স্টেপল চেজে নৌবাহিনীর আসিফ বিশ্বাস, মহিলাদের ২০০ মিটার দৌড়ে নৌবাহিনীর সোহাগী আক্তার, ছেলেদের ২০ কিলোমিটার হাঁটায় সেনাবাহিনীর রহিম উদ্দিন, পোল ভোল্টে নৌবাহিনীর সাইফুল ইসলাম, ৪০০ মিটার হার্ডলসে নৌবাহিনীর ইবাদ আলী, ট্রিপল জাম্পে সেনাবাহিনীর সোহেল রানা, চাকতি নিক্ষেপে সেনাবাহিনীর মামুন শিকদার, ১০০০০ মিটার দৌড়ে সেনাবাহিনীর আল আমিন, ছেলেদের ৮০০ মিটারে সেনাবাহিনীর কামরুল হাসান, মেয়েদের বিভাগে একই দলের সুমী আক্তার, মেয়েদের চাকতি নিক্ষেপে নৌবাহিনীর জাকিয়া আক্তার, পুরুষদের ৪০০ মিটার রিলেতে সেনাবাহিনীর তালেব-মাসুদ-মিনহাজ-সবুজ; মেয়েদের ২০০ মিটারে নৌবাহিনীর সোহাগী আক্তার, মেয়েদের ৪০০, ৮০০, ১৫০০ ও ৩০০০ মিটারে সেনাবাহিনীর সুমী আক্তার স্বর্ণ জেতেন। * রেকর্ড গড়া এ্যাথলেটদের জন্য বিশেষ অর্থ পুরস্কার ॥ এবারের আসরে নতুন রেকর্ড গড়া ছয় এ্যাথলেটকে ১০ হাজার টাকা করে বিশেষ পুরস্কার দিয়েছে আলহাজ বশির আলী ফাউন্ডেশন। পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন : মেয়েদের ২০০ মিটার স্প্রিন্টে নৌবাহিনীর সোহাগী আক্তার, ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে বিকেএপসির জহির রায়হান, শটপুটে নৌবাহিনীর মোহাম্মদ ইব্রাহিম এবং ১০০ মিটার স্প্রিন্টে মোঃ ইসমাইল। এছাড়া আরও দুই জন ১০০ মিটারে হাসান মিয়া ও মেয়েদের ২০০ মিটারে শিরিন আক্তার রেকর্ড গড়ে রৌপ্য জেতেন। * সুমি আক্তার সেরা নারী এ্যাথলেট ॥ মাত্র ৩৪ কেজি ওজনের, ছোটখাটো ও একেবারেই শুকনো গড়নের কৃষ্ণকলি কন্যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ্যাথলেট সুমি আক্তার এবারের আসরের সেরা নারী এ্যাথলেট হয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে বেশি ৪টি স্বর্ণ জিতেছেন। সেই সঙ্গে একটি রূপা-ও! মহিলাদের ৪০০, ৮০০, ১৫০০ এবং ৩০০০ মিটারে স্বর্ণ জেতেন। তবে হেরে যান ৪ গুণিতক ৪০০ মিটার রিলেতে। তার রৌপ্য জেতে (স্বর্ণ জেতে নৌবাহিনী)। গত বছরের জুলাইয়ে সামার এ্যাথলেটিক্সেও সুমি জিতেছিল ৪টা স্বর্ণ ও ১টি রৌপ্যপদক। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার মেয়ে সুমি। দুলনা বিএম উচ্চ বিদ্যালয়ে স্কুলে পড়তেন, সে স্কুলের সালাউদ্দিন স্যারের উৎসাহেই এ্যাথলেটিক্স খেলা শুরু করেন। জেলা পর্যায়ের এ্যাথলেটিক্স দিয়েই শুরু। এবং শুরু থেকেই চোখ ধাঁধানো সাফল্য। তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়তেন সুমি। এখন পড়েন ¯œাতকে পড়েন (উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ে)। তারপর বিজেএমসিতে যোগ দেন সুমি। তারপর যোগ দেন সেনাবাহিনীতে, ২০১৫ সালে (বর্তমানে সৈনিক পদে কর্মরত)। সামার এবং ন্যাশনাল প্রতিযোগিতা মিলে ২১ বছর বয়সী সুমির মোট স্বর্ণসংখ্যা কপালে চোখ উঠিয়ে দেয়ার মতো, ২০টি! * জহির রায়হান সেরা পুরুষ এ্যাথলেট ॥ জাতীয় এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় সেরা পুরুষ এ্যাথলেট হয়েছেন বিকেএসপির জহির রায়হান। ১টি রেকর্ডসহ তিনি জিতেছেন ২টি স্বর্ণ। ৪০০ মিটার দৌড়ে তিনি ভেঙ্গেছেন ৩৩ বছর আগের গড়া রেকর্ড। ১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসে মিলজার হোসেনের ৪০০ মিটারে (৪৭.৫৫ সেকেন্ড) টাইমিং ভেঙ্গে মিলজারের চোখের সামনেই নতুন জাতীয় রেকর্ড গড়েন জহির (৪৬.৮৬ সেকেন্ড)। রেকর্ড গড়ার পর মিলজকার প্রাণঢালা অভিনন্দন জানান জহিরকে। ৪০০ মিটারের পর ২০০ মিটারেও সোনা জেতেন জহির। ২০১৭ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়ে প্রায় ছয় মাস ট্র্যাকের বাইরে ছিলেন জহির। এমনকি বাঁ চোখ নষ্ট হওয়ার শঙ্কাও ছিল। অস্ত্রোপচার করে চোখ বাঁচিয়ে শুধু ট্র্যাকেই ফেরেননি, দুর্দান্ত এক রেকর্ডও গড়েন ১৯ বছর বয়সী এই এ্যাথলেট। * লাভলীকে টপকালেও বিউটির রেকর্ড থেকে বহুদূরে শিরিন ॥ প্রতিযোগিতায় প্রথমদিনেই ছিল সেরা আকর্ষণ ছিল ১০০ মিটার স্প্রিন্ট। এতে পুরনো রানী শিরিন আক্তারকেই পাওয়া গেছে। নৌবাহিনীর স্প্রিন্টার শিরিন ১১.৮০ সেকেন্ড নিয়ে স্বর্ণ, একই দলের সোহাগী আক্তার ১১.৯০ সেকেন্ড নিয়ে রৌপ্য এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শরীফা খাতুন ১২.৩০ সেকেন্ড সময় নিয়ে জেতেন তা¤্রপদক। এ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে টানা আটবার দ্রুততম মানবী হলেন সাতক্ষীরার মেয়ে শিরিন। এক্ষেত্রে টপকে যান সাবেক জাতীয় স্প্রিন্টার সুলতানা পারভীন লাভলীকে। লাভলী সাতবার দ্রুততম মানবী হয়েছিলেন নব্বইয়ের দশকে। আরেক সাবেক স্প্রিন্টার নাজমুন নাহার বিউটির টানা নয়বারের (২০০৫-২০১৩) দ্রুততম মানবী হওয়ার রেকর্ড এবং সার্বিকভাবে মোট ১৭ বারের দ্রুততম মানবী হওয়ার রেকর্ড ভাঙ্গতে আরও অনেকদূর পথ পাড়ি দিতে হবে শিরিনকে। অবশ্য তার আগে তাকে অতিক্রম করতে হবে আরেক সাবেক এ্যাথলেট ফিরোজা বেগমের ১০বারের দ্রুততম মানবী হওয়ার কীর্তিকে। * অভিষেকেই রেকর্ড গড়ে দ্রুততম মানব ইসমাইল ॥ পুরুষ বিভাগে ১০০ মিটার দৌড়ে নৌবাহিনীর মোহাম্মদ ইসমাইল ১০.২০ সেকেন্ড রেকর্ড টাইমিং করে নিয়ে স্বর্ণ, বিকেএসপির হাসান মিয়া ১০.৩০ সেকেন্ড নিয়ে রৌপ্য এবং নৌবাহিনীর রাকিবুল হাসান ১০.৪০ সেকেন্ড নিয়ে তাম্রপদক লাভ করেন। ইসমাইল মূলত লং জাম্পার। এর আগে তিনি জাতীয় এ্যাথলেটিক্সে ৮টি স্বর্ণ জিতেছেন। কিন্তু একবারও মিডিয়ার নজরে না আসায় মূলত একরাশ ক্ষোভ থেকেই স্প্রিন্টার বনে যান এবং প্রথম প্রচেষ্টাতেই বাজিমাত করেন কুমিল্লার তিতাস থানার ছেলে ২৬ বছর বয়সী ইসমাইল। ১০.২০ সেকেন্ড সময় নিয়ে ইসমাইল ভাঙেন ১৯৯১ সালে গড়া গোলাম আম্বিয়ার ১০.৪০ সেকেন্ডের (হ্যান্ড টাইমিং) রেকর্ড। ২১ বছর আগের রেকর্ড ভাঙলেন ইব্রাহিম ॥ নৌবাহিনীর মোহাম্মদ ইব্রাহিম পুরুষদের শটপুটে ভাঙেন ২১ বছর আগের রেকর্ড। ১৪.৫৩ মিটার ছুঁড়ে নতুন রেকর্ড গড়েন। আগের রেকর্ডটি ছিল ১৯৯৭ সালে মোজাফফর হোসেনের ১৪.২৫ মিটার। * ১০০ মিটার স্প্রিন্টে নেই মেজবাহ ॥ মেজবাহ আহমেদ ২০১৩ সাল থেকে নিয়মিতই জাতীয় এ্যাথলেটিক্সের ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিতে আসছেন। যদিও সর্বশেষ সামার এ্যাথলেটিক্সে রৌপ্য জেতেন। এবার অবশ্য তা¤্রপদকও জেতেনি। এমনকি এই ইভেন্টে অংশই নিতে পারেননি। কারণ নিজ সংস্থা নৌবাহিনীর হয়ে হিটেই তৃতীয় হওয়ায় জাতীয় পর্যায়ে খেলার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেননি। অবশ্য ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে দলীয়ভাবে স্বর্ণ জিতেছেন। * ‘বুড়ি’ অপবাদের দাঁতভাঙা জবাব সুমিতার ॥ বয়স হয়ে গেছে ২৭। অনেকেই তাকে ব্যঙ্গ করে ‘বুড়ি’ বলে আড়ালে ডাকে। সেই ক্ষোভ নিয়েই মেয়েদের ১০০ মিটার হার্ডলসে ক্যারিয়ারের পঞ্চদশ জাতীয় স্বর্ণপদক জিতে অপবাদের দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছেন সুমিতা রানী। বাংলাদেশ জেলের তারকা এই হার্ডলার এই স্বর্ণজয়ের পরেই হৃদয়বিদারক এক সংবাদ পান। চাচাতো ভাই অমর কৃষ্ণ দাসের হৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাবার খবর পেয়ে আকুল নয়নে কেঁদে বুক ভাসান ট্র্যাকের রানী সুমিতা রানী। * ফেডারেশনকে সতর্কবার্তা ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর ॥ যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ এ্যাথলেটিক ফেডারেশন ঘোষণা দিয়েছিল এবারের প্রতিযোগিতা হবে ইলেক্ট্রনিক্স টাইমারে। কিন্তু বাস্তবে হয় হ্যান্ড টাইমারে! জানা যায় কারিগরী সমস্যার কারণে এমনটা হয়েছে। বিষয়টি জেনে ক্ষুব্দ হন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদককে জানিয়ে দেন, পরেরবার এমনটি হলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তার এমন ধমকে পরিদিনই সচল হয়েছিল ইলেকট্রনিক্স টাইমারটি!
×