ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিষয় আবারও কোচিং

প্রকাশিত: ০৮:৪১, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯

বিষয় আবারও কোচিং

বছর কয়েক আগে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কোচিং বন্ধের জন্য তোড়জোড় করেছিলেন। কিন্তু সে উদ্যোগ সফল হয়নি। এবার নতুন শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনিও চেষ্টা করছেন। কতটা সফল হবেন বলা মুশকিল । কেননা শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য যেখানে নম্বর তোলা সেখানে কোচিং বন্ধের অভিযান সফল হওয়ার কথা নয়, তা হয়ওনি। পরীক্ষায় উচ্চ নম্বর পেতে হবে কিন্তু ক্লাসে সে নিশ্চয়তা নেই। কোচিং বন্ধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় ক্লাসে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেয়া। সে জন্য প্রয়োজন যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষকদের জন্য যে বেতন স্কেল নির্ধারণ করা আছে তা মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করে না। যারা আসছেন তারা বেতনের ওপর নির্ভর করে চলতে পারেন না। এই বাস্তবতাও কোচিংয়ের পক্ষে যায়। কিন্তু যেভাবে এর বিস্তার অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাড়ছে তাতে শুধু অভিভাবকরা বিপর্যস্ত হচ্ছেন না, শিক্ষার ভিতও অন্তঃসারশূন্য হচ্ছে। নম্বরভিত্তিক প্রতিযোগিতার ফলে কোচিং সেন্টার নির্দিষ্ট ছকে ফেলে শিক্ষার্থীকে পর্যাপ্ত নম্বর পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে কিন্তু মেধা ও সৃজনশীলতার পুরো বিষয়ই উপেক্ষিত থাকছে। তারা শিক্ষক পাচ্ছে না ভাল ফল করার গাইড পাচ্ছে। যারা কিছু কৌশল রপ্ত করাচ্ছেন যা দিয়ে শিক্ষার্থী শিক্ষা বৈতরণী পার হয়ে আসছে। কিন্তু একজন সঠিক মানুষ হওয়ার কলাকৌশল সে কতটা রপ্ত করল তা যাচাইয়ের সুযোগ কমতে কমতে প্রায় শূন্যে ঠেকেছে। এত বেশি প্রতিযোগিতা এত বেশি পরীক্ষা একেবারে জীবনের শুরু থেকে এর প্রয়োজন কতটা আছে তাও প্রশ্নহীন নয়। এই যে প্রতিবছর পাসের এত ছড়াছড়ি, এত জিপিএ ফাইভ, শেষ পর্যন্ত এর গন্তব্য কোথায় কে জানে। প্রতিযোগিতাকে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ায় বছর বছর একগুচ্ছ কচিমুখে তথাকথিত সাফল্যের হাসি দেখছি আমরা। কিন্তু শিক্ষার এ মান শেষ পর্যন্ত তাদের একটি হাস্যোজ্জ্বল ভবিষ্যত দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। এদের জীবন শুরুই হচ্ছে কোচিংসহ শিক্ষার নানা ধরনের ফাঁদে পা দিয়ে। দুই হাজার এগারোয় সরকারী ও বেসরকারী এমপিওভুক্ত স্কুল শিক্ষকদের ক্লাসের বাইরে কোচিংয়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট রুল জারি করেছিল। এ বিষয়ে সরকারকে প্রজ্ঞাপন জারির নির্দেশ কেন দেয়া হবে না জানতে চেয়েছিল। চার সপ্তাহের মধ্যে সরকারের পক্ষে শিক্ষা সচিবসহ কয়েকজন সচিব এবং শিক্ষকদের পক্ষে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের চেয়ারম্যান এবং ঢাকার প্রথম সারির কয়েকটি স্কুল কর্তৃপক্ষসহ বিশজনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল। অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতির রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে এ রুল জারি হয়েছিল। হাইকোর্টের আদেশকে স্বাগত জানিয়েছিলেন সে সময়ের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। বলেছিলেন, আমরাও এর পক্ষে। আমরা চাই দেশ থেকে কোচিং ব্যবস্থা উঠিয়ে দিতে। নির্ধারিত সময়ে রুলের জবাব দিতে অক্ষমতা জানিয়ে আদালত থেকে সময় নিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। রুলে যাদের জবাব দিতে বলা হয়েছে তাদের নিয়ে বৈঠক করে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সরকার কোচিং বাণিজ্যে জড়িত শিক্ষকদের তালিকা করছে। যে শিক্ষকরা ক্লাসের বাইরে কোচিং করাচ্ছেন তাদের তালিকা করে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা হবে। কোচিং বন্ধে সরকার শুরু থেকেই কঠোর অবস্থানে রয়েছে। দ্রুত এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয় বলে দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ক্লাসরুমে পূর্ণ শিক্ষা পেলে শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ে যাবে না। আর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান কোচিংয়ের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে সরকারী স্কুল-কলেজের যে শিক্ষকরা কোচিংয়ে জড়িত তাদের বদলি করতে বলেছিলেন। আর বেসরকারী বিদ্যালয়ের কোচিংয়ে যুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে কী করা যায়, সে বিষয়ে গঠিত কমিটি সুপারিশমালা তৈরি করবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর বিধি অনুযায়ী কোন সরকারী কর্মচারী সরকারের অনুমতি ছাড়া অন্য কোন ব্যবসায় জড়িত হতে পারবেন না। কোন সরকারী কর্মচারী-এর ব্যত্যয় ঘটালে আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবেন। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর থেকেও বেসরকারী শিক্ষকদের কোচিং বন্ধে আইন করার প্রস্তাব করেছিল। শিক্ষকদের যুগোপযোগী বেতন স্কেল ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিতের পাশাপাশি কোচিংয়ের জন্য অভিভাবকদের নিরুৎসাহিত করার কথা বলেছে। কোচিং নির্ভরশীলতা কমিয়ে ক্লাসেই প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কমপক্ষে ১ : ৩০ করাসহ স্কুলে পরীক্ষায় ফল খারাপ হলে শ্রেণীশিক্ষককে জবাবদিহির আওতায় আনার কথাও বলেছে। সব ভাল কথাই বলা হয়েছিল। কিন্তু অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। কোচিং ছিল এবং কোচিং আছে। আসলে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করা অন্যতম জরুরী। একজন ভাল শিক্ষকের প্রভাব যেমন আজীবন রয়ে যায়, খারাপ শিক্ষকের নেতিবাচক প্রভাবও তেমনি। অযোগ্য শিক্ষক যে ক্ষতি করে তার মাসুল দিতে গোটা জীবনই চলে যায়। নতুন শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টি কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনবেন সময়ই তা বলে দেবে।
×