ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাজ শেষ না হতেই বিল উত্তোলন

বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়ামের কাজে নয়-ছয়

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯

বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়ামের কাজে নয়-ছয়

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ফসল বরিশাল ‘বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম।’ শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে যার নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি। এমনকি গত বছরের আট ফেব্রুয়ারি নির্মাণাধীন পাঁচ শ’ আসন বিশিষ্ট পঞ্চমতলা ভবনের এ অডিটরিয়ামটির উদ্বোধনও করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ পেরিয়ে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও এখনও সম্পন্ন হয়নি বহুল প্রতীক্ষিত এই অডিটরিয়ামের নির্মাণ কাজ। বরং কাগজে কলমে কাজ সমাপ্ত দেখিয়ে বরাদ্দের ২৫ কোটি টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ও বিশেষ বরাদ্দে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ খোদ বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আহসান হাবিব কামালের বিরুদ্ধে। দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন সাবেক মেয়রের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ঠিকাদারসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নাম। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম নিয়ে পুকুর সমান দুর্নীতির বিষয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনে একাধিকবার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু দিন পেরিয়ে সপ্তাহ ও মাস পেরিয়ে বছর গেলেও অভিযোগ তদন্ত বা ব্যবস্থা গ্রহণে অগ্রগতি আসেনি দুদকের। তবে বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম নিয়ে দুর্নীতি এবং অভিযোগ তদন্তের পাশাপাশি দ্রুত কাজ সম্পন্নের আশ্বাস দিয়েছেন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নতুন মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। বরিশাল সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও সুশীল সমাজের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আদেশে ১০তলা ভিতে পাঁচ শ’ আসন বিশিষ্ট পাঁচতলা অডিটরিয়াম প্রকল্প গ্রহণ করে সিটি কর্পোরেশন। এই প্রকল্পের নাম দেয়া হয় ‘বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম’। সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ও সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের ঠিকাদারী পায় মেসার্স কহিনুর এন্টারপ্রাইজ ও মোমেন সিকদার (জেভি) নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ১৭ কোটি ২৭ লাখ ৩১ হাজার ৫৫০ টাকা চুক্তিতে ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি শুরু হওয়া অডিটরিয়াম নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারির মধ্যে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে নির্মাণাধীন ভবনটির কাজ এখনও শেষ হয়নি। বরং কাজ শুরুর বছর খানেকের মাথায় ঠিকাদার নিজেদের মতো করে মিলন মন্ডল নামের একজন ডিজাইনারকে দিয়ে অডিটরিয়ামের নক্সা পরিবর্তন করিয়ে কাজের সময় ২০১৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত বাড়িয়ে নেয়। সেই সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ২৫ কোটি টাকা করা হয় কিন্তু বর্ধিত সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ করেনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়ামের ঠিকাদার মোমেন সিকদার বিসিসির সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। সেই সুবাধে কাজের শুরুতেই অনিয়ম এবং দুর্নীতিতে মেতে ওঠেন। এর প্রতিবাদ করায় বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম প্রকল্পের প্রথম প্রজেক্ট ডায়রেক্টর (পিডি) নির্বাহী প্রকৌশলী আনিছুজ্জামানকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পরিবর্তে বিসিসির সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোতালেব হোসেন এবং পরবর্তীতে প্রধান প্রকৌশলী খান মোঃ নুরুল ইসলামকে পিডির দায়িত্ব দেয়া হয়। সূত্রটি আরও জানায়, প্রকল্পের ঠিকাদার মোমেন সিকদার যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা। তাছাড়া সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন ঠিকাদার মোমেন সিকদার। যে কারণে কাজ সম্পন্ন না হলেও কাগজে কলমে বিলের বৈধতা দেখিয়ে ২৫ কোটি টাকাই উত্তোলন করে নিয়ে ঠিকাদার। সিটি কর্পোরেশন সূত্রে আরও জানা গেছে, সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ মেয়রের দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম পরিদর্শন করেছেন। তিনি ওই প্রজেক্টের ফাইল নিজ কাস্টরিতে নিয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়ামের অসম্পন্ন কাজ খুব দ্রুত শেষ করার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। সেই সঙ্গে দুর্নীতির বিষয়টিও তদন্তের উদ্যোগ নেবেন বলেও জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়ামের নির্মাণ কাজ তদারকি কমিটির সদস্য সচিব ও বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি কাজল ঘোষ বলেন, আমরা তৎকালীন মেয়র আহসান হাবিব কামালের কাছে কয়েকবার গিয়েছি এবং অডিটরিয়ামের বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছি। তার পরেও কোন কাজ হয়নি। পরে বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে নিয়ে নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শন করেছি। তিনি আশ্বস্ত করেছেন যত দ্রুত সম্ভব ভবনের কাজ শেষ করা হবে। অডিটরিয়ামের কাজ শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সাংস্কৃতিক সংগঠন খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটারের সভাপতি নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, বরিশালে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ভাল কোন অডিটরিয়াম নেই। বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম বরিশালের সাংস্কৃতিক কর্মীদের স্বপ্ন দেখিয়েছে। অথচ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দের এ প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে এমন উদাসীনতা দুঃখজনক। বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ও বঙ্গবন্ধু অডিটোরিয়াম প্রকল্পের পিডি খান মোঃ নুরুল ইসলাম বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে অডিটরিয়ামের নক্সায় কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে কিন্তু বরাদ্দ না থাকায় কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না। যতটুকু বরাদ্দ হয়েছে সেই পরিমাণ কাজ হয়েছে বলেই ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করেছি। এ কাজে কোন অনিয়ম হয়নি বলেও দাবি করেছেন এ কর্মকর্তা। সদ্য বদলি হওয়া দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত বরিশাল জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক এবিএম আব্দুস সবুর বলেন, বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম নিয়ে আমরা অনেক অভিযোগ পেয়েছি কিন্তু অনেক বিষয় হওয়ায় এখনও তদন্ত শুরু করা সম্ভব হয়নি। যদি একটি বিষয় হতো তাহলে অনেক আগেই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া যেত। তিনি আরও বলেন, এটা শুধুমাত্র ঠিকাদারের বিষয় নয়। এর সঙ্গে অনেকেই জড়িত রয়েছে। যারা সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে যুক্ত। অবশ্য তদন্ত শুরু না হলেও এরই মধ্যে আমি অনেক তথ্য প্রমাণ এবং কাগজপত্র সংগ্রহ করেছি। তবে বদলি জনিত কারণে ফাইলটি চূড়ান্ত করতে পারলাম না। তবে নতুন যিনি আসছেন তাকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলবেন বলেও জানিয়েছেন দুদকের এই কর্মকর্তা।
×