ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বোরো নিয়ে ব্যস্ত চাষী, আবাদ হবে ৪৮ লাখ ৪২ হাজার হেক্টরে

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯

বোরো নিয়ে ব্যস্ত চাষী, আবাদ হবে ৪৮ লাখ ৪২ হাজার হেক্টরে

ওয়াজেদ হীরা ॥ পৌষ বা মাঘের শীতও দমাতে পারেনি কৃষকের উদ্যম। শীত উপেক্ষা করে প্রতিদিন ছুটছেন মাঠে। চলতি বোরো মৌসুমকে কেন্দ্র করে ব্যস্ততা বেড়েছে কৃষকের। ধানের জমিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। অনেক এলাকায়ই বোরোর চারা লাগানো শেষ। কোথাও এখনো চলমান। চারা লাগানো জমির যতদূর চোখ যায় ধানের কচি পাতায় সবুজ আকৃতি। চারাগুলো শক্ত হয়ে বেড়ে উঠছে। চারা নয়, এ যেন কৃষকের সবুজ স্বপ্ন বুনন! উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে ভাল ফলন ঘরে তুলবেন সে প্রত্যশায় বোরো নিয়ে এত ব্যস্ততা তাদের। মূলত ১৬ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত রবি মৌসুম। শীতকালীন বিভিন্ন ফসলও করা হয় এ সময়। সেই সঙ্গে বৃষ্টি নেই বললেই চলে তাই সেচের মাধ্যমে বোরোর আবাদ হয়। কেউ কেউ আগাম বোরো করলেও ডিসেম্বর থেকেই পুরো দমে বীজ ধান বা বীজতলা তৈরির কাজ শুরু করে রোপণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। বীজতলার পর মাঠে মাঠে ফসলি জমি প্রস্তুতের কাজ শুরু হয়। জমিতে হাল চাষ, বীজতলা থেকে চারা উঠানো এবং ক্ষেতে চারা রোপণের কাজ সবই হয়। এখনও দেশের অনেক জায়গায় চারা ধান লাগানো হচ্ছে, যা চলবে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সরকার বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে এক কোটি ৯৬ লাখ ২৩ হাজার মেট্রিক টন। যা আগের অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১৭-১৮ তে অর্জিত হয় ১ কোটি ৯৫ লাখ ৭৫ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। এবার বোরো আবাদের জন্য জমির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪৮ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ৪৭ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৮ লাখ ৫৯ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়। অর্থাৎ লক্ষ্যের চেয়েও বেশি জমিতে বোরো আবাদ হয়। সে হিসেবে এবারও নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অধিক জমিতে বোরো আবাদ হবে বলে কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেন। সরেজমিন উইংয়ের উপপরিচালক (মনিটরিং) মোঃ মিজানুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা আশা করছি এবারও জমির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে এবং উৎপাদন ভাল হবে। দেশের ধান চাষের জমিগুলোয় দেখা গেছে কৃষকের ব্যস্ততা। শীতের তীব্রতাও কৃষকের ব্যস্ততাকে দমাতে পারে না। শীতের সকালে আরামের ঘুম ছেড়ে কৃষক ছোটেন মাঠে সোনালি স্বপ্ন বুননের আশায়। ময়মনসিংহের ত্রিশাল, ভালুকা, ফুলবাড়িয়ায় দেখা গেছে ফসলের মাঠে বোরো রোপণে ব্যস্ত কৃষক। শীত উপেক্ষা করে সকাল সকাল ছুটছেন মাঠে। গভীর নলকূপের সরবরাহকৃত পানির মাধ্যমে জমি চাষ দিয়ে তাতে বোরো রুপনের উপযুক্ত করেছেন কৃষকরা। কোথাও কোথাও দেখা যায় চারা লাগানো শেষ। জমির যতদূর চোখ যায় একটা সবুজের সমারোহ দেখা যায়। পাশর্^বর্তী জেলা টাঙ্গাইলের একাধিক অঞ্চলঘুরেও দেখা গেছে কৃষকদের এখন বোরো ফসল নিয়ে নানা উদ্যোগ। যে সকল জমিতে আগাম লাগানো হয়েছে সেসব জমির ক্ষেতে আগাছ পরিষ্কার করা হচ্ছে আবার কোন ক্ষেতে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বিষ ছড়ানো হচ্ছে। সখিপুর উপজেলার কৃষক শাহ আলী জনকণ্ঠকে বলেন, চারা লাগিয়েছি বেশ কিছু দিন হলো। এখন আগাছা পরিষ্কার করছি। আমার আশপাশে অনেকেই এখনো চারা বুনছেন। কৃষকরা জানান, নিয়মিত দেখাশোনা না করলে আগাছা বা পোকা ধরে ফেলে। একাধিক জেলায় কৃষি সম্প্রসারণের কর্মকর্তারা জানান প্রায় সব জেলায়ই বোরোর চারা লাগানো শেষ পর্যায়ে। জানা গেছে, আমনে এবার বেশ ভাল লাভ পেয়েছেন চাষী। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই বোরো আবাদে মাঠে নামেন কৃষকরা। কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্টদের মতে, আরও প্রায় একমাস ধরেই বোরো লাগানো চলবে। সে হিসেবে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি চলে যাবে অনেকের বোরোর চারা লাগাতেই। এর মধ্যে কেউ কেউ চারগাছ সংগ্রহ করা শুরু করেছেন। অনেকেই জমি প্রস্তুত করে ফেলেছেন। উত্তরাঞ্চলের প্রচুর শীত কিন্তু তাতেও থেমে নেই বোরো আবাদ। তবে এবছর খুব একটা চারা নষ্ট হয়নি। গতবার একাধিক শৈত্যপ্রবাহে কয়েক দফায় কৃষকদের চারাগাছ হলুদ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এবার সেরকম কিছু হয়নি। আগামীর খাদ্য সংগ্রহের নতুন স্বপ্ন নিয়ে বোরো আবাদে খুলনার চাষীরা কোমর বেঁধে মাঠে নামছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমি প্রস্তুত, আগাছা পরিষ্কার ও ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে কৃষক পরিবারগুলো। খুলনা জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, খুলনা জেলায় গত মৌসুমে ৫১ হাজার ৮২৪ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে ৫৮ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ হয়। এ মৌসুমে ৫৮ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদেও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে আরও বেশি জমি আবাদ হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ। এদিকে, হাওড় এলাকা সুনামগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা যায় ইতোমধ্যেই ৯১ শতাংশ বোরো রোপণ হয়ে গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বশির আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, হাওড়ে আমাদের শতভাগ বোরো লাগানো শেষ। জেলার অন্যান্য জায়গায় কিছু বাকি। এবার সুনামগঞ্জ জেলায় ২ লাখ ১৭ হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। নওগাঁ জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত বছরগুলোতে ছিল হাড় কাঁপানো শীত থাকলেও এবার তীব্রতা কম। এতে বোরো চাষাবাদে স্বস্তিতে রয়েছেন কৃষকরা। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে মাঠে চলছে পানি সেচ, জমি প্রস্তুত ও চারা রোপণের কাজ। নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মনোজিত কুমার মল্লিক বলেন, ইতোমধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ জমিতে চারা রোপণ করা হয়েছে। জেলায় ১ লাখ ৮৮ হাজার ১৮৬ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বলেও জানা যায়। শুধু নওগাঁ নয় উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ এলাকায় ভাল আবহাওয়ার কথা বলেছেন কর্মকর্তারা। রংপুর অঞ্চলের উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জমান জনকণ্ঠকে বলেন, এবার কোন ধরনের অসুবিধা হবে না। এত ভাল আবহাওয়া গত বিশ বছরেও আমি দেখি নাই। আল্লাহ কৃষকদের প্রতি সহায় হয়েছেন মনে হচ্ছে। রবি মৌসুমের সকল ফসলই ভাল হবেন আশা করেন তিনি। বোরো আবাদ নিয়ে বলেন, আমাদের এখানে ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৩৩৭ হেক্টর জমি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যার মধ্যে ২৫ শতাংশের মতো এখন পর্যন্ত আবাদ হয়েছে। কৃষকরা ব্যস্ত সময় পাড় করছেন বোরো আবাদে। এদিকে, বোরো মৌসুম অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের জন্য কয়েক লাখ টন ডিজেল মজুদ রয়েছে বলেও জানা গেছে। উত্তরাঞ্চলসহ পুরো দেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে তেল সরবরাহ মনিটরিং করা হয় বোরো মৌসুমে। ইতোমধ্যেই জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে তদারকি শুরু করেছেন। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের হিসাবে দেশে বছরে ২৬ লাখ টন ডিজেল ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে বোরো মৌসুমে প্রয়োজন হয় প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টন। এবার বোরো উৎপাদন বাড়াতে সরকার চাহিদার অনেক বেশি ডিজেল মজুদ রেখেছেন বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে। ফসলের মাঠে হাসি দেখতে শুরুটাই হতে হয় ভাল। আর তাই চারা বুননে মানসম্মত চারা ও ভালভাবে জমি তৈরি করতে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন কৃষকরা। ’১৭ সালে আগাম বন্যায় লোকসান গুনেছিল কৃষকরা। পরের বছর সেই লোকসান অনেকটাই কেটে যায়। বাম্পার ফলন হয় বোরোতে। এবারও ভাল ফলন হবে আশা কৃষকের। মাজিদুল ইসলাম ত্রিশালের চাষী। ধান ক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, এই জমিই আমাদের সব। ধান না হলে খাব কি বলেন? ভাল ফলন পেতে ভাল যত্নও দরকার। পাশের আরেক চাষীও বলেন, সাধ্যমতো চেষ্টা করছি ফলনটা ভাল হলেই হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জ জয়পুরহাট অঞ্চলে আলু, সরিষা উঠানোর পর বোরোর আবাদ করা হয় বলে এই জেলায় বোরো আবাদে একটু দেরি হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বোরো উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মানসম্মত বীজ ও সার কৃষকের দৌরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এবছর বোরোয় বাম্পার ফলনের আশার কথাও শুনিয়েছেন। জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন বোরো আবাদে কৃষকদের নানা পরামর্শ সহায়তা দেয়ার কথা। কৃষি কর্মকর্তাদের যেখানে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চেষ্টা সেখানে কৃষক স্বপ্ন দেখেন ভাল ফলন ঘরে উঠানোর। তবে সবাই চায় ভাল ফলনের মধ্য দিয়ে কৃষক সমৃদ্ধ হোক, সমৃদ্ধ হোক দেশও।
×