ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উর্ধমুখী হচ্ছে লন্ডন

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ২৯ জানুয়ারি ২০১৯

উর্ধমুখী হচ্ছে লন্ডন

বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগরী লন্ডন। এটি আর্থিক লেনদেনের শীর্ষ কেন্দ্র বিধায় একে বিশ্বের বাণিজ্যিক রাজধানীও বলা চলে। বিশ্বের দ্রুততম বিকাশমান অর্থনীতির অন্যতম লন্ডনের অর্থনীতি। সবাই লন্ডনে যেতে চায় বিভিন্ন কারণে। তাই লন্ডন বড় হচ্ছে, প্রসারিত হচ্ছে। তবে আনুভূমিকভাবে নয়, উর্ধমুখে। বহুতল ভবন নির্মাণ ও জনসংখ্যা দুদিক দিয়েই লন্ডনের এই উর্ধমুখী প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে লন্ডনের ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা হচ্ছে, আবার ভবিষ্যতের প্রয়োজন মেটানোর দিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি ও লোকসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে লন্ডনে ভবন নির্মাণে জোয়ার এসেছে। এর মধ্যে আছে বেশকিছু পুনর্নির্মাণ প্রকল্প যা ইউরোপের বৃহত্তম। টেমস নদীর তলদেশ দিয়ে তৈরি হতে যাচ্ছে সুপার সুয়্যার। গগনচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণে দীর্ঘদিন অনীহা দেখিয়ে এসেছিল যে লন্ডন নগরী, সেখানে এখন নির্মিত হচ্ছে ৫শ’র বেশি সুউচ্চ ভবন, যেগুলো ২০টি বা তারও বেশি তলার। এর মধ্যে ৭০টি স্ক্রাইক্র্যাপার। লন্ডনে এ পর্যন্ত নির্মিত উচ্চতম ভবনগুলোর মধ্যে রয়েছে দি শার্ড (৩১০ মিটার), ওয়ান কানাডা স্কোয়ার (২৩৫ মিটার), হেরন টাওয়ার (২৩৪ মিটার), ১২২ লিডেন হল স্ট্রিট (২২৫ মি), ৮ কানাডা স্কোয়ার (২০০ মি), ২৫ কানাডা স্কোয়ার (২০০ মি), দি স্কালপেল (১৯০ মি), টাওয়ার ৪২ (১৮৩ মি), সেন্ট জর্জ হোয়ার্ফ টাওয়ার (১৮১ মি), ৩০ সেন্ট মেরি এক্স (১৮০ মি)। এগুলোর সঙ্গে যোগ হতে যাচ্ছে নতুন সুউচ্চ ভবনগুলো। ফলে লন্ডনের দিগন্ত রেখা যাবে পাল্টে। বিশ্বের প্রথম পাতাল রেল সম্প্রসারিত হবে। আগামী বছর এর এলিজাবেথ লাইন চালু হবে। ফলে পশ্চিম লন্ডনের সঙ্গে বর্ধিষ্ণু পূর্ব লন্ডনের যোগাযোগ উন্নততর হবে। এর নতুন ১০টি স্টেশনসহ মোট ৪১টি স্টেশন থাকবে এবং যোগাযোগের সময় প্রায় অর্ধেক কমে আসবে। লন্ডনে যে ৫১০টি সুউচ্চ ভবন নির্মিত হতে যাচ্ছে, তার মধে ১১৫টি এখন নির্মাণাধীন। ২৫২টি ভবন নির্মিত হবে পূর্ব লন্ডনে। ভবনগুলোর ঘনতম গুচ্ছ হবে লন্ডনের কেন্দ্রস্থল। সেখানে গড়ে উঠবে ৯৯টি ভবন। মোট ভবনের অল্প কয়েকটি কেবল হবে আকাশছোঁয়া। বাকি বেশিরভাগ ভবন হবে ২০ থেকে ৩০ তলার মধ্যে। গত শরতে গুগল লন্ডনে ১১ তলা ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। ‘ল্যান্ড স্ক্র্যাপার’ এই ভবনটি হবে লন্ডনের উচ্চতম ভবন ‘শার্ড’-এর চেয়ে আনুভূমিকভাবে লম্বা। এতে ৭ হাজার কর্মচারীর স্থান সঙ্কুলান করা যাবে। ফেসবুকও পাশের স্থানটিতে সরে আসার পরিকল্পনা নিয়েছে, যেখানে ৬ হাজার কর্মচারীকে স্থান দেয়ার মতো সম্প্রসারিত জায়গা থাকবে। ২০১০ সাল থেকে লন্ডনের উচ্চতম ভবন হিসেবে রয়ে গেছে শার্ড। এটি হচ্ছে ৮৭ তলা। দ্বিতীয় উচ্চতম ওয়ান কানাডা স্কোয়ার। ৫০ তলার এই ভবনটি ১৯৯১ সালে নির্মিত। এরপর স্থান হেরন টাওয়ারের। নির্মিত ২০১১ সালে, তলা ৪৬। তা ছাড়া ৪০ থেকে ৪৯ তলা পর্যন্ত ভবন ও টাওয়ার আছে ২৬টি, ৩০ থেকে ৩৯ তলা পর্যন্ত ভবন ও টাওয়ার আছে ২৯টি, ২০ থেকে ২৯ তলা পর্যন্ত ভবনের সংখ্যা ১১টি। ১৭১০ সালে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়া ২৬৪ ফুট উঁচু সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল দু’শ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে ছিল লন্ডন নগরীর সবচেয়ে উঁচু ইমারত। লন্ডনের জনসংখ্যাও বেড়েছে। নগরীর লোকসংখ্যা এখন ৮৮ লাখ। ২০৫০ সাল নাগাদ এর সঙ্গে আরও ২০ লাখ লোক যোগ হবে। ঊনবিংশ শতকে শিল্প যুগের অধিকাংশ সময়জুড়ে লন্ডন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নগরী। সেই জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯৩৯ সালে ৮৬ লাখে পৌঁছেছিল। যুদ্ধের সময় লন্ডন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ৭১ হাজারেরও বেশি ভবন ধ্বংস হয়। লোকজন লন্ডন ছেড়ে পালিয়ে যায়। যারা পালাতে পারেনি, জার্মান বোমাবর্ষণে তাদের ৪৩ হাজার প্রাণ হারায়। পালিয়ে যাওয়া লোকেরা শহরতলিগুলোতে গিয়ে নতুন করে বসতি স্থাপন করে। আর এভাবেই গড়ে ওঠে গার্ডেন সিটি। যারা এভাবে বসতি করেছিল তারা আর লন্ডন শহরে ফেরেনি। ফলে নগরীর লোকসংখ্যা কমই থেকে গিয়েছিল। পরবর্তী অধ্যায়ে আরও উত্থান-পতন হয়। ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প ছত্রখান হয়ে পড়ে। লন্ডনের ডকগুলো ছিল বিশ্বের বৃহত্তম জাহাজ ভেড়ার স্থান। সেগুলো জাহাজ নির্মাণ শিল্পের আধুনিকায়নের শিকার হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৫ সালে কিংবদন্তিতুল্য প্রধানমন্ত্রী উইনস্টোন চার্চিলের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই ধারণারও অপমৃত্যু ঘটে যে লন্ডন হবে বিশ্বের রাজধানী। লন্ডনের জনসংখ্যা কমে আসার ধারা অব্যাহত থাকে। ১৯৩৯ সালে জনসংখ্যা যেখানে শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে ৮৬ লাখে দাঁড়িয়েছিল, তা কমতে কমতে ১৯৮৮ সালে ৬৭ লাখে নেমে আসে। কিন্তু এর দু’বছর আগে আর্থিক সার্ভিস শিল্পের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার এবং এর পাশাপাশি প্রচলিত ট্রেডিংয়ের স্থলে ইলেকট্রনিক ট্রেডিং চালু হওয়ার ফলে লন্ডনের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে যায়। লন্ডন হয়ে ওঠে টোকিও ও নিউইয়র্কের প্রতিদ্বন্দ্বী। ওয়েস্ট ইন্ডিয়া ডকগুলোর ধ্বংসাবশেষের ওপর এক নতুন ফিন্যান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্ট গড়ে ওঠে। ক্যানারি ওর্ফ নামের এই ডিস্ট্রিক্টটি লন্ডনের বড় আকারের প্রথম আধুনিক পুনর্নির্মাণ প্রকল্প এলাকা হয়ে দাঁড়ায়। অভিবাসী ও বিদেশী বিনিয়োগের প্রবাহ আসতে থাকে। পরবর্তী ৩০ বছরে লন্ডনের প্রবৃদ্ধি এক মস্ত কাহিনী হয়ে দাঁড়ায়। আজ ক্যানারি ওর্ফে ১ লাখেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। লন্ডন আজ বিশ্বের সব প্রান্তের তরুণ, সম্ভাবনাময় পেশাদারদের আকর্ষণ কেন্দ্র, যারা এই নগরীর চেহারা বদলে দিয়েছে। লন্ডনের অধিবাসীদের প্রায় ৪০ শতাংশ যুক্তরাজ্যের বাইরে জন্ম নেয়া। লন্ডনের রাস্তায় ৩শ’ ভাষায় কথা বলা হয়। লন্ডনে প্রায় ৩ লাখ ভারতীয়, ১ লাখেরও বেশি পাকিস্তানী ও ১ লাখেরও বেশি বাংলাদেশীর বস। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্প্রসারণ ঘটায় ইউরোপ থেকে লাখ লাখ লোকের আগমন ঘটেছে। সরকারী হিসেবে যদিও ৮২ হাজার ফরাসী এই নগরীতে বাস করে, তবে তাদের প্রকৃত সংখ্যা আড়াই লাখেরও বেশি হবে। নগরীতে ইতালিয়ান সম্প্রদায় সংখ্যার দিক দিয়ে আরও বড়। জনসংখ্যা এভাবে বাড়তে বাড়তে ২০১৫ সালের প্রথম দিকে ১৯৩৯ সালের শীর্ষবিন্দুকে ছাড়িয়ে যায়। ওই বছর নগরীর লোকসংখ্যা ছিল ৮৬ লাখ ১৫ হাজারেরও বেশি। বাড়তি জনসংখ্যার প্রয়োজন ও অন্যান্য অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে লন্ডন উর্ধমুখে প্রসারিত হতে থাকে। তার পরেও লন্ডন এখনও পর্যন্ত বহুলাংশেই এক অনুচ্চ ভবনের নগরী। এই নগরীর জনসংখ্যা ও ইমারত ঘনত্ব ইউরোপের সর্বনি¤œগুলোর একটি। নগরীতে ১৮৮০-এর দশকে স্কাইস্ক্র্যাপার নির্মাণ শুরু হলে লন্ডনবাসীরা কখনই বিহ্বল হয়নি। তারা স্কাইস্ক্র্যাপার শব্দটিও ব্যবহার করে না। তার বদলে তারা উঁচু ভবন শব্দদ্বয় ব্যবহারে অভ্যস্ত, যার মানে হলো কমপক্ষে ২০ তলার ভবন। দেশের বাকি অংশের বিকাশ বা উন্নতি যে হারে হচ্ছে, তার তুলনায় লন্ডনের বিকাশ ঘটছে দ্বিগুণ হারে। ব্রেক্সিট প্রস্তাবটি গণভোটে পাস হলেও লন্ডনের ভোটারদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের বিরোধী ছিল। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের বাকি অংশে এই গণভোট ছিল মানুষের এই ক্ষোভের প্রতিফলন যে, লন্ডনের সমৃদ্ধি দেশের অন্যত্র প্রসারিত হয়নি। এশিয়া ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশে মেগাসিটি পর্যায়ে যে প্রবৃদ্ধি ঘটে চলেছে, লন্ডন হয়ত তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারবে না। যেমন, এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে নাইজিরিয়ার লাগোসে যেখানে ঘণ্টায় ৭০ জন করে নতুন বাসিন্দা এসে উপস্থিত হচ্ছে, সেখানে লন্ডনে আসছে ঘণ্টায় ৯ জন। লন্ডনের মেয়রের হিসাবে নগরীর প্রবৃদ্ধি বা বিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বছরে ৬৬ হাজার নতুন বাড়ি দরকার। ২০২২ সালের মধ্যে ১ লাখ ১৬ হাজার সাধ্যায়ত্ত বাড়ি নির্মাণের একটি পরিকল্পনা সরকার নিয়েছে। তবে তা কতদূর বাস্তবায়িত করা যাবে সেটাই প্রশ্ন। বাস্তব সত্য হলো কোথাও নির্মাণ কাজের হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ধারেকাছেও নেই। মধ্য লন্ডনকে ক্রমোবর্ধমান হারে বিদেশী ট্যুরিস্ট, রুশ ধনকুবের ও সৌদি শাহজাদাদের জন্য লোভনীয় দ্বীপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এরা বছরের মাত্র কয়েক সপ্তাহ তাদের কোটি কোটি ডলার মূল্যের বাড়িতে এসে কাটিয়ে যায়। সুতরাং লন্ডন মানুষের প্রকৃত বসবাসের স্থানের তুলনায় বিনিয়োগের বাজারই বরং হয়ে উঠছে। উপরোক্ত লোকেরা এখানে তাদের টাকা ঢেলে তা রেখে দিতে চায়, যেন নগরীটা একটা ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। সেদিক থেকে দেখলে লন্ডনের বিলাসবহুল এ্যাপার্টমেন্টের টাওয়ারগুলো একেকটা সোনার খনি। বৈশ্বিক নগরী হওয়ার একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এমন নগরীর সম্পদকে আকৃষ্ট করে। তাই দেখা যায় লন্ডনে ব্রিটিশ রাজপরিবারের যত না রিয়েল এস্টেট আছে, কাতারের রাজপরিবারের আছে তার চেয়েও বেশি। তাদের হোল্ডিংগুলোর মধ্যে আছে হ্যারোডস ডিপার্টমেন্ট স্টোর, শার্ড ভবনের অধিকাংশ, গ্রসভেনর স্কোয়ারে অবস্থিত সাবেক মার্কিন দূতাবাস ভবন, যা এখন বিলাসবহুল হোটেলে রূপান্তরিত করা হচ্ছে, হিথরো এয়ারপোর্টের ২০ শতাংশ এবং ক্যানারি ওর্ফের একাংশ। ইরানের শাহ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি প্রথম যে জায়গায় গিয়ে উঠেছিলেন সেটা লন্ডন। নাইজিরীয়রা তেল বিক্রি করে বড়লোক হওয়ার পর লন্ডনে সম্পদ কিনেছিল। একই কাজ করেছে ভারতীয়রা। বার্লিন ওয়াল পতনের পর রুশরা এবং এখন করছে চীনারা। লন্ডনে ৩২টি বারো আছে। বারো হচ্ছে এমন এলাকা যার পৌরসভা আছে। এই ৩২টি বারোর মধ্যে যেটি লন্ডনের পরিবর্তন ও স্ববিরোধিতাগুলোকে সবচেয়ে ভালভাবে ধারণ করে আছে, সেটি হলো টাওয়ার হ্যামলেটস। মাত্র ৮ বর্গমাইলের এই এলাকাটি লন্ডনের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধিষ্ণু বারো। ৩ লাখেরও বেশি লোকের বাস সেখানে। নগরীর দরিদ্রতম কিছু এলাকা যেমন এখানে আছে, তেমনি আছে সবচেয়ে বিত্তবানদের এলাকাও। এই বারোতে রয়েছে ক্যানারি ওর্ফ নামে অর্থলগ্নি ও লেনদেনের এলাকাÑ যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে যার অবদান তৃতীয় বৃহত্তম। এখানে রয়েছে বেশকিছু স্কাইস্ক্র্যাপারের সমাবেশ। লন্ডনে নির্মাণাধীন সুউচ্চ ভবনগুলোর মধ্যে ৮৫টি নির্মিত হচ্ছে টাওয়ার হ্যামলেটসে, যা অন্য যে কোন বারোর চেয়ে বেশি। টাওয়ার হ্যামলেটসের সর্ববৃহৎ অভিবাসী গোষ্ঠী হচ্ছে বাংলাদেশীরা। বাঙালী অধ্যুষিত একটি এলাকার নাম নতুন করে রাখা হয়েছে বঙ্গ টাউন। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
×