ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পলাতক দণ্ডিত পুলিশের সাবেক দুই ডিসির আত্মসমর্পণ

প্রকাশিত: ১১:০৫, ২৯ জানুয়ারি ২০১৯

পলাতক দণ্ডিত পুলিশের সাবেক দুই ডিসির আত্মসমর্পণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বহুল আলোচিত বর্বরোচিত ভয়াবহ একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় পলাতক দণ্ডিত পুলিশের সাবেক দুই ডিসিকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। সোমবার ঢাকার ১নং অস্থায়ী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নুর উদ্দিনের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। আদালত জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান ও সাইদ হাসানকে (দক্ষিণ) কারাগারে পাঠানোর এ আদেশ দেন। গত বছরের ১০ অক্টোবর মামলাটির রায়ে এ দুই আসামি পলাতক অবস্থায় দ-বিধির ২১২ ধারায় মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অভিযুক্ত আসামিদের প্রশ্রয় দেয়া এবং ২১৭ ধারায় অপরাধীদের শাস্তি থেকে বাঁচানোর চেষ্টার অভিযোগে ও ২০১ ধারায় অপরাধীকে বাঁচানোর জন্য সাক্ষ্য-প্রমাণ অদৃশ্য করার অভিযোগে প্রত্যেক ধারায় ২ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করে ট্রাইব্যুনাল। কারাদ-ের পাশাপাশি তাদের প্রত্যেক ধারায় ৫০ হাজার টাকা করে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং জরিমানা অনাদায়ে প্রত্যেক ধারায় ৬ মাস করে কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। রায়ে প্রত্যেক ধারার সাজা একযোগে চলবে বলে উল্লেখ করা হয়। মামলা দুটির রায়ে অন্য আসামিদের মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ আসামির মৃত্যুদ- এবং লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। অবশিষ্ট ১১ আসামির বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। আদালত ১৯ আসামিকে মৃত্যুদ- দিয়েছে। তারা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি-জামায়াত জোটের সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাইজউদ্দিন, হুজির সাবেক আমির মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, কাশ্মীরী জঙ্গী আব্দুল মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জিএম, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে অভি, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাঃ জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন ওরফে আবু জান্দাল, মোঃ রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে শামিম ওরফে রাশেদ, মোঃ উজ্জল, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক হানিফ। এই আসামিদের দণ্ডবিধি ৩০২, ১২০ খ, ৩৪ ধারায় হত্যার দায়ে মৃত্যুদ-ের পাশাপাশি এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। দণ্ডবিধির ৩০৭ ধারায় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গুরুতর জখম করার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদ- দেয়া হয়েছে। বিস্ফোরক আইনের ৩ ও ৬ ধারায় হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বিস্ফোরক আইনের ৪ ও ৬ ধারায় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গুরুতর জখম করার দায়ে ২০ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এই ১৯ আসামির ক্ষেত্রে কেবল মৃত্যুদ-ের শাস্তিই কার্যকর হবে। মৃত্যু পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের দণ্ড কার্যকর করতে বলা হয়েছে রায়ে। এ মামলায় ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। যাদের যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছে তারা হলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান (পলাতক), খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী (পলাতক), বিএনপি নেতা ও সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ (পলাতক), হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে আবু হোমাইরা ওরফে পীর সাহেব, মাওলানা সাব্বির আহমেদ আহম্মেদ ওরফে আব্দুল হান্নান সাব্বির, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আব্দুর রাজ্জাক, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম মাওলাদার, মোঃ আরিফুল ইসলাম আরিফ, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন (পলাতক), আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন (পলাতক), মোঃ খলিল (পলাতক), জাহাঙ্গীর আলম বদর (পলাতক), মোঃ ইকবাল, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন (পলাতক), মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই (পলাতক), রাতুল আহমেদ ওরফে রাতুল বাবু (পলাতক)। তাদেরকে দ-বিধি ৩০২, ১২০ খ, ৩৪ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদ-, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদ- দেয়া হয়েছে। দ-বিধি ৩০৭, ১২০ খ, ৩৪ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদ-, ৫০ হাজার টাকা জনিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদ- দেয়া হয়েছে। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ৩ ও ৬ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদ-, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদ- দেয়া হয়েছে। বিস্ফোরক আইনের ৪ ও ৬ ধারায় ২০ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। সব সাজা একযোগে কার্যকর হবে বলে এই ১৯ আসামির ক্ষেত্রে কেবল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কার্যকর হবে। এছাড়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোঃ আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হক, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার (পলাতক), মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন (পলাতক), ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান (পলাতক), আরেক সাবেক উপকমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান (পলাতক), সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার মোঃ রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর করে কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। আরেকটি ধারায় খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। ১৪ টি বিবেচ্য বিষয় নির্ধারণ করে তা পর্যালোচনা, সাক্ষ্য-তথ্য প্রমাণের আলোকে এ মামলার রায় ও আদেশ দেয়া হয়েছে বলে আদালতের রায়ে বলা হয়। জেলে প্রেরণ ॥ কোর্ট রিপোর্টার জানান, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত পুলিশের সাবেক দুই উপ-কমিশনার (ডিসি) ওবায়দুর রহমান ও খান সাঈদ হাসান আত্মসমর্পণ করার পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গতকাল সোমবার ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহদ নূর উদ্দিন জামিন আবেদন নাকচ করে আসামিদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এই দুই উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা গতকাল আইনজীবীর মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করেন এবং জামিন চান। রাষ্ট্রপক্ষে মামলার প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান জামিনের বিরোধিতা করে আদালতকে বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় করা দুই মামলায় অধিকতর তদন্তে খান সাঈদ হাসান ও ওবায়দুর রহমানের নাম বেরিয়ে আসে। তারা মামলার তদন্তে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছেন, ঘটনা ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। গ্রেনেড হামলার ঘটনাস্থল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তারা দুজন নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা নেননি। অভিযোগপত্র দাখিলের পরও তারা বিচারের মুখোমুখি না হয়ে পলাতক থেকেছেন। এই রকম আসামিদের জামিন দেয়া যায় না। শুনানি শেষে আদালত দুজনের জামিনের আবেদন নাকচ করে তাদের কারাগারে পাঠান। খান সাঈদ হাসান পুলিশের ডিসি (উপকমিশনার) দক্ষিণ এবং ওবায়দুর রহমান ডিসি পূর্ব ছিলেন। পুলিশের এই দুই কর্মকর্তাকে অপরাধীকে আশ্রয় দেয়ার জন্য দুই বছর ও অপরাধীকে রক্ষার ব্যবস্থা করায় দুই বছরের কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। এই দুজনকে মামলার আলামত নষ্ট করার দায়ে আরও দুই বছরের সশ্রম কারাদ- দেয়া হয়। প্রত্যেক সাজা এক সঙ্গে চলবে বলে রায়ে বলা হয়। এ কারণে এই দুজনকেই দুই বছর করে কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ গুরুত্বপূর্ণ দলীয় নেতাদের হত্যার লক্ষ্যে চালানো গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করা হয় গত বছর ১০ অক্টোবর। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী ও সাবেক বিএনপি সাংসদ কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।
×