ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রীলঙ্কায় জব্দ বিশাল মাদক চালানের রহস্য উদ্ঘাটিত

প্রকাশিত: ১১:০৪, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯

শ্রীলঙ্কায় জব্দ বিশাল মাদক চালানের রহস্য উদ্ঘাটিত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ র‌্যাবের পৃথক অভিযানে সাত নারীসহ চৌদ্দ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা আন্তর্জাতিক মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। তারা বিদেশে মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিল। এদের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে গত বছর শ্রীলঙ্কায় জব্দ হওয়া বিশাল দুইটি মাদক চালানের রহস্য উদ্ঘাটিত হলো। মেয়েদের বাংলাদেশ থেকে বায়িং হাউসে চাকরি দেয়ার নামে কৌশলে মাদক ব্যবসায় জড়িত করা হতো। পুরোপুরি মাদকের ব্যবসা শেখানোর পর তাদের পাঠানো হতো বিদেশে। বিদেশে তারা মাদক কারবারের কাজ করত। সোমবার ঢাকার বিমানবন্দরের পাশে কাওলা এলাকা থেকে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব-১ এর একটি দল তিন নারীসহ পাঁচ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে প্রায় দুই হাজার পিস ইয়াবা, বৈদেশিক মুদ্রা ও পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, ফাতেমা ইমাম তানিয়া (২৬), আফসানা মিমি (২৩), সালমা সুলতানা (২৬), শেখ মোহাম্মদ বাধন ওরফে পারভেজ (২৮) ও রুহুল আমিন ওরফে সায়মন (২৯)। মঙ্গলবার কাওরানবাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান আরও জানান, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে বিশেষ অভিযানে ২৭২ কেজি হেরোইন ও ৫ কেজি কোকেনসহ বাংলাদেশী নাগরিক মোঃ জামাল উদ্দিন ও রাফিউল ইসলাম গ্রেফতার হয়। এর কয়েকদিন পরেই ৩২ কেজি হেরোইনসহ বাংলাদেশী নাগরিক সূর্যমণি গ্রেফতারের ঘটনা ঘটে। পর পর মাদকের দুইটি বড় চালান জব্দ হওয়া এবং তিন জন বাংলাদেশী গ্রেফতারের ঘটনায় রীতিমতো তোলপাড় চলতে থাকে। ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। গঠিত টাস্কফোর্সের চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের সদস্য চয়েজ রহমান গ্রেফতার হয়। এ সংক্রান্ত দায়েরকৃত মামলাটির ছায়া তদন্ত করছে র‌্যাব। তদন্তের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ পাঁচ জন গ্রেফতার হলো। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে এই র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, তারা আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের সদস্য। বাংলাদেশে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে মোঃ আরিফ উদ্দিন নামের একজন। আরিফ উদ্দিনের আল-আমিন ফ্যাশন বায়িং হাউস নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। ব্যবসার আড়ালে সে মাদক ব্যবসা করে। আরিফের সঙ্গে মাদক সিন্ডিকেটে বাংলাদেশী অন্তত ২০ জন আছে। সিন্ডিকেটটি দেশের ভেতরে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আরিফ নিজেই কথিত স্মার্ট যুবক ও যুবতীদের বায়িং হাউসে চাকরি দেয়ার নামে রিক্রুট করত। তার সঙ্গে রেহানা ও গ্রেফতারকৃত রুহুল আমীন ওরফে সায়মন রিক্রুট করত। তাদের পছন্দ ছিল স্বল্প শিক্ষিত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আধুনিক পোশাক পরিধানে অভ্যস্ত যুবতীরা। পরীক্ষামূলকভাবে তাদের প্রথমে ব্যবসায়িক কাজে নিয়োজিত করত। বিশ্বস্তদের দিয়ে দেশের ভেতরে মাদক সংগ্রহ, সরবরাহ ও বিতরণ করাত। মাদক স্থানান্তরসহ অন্য কাজে পারদর্শী হওয়ার পর তাদের বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হতো। তাদের বিদেশী কালচারে অভ্যস্ত করা হতো। কয়েক দফা যাতায়াত করিয়ে পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর পর তাদের দিয়ে বিদেশে মাদক সরবরাহ ও বিতরণের কাজে লাগানো হতো। গ্রেফতারকৃত চক্রটি আফগানিস্তান, পাকিস্তান, চীন, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কার মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ফাতেমা ইমাম তানিয়া শরীয়তপুরের বাঁশবাড়িয়া গালর্স স্কুলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছে। ২০১৬ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচিং করার সময় সহপাঠী ফারহানার ও গ্রেফতারকৃত রুহুল আমিনের মাধ্যমে রেহানার সঙ্গে পরিচয় হয়। রেহানার প্ররোচনায় ২০১৬ সালে মাদক সিন্ডিকেটটিতে জড়িয়ে পড়ে। এখন পর্যন্ত সে দুইবার ভারতে, তিনবার চীন, দশ বার মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেছে। শ্রীলঙ্কায় মাদক ব্যবসার জন্য তাদের ৪টি ভাড়া বাসা করা আছে। আফসানা মিমি ২০১৫ সালে মিডিয়া জগতে কাজ করার জন্য ঢাকায় আসে। নাচ, গান ও অভিনয়ে পারদর্শী এবং ঢাকার একটি ড্যান্স ক্লাবের সঙ্গে জড়িত ছিল। কর্মক্ষেত্রের সূত্রে একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে কর্মরত রুহুল আমীন সায়মনের সঙ্গে পরিচিত হয়। তার মাধ্যমে রেহানা ও আরিফের সঙ্গে পরিচয়। ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে ২০১৭ সালে মাদক সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়ে। ২০১৭ সালে সে আরিফের সঙ্গে মালয়েশিয়া যায়। সেখান থেকে সে এবং রেহানা মাদকের একটি চালান নিয়ে শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিল। সালমা সুলতানা ২০১০ সালে এইচএসসি পাসের পর পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে কাজ শুরু করেছিল। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে চাকরির সময় গ্রেফতারকৃত ফাতেমা ইমাম তানিয়ার মাধ্যমে রেহানার সঙ্গে পরিচয় হয়। ২০১৭ সাল থেকে চক্রটির সঙ্গে কাজ করছিল। সে মাদক সিন্ডিকেটে কাজ করার জন্য চীন, শ্রীলঙ্কা ও ভারতে গেছে। বাধন ওরফে পারভেজ একটি বায়িং হাউসে কাজ করত। ২০১৭ সালে আরিফের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে। আরিফের নির্দেশনায় ২০১৮ সালে দুইবার শ্রীলঙ্কায় এক মাসের বেশি সময় মাদক ব্যবসা করে। সেখানে সে মাদক প্যাকেজিং, সংগ্রহ ও সরবরাহের কাজ করত। রুহুল আমীন ওরফে সায়মন একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে কর্মরত। আত্মীয়তার সূত্রে রেহানা আক্তারের মাধ্যমে সে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। রেহানার নির্দেশনায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীদের প্রলোভনে ফেলে মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত করত। সে মাদক সিন্ডিকেটের সদস্যদের পাসপোর্ট, ভিসা ও টিকেটিং কাজ করত। সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-১ অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম ও র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের উপপরিচালক মেজর রইসুল ইসলামসহ উর্ধতন র‌্যাব কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে সোমবার র‌্যাব-১০ এর উপঅধিনায়ক মেজর আশরাফুল হকের সার্বিক নির্দেশনায় একটি দল রাজধানীর কদমতলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে তিন নারীসহ চার মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে মাদক ও মাদক বিক্রির টাকা উদ্ধার হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, তারা বানু (৪৮), আলিফ হোসেন (২১), মোছাঃ শিখা খাতুন (২৩) ও সুমাইয়া খাতুন স্বর্ণা (১৯)। তাদের কাছ থেকে প্রায় ২৫ হাজার পিস ইয়াবা ও মাদক বিক্রির প্রায় ৩৫ হাজার টাকা জব্দ হয়েছে। এদিকে সোমবার বিকেলে র‌্যাব-৪ এর একটি দল রাজধানীর রূপনগর থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার পিস ইয়াবা ও মাদক বিক্রির ৫২ হাজার টাকাসহ পাঁচ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, আবদুল্লাহ ওরফে আলিম ওরফে জামাই (৩৩), আলম (৩৫), রবিউল হক ওরফে রুজবুল (৫৫), আতিকুর রহমান (৩১) ও ফাতেমা আক্তার (৩৩)। তারা দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে মাদক এনে ঢাকায় বিক্রি করছিল।
×