ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আইসিডিডিআরবির গবেষণা রিপোর্টে তথ্য

সত্তর ভাগ নগরবাসী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেন ফার্মেসি থেকে

প্রকাশিত: ১০:৫০, ২৯ জানুয়ারি ২০১৯

সত্তর ভাগ নগরবাসী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেন ফার্মেসি থেকে

নিখিল মানখিন ॥ মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকায় নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ছাড়াও নগর স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে পরোক্ষভাবে শিল্প, বাণিজ্য ও পরিবেশসহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। সত্তর শতাংশ নগরবাসী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন ফার্মেসি থেকে। বাসার আশপাশের ফার্মেসি থেকে তারা এই সেবা নিয়ে থাকেন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন স্তরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র গড়ে উঠলেও বিভাগীয় পর্যায়ে তা নেই। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। আইসিডিডিআরবির সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচীর অংশ হিসেবে একটি প্রতিনিধি দল টঙ্গী এলাকায় গবেষণা চালায়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭০ শতাংশ মানুষ ফার্মেসি থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন। চিকিৎসকদের চেম্বার থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন মাত্র ১০ শতাংশ, সরকারী হাসপাতাল থেকে ৭ শতাংশ, বেসরকারী হাসপাতাল বা ক্লিনিক থেকে ৫ শতাংশ, এনজিও ক্লিনিক থেকে ১ শতাংশ এবং অন্যান্য থেকে ৭ শতাংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন। মা ও শিশুদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার মতো কিছু ব্যবস্থা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের থাকলেও অন্যদের নেই। এজন্য শুধু টঙ্গীই নয়, ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার ভরসা হচ্ছে নিকটস্থ ফার্মেসিগুলো। আর ফার্মেসিগুলো অদক্ষ লোকজন দিয়ে পরিচালিত হওয়ায় ভুল ওষুধ সেবনের মাত্রা বেশি। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিও অনেক। আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ড. এলেন এ্যাডামস এক গবেষণায় বলেছেন, নগরবাসীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই। তবে টারসিয়ারি পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া টিকাদান কর্মসূচী, মাতৃ-নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় স্থানীয় সরকার কিছুটা কাজ করছে। সরকারী স্বাস্থ্যসেবা কম থাকায় শহরে বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আধিপত্য বিস্তার করছে। স্বাস্থ্যসেবার ৮০ শতাংশই হচ্ছে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে বলে জানান এলেন এ্যাডামস। তাঁর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীর স্বাস্থ্যসেবার মাত্র ১ শতাংশ সেবা সরকারী খাত থেকে আসে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার ১ শতাংশ সরকার করে থাকে। ৫ শতাংশের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে বিভিন্ন বেসরকারী সংগঠন (এনজিও) আর বাকি ৯৪ শতাংশ সেবা দেয় বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। গবেষণায় ঢাকার দুই সিটির স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি মানচিত্রও তৈরি করা হয়। ঢাকার দুই সিটি এবং রাজশাহী, নারায়ণগঞ্জ ও সিলেটে কোথায় কোন স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া যাবে, তা চিহ্নিত করা হয়েছে এই ম্যাপে। ৮০ কর্মী ১৩ মাসের গবেষণায় এ ফল উঠে এসেছে। গবেষণায় স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে ১৬৬ হাসপাতাল, ৫৭৭ ক্লিনিক, ২৭৪ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ১৭৭৯ চিকিৎসকের চেম্বার, ৩৪৫৮ ফার্মেসির সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকের চেম্বার, ২০৮ চশমার দোকানের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকের চেম্বার, ১০২ ডেলিভারি সেন্টার, ১২ ব্লাড ব্যাংক, ৫১৮৩ ফার্মেসি, ২৯১ অপটিকাল সেন্টার, ৪০ ড্রপ ইন সেন্টার এবং ১০৬ ট্রাডিশনাল স্পিরিচুয়াল প্র্যাকটিশনারকে দেখানো হয়েছে। এর বাইরে ৫৩০ স্যাটেলাইট ক্লিনিক এবং ৮৩ ইপিআই সেন্টারের কথাও গবেষণায় বলা হয়েছে। ঢাকা উত্তরে ২১৬৪ চেম্বারের চিকিৎসকের এমবিবিএস, বিএইচএমএস, বিইউএমএস বা বিএএমএসর মতো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী রয়েছে। বাকি ১০০৪ চিকিৎসকের প্রাতিষ্ঠানিক কোন ডিগ্রী নেই। ঢাকা দক্ষিণে ১৫১৪ চেম্বারের চিকিৎসকের প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী রয়েছে। বাকি ৭৫৩ চেম্বারের চিকিৎসকের তা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত নগরায়ন হলেও স্বাস্থ্যসেবায় পিছিয়ে রয়েছে নগরবাসী। এর অন্যতম কারণ নগরবাসীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু ওই মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও লোকবল নেই। ফলে বেসরকারী সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে তারা মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে নগরের স্বাস্থ্যসেবায় আধিপত্য বিস্তার করছে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। নগরে একে একে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, যা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে সেবা দিচ্ছে। এতে মানুষের স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণ অবকাঠামো অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগব্যাধি ও রোগীর খোঁজ খবর নিচ্ছে। কিন্তু শহরাঞ্চলে সেটি কিছু এনজিওর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য। শহরে মা ও শিশুদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান থাকলেও অধিকাংশই এই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মানুষ বাধ্য হয়ে ফার্মেসি বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল হেলথ বুলেটিনের তথ্য অনুযায়ী, গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবায় কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন ও পরিবার কল্যাণ সেন্টার, উপজেলা ও জেলা হাসপাতাল ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু শহরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে চলছে। মন্ত্রণালয়ের অধীনে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সীমিত আরবান ডিসপেনসারি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি হাসপাতাল, দাতাসংস্থার সহায়তা প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ডেলিভারি প্রজেক্ট, আরবান হেলথ কেয়ার শক্তিশালীকরণ প্রকল্প ও এনজিও হেলথ সার্ভিস ডেলিভারি প্রোগ্রাম ও অন্যান্য প্রাইভেট সেক্টরের মাধ্যমে সেবা দেয়া হচ্ছে। নগরবাসীর স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম হচ্ছে, অস্পষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা, পরিকল্পনা ও সমন্বয়ে অদক্ষতা, অকার্যকর আরবান হেলথ কেয়ার গাইডলাইন, স্থানীয় সরকারের রাজস্বে গাফিলতি ও পরিকল্পনা অনুযায়ী তা বাস্তবায়নের দুর্বলতাকে চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়গুলো সমন্বয়হীন ॥ সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া নগরবাসীর প্রাথমিক স্বাস্থসেবার সমস্যাসমূহ দূর করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে বিদ্যমান সমস্যা দূর করার চেষ্টা করা দরকার। অপরিকল্পিত নগরায়নের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে স্বাস্থ্যসেবার ওপর। অধিক জনসংখ্যার কারণে বিঘিœত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। নগর স্বাস্থ্যসেবায় একাধিক মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। নগর স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন সিটি কর্পোরেশনগুলো এটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। প্রতিটি সিটি কর্পোরেশনেই নগর স্বাস্থ্যসেবা দেখাশুনার একটি বিভাগ থাকে। নগরবাসীর স্বাস্থ্যসেবার পাওয়ার বিষয়টি সিটি কর্পোরেশনের কর্মকা-ের ওপরই নির্ভর করে। ইচ্ছে করলেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ছাড়াও নগর স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে পরোক্ষভাবে শিল্প, বাণিজ্য ও পরিবেশসহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। নগর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ঘটাতে হলে এসব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় থাকতে হবে।
×