ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

টমটম নয় এটা চরের জাহাজ, দুর্ভোগ কমিয়েছে মানুষের

প্রকাশিত: ০৪:৫৪, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯

 টমটম নয় এটা চরের জাহাজ, দুর্ভোগ কমিয়েছে মানুষের

সমুদ্র হক ॥ মরুর জাহাজ উটের পথ ধরে চরের জাহাজ হয়েছে ঘোড়া। টেনে ছুটিয়ে নিয়ে যায় বিশেষায়িত এক ধরনের গাড়ি, যা দেখতে অনেকটা গরুর গাড়ির মতো। তবে চরাঞ্চলে এই গাড়ি গরুর শক্তিতে সহজে চলতে পারে না। প্রয়োজন হয় অশ্বশক্তি। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে চরের জাহাজ হয়েছে ঘোড়ায় চালিত বিশেষ গাড়ি। অস্তিত্ব রক্ষায় চরের মানুষ ঘোড়ায় চালিত এই গাড়ি উদ্ভাবন করেছে। ব্রহ্মপুত্র যমুনা পদ্মার চরে এমন গাড়ি যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধরে রেখেছে। মানুষের দুর্ভোগ অনেক কমেছে। এখন আর তপ্ত বালির ওপর দিয়ে হেঁটে দীর্ঘ চর পাড়ি দিতে হয় না। চরের মানুষের হেঁটে দূরের হাটবাজারে পণ্য নিয়ে যাওয়ার কষ্ট দূর হয়েছে। চরের মানুষ এই যানের নাম দিতে পারে নি। শুধু ডাকে চরের ঘোড়া। তাতেই বুঝে নেয় ঘোড়ার গাড়ি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিনে দিনে নদ নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বর্ষা মৌসুমেও অনেক চর জেগে থাকে, ডোবে না। যমুনা তীরের বগুড়ার সারিয়াকান্দি, ধুনট সোনাতলা, লালমনিরহাট নীলফামারীতে তিস্তা, কুড়িগ্রাম, ময়মনসিংহ জামালপুরে ব্রহ্মপুত্র, রাজশাহীতে পদ্মাপাড়ে শুকনো মৌসুমে চোখে পড়ে শুধুই বালুচর। গ্রীষ্মে এই চরের বালি যেমন আগুনে তপ্ত, শীতে এই বালি বরফের মতো ঠান্ডা। চরের মানুষ পায়ে ফোস্কা নিয়ে পাড়ি দেয় দূরের পথ। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়ন চরাঞ্চলে। যে হারে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, তাতে আরও ইউনিয়ন বালিয়াড়িতে ঢাকা পড়তে যাচ্ছে। সারিয়াকান্দি সদর থেকে নৌপথে সহজে এখন আর চরে যাওয়া যায় না। এক চরের পর কিছুটা পানি তারপর আবার চর। উৎপাদিত পণ্য বিপণনের জন্য হাট বাজারে নিয়ে যেতে পোহাতে হয় দুর্ভোগ। অসুস্থ রোগী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। চরে গরুরগাড়ি সহজে চলে না। গরুর গাড়ি গ্রামের সড়কে যতটা সহজে চলতে পারে চরের বালির ওপর দিয়ে গরু সেভাবে টানতে পারে না। চরের ওপর দিয়ে এক ঘোড়া যতটা বোঝা বহন করতে পারে, এক জোড়া শক্তিশালী গরু তা পারে না। গরুর শক্তি ঘোড়ার চেয়ে কয়েক গুণ কম। যে জন্য চরের যোগাযোগে ঘোড়ার গাড়ি বড় ভূমিকা রাখছে। লোকজন বলতে শুরু করেছে চরের জাহাজ ঘোড়ার গাড়ি। চরের মানুষের দুর্বিষহ জীবন দূর করেছে বিশেষ ধরনের ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার শক্তিকে রূপক করে ইঞ্জিনের শক্তি নির্ণিত হয়েছে। বলা হয়- ‘হর্স পাওয়ার’। এই ঘোড়াকে কাজে লাগিয়েছে চরের মানুষ। কাজলা চরের আবুল কালাম বললেন, মোটর গাড়ির চাকা টায়ার, রিং আনুষঙ্গিক জিনিস ঠিকঠাক করে বাঁশ কাঠের কাঠামোর সঙ্গে এঁটে দিয়ে অনেকটা গরুর গাড়ির আদলে ঘোড়ার চালিত গাড়ি তৈরি করেছেন। যমুনার ওপারে জামালপুরের মাদারগঞ্জ হাট থেকে ঘোড়া কিনে এনে গাড়ির সঙ্গে এক ঘোড়াজুড়ে চরের ওপর দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করে যাত্রী ও পরিবহন করা হয় উৎপাদিত পণ্য। প্রতিবার অন্তত দশ মণ করে পণ্য পরিবহন করা যায়। উৎপাদিত ফসল চরের ওপর দিয়ে হাটবাজারে নিয়ে যাওয়ার বাহন এই ঘোড়ার গাড়ি। বোহাইল গ্রামের আফজাল বললেন, তার ঘোড়া গাড়ি এক চর থেকে আরেক চরে লোকজন নিয়ে যায়। এই ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে চরের অনেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। দিনে ৮শ’ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছে তারা। চালুয়াবাড়ির মনসুর আলী বললেন, ঘোড়াসহ তার গাড়ি তৈরিতে খরচ পড়েছে ৫৫ হাজার টাকা। ঘোড়ার কদর কমে যাওয়ায় ঘোড়ার দামও এখন কম। একসময়ের ঘোড়ায় চালিত টমটমও প্রায় উঠেই গেছে। ঘোড়ার খাবারের জোগান দিতে না পাড়ায় কেউ ঘোড়া পালন করে না। ঘোরসওয়ার, কোচওয়ানদের সংখ্যা কমেছে। শহরের কোন র‌্যালি, কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে কেউ শখ করে টমটম ভাড়া করে। যমুনায় খেয়া পারাপারের পর লোকজন খোঁজে চরের এই ঘোড়া গাড়ি। এসব গাড়ি আশপাশেই থাকে। লোক দেখলেই বাসের কন্ডাক্টরের মতো হাঁক দেয়। বড় ও ছোট ঘোড়া ভেদে ঘোড়া গাড়িতে ৬ থেকে ১২ জন পর্যন্ত যাত্রী বসতে পারে। মাল পরিবহন করতে পারে ১০/১২ মণ। একটা সময় রেল স্টেশনের কাছে যেমন টমটম থাকত। বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র যমুনার চরের পারাপারে থাকে ওই ঘোড়ার গাড়ি। সারিয়াকান্দি থেকে অনেকটা দূরের ধারাবর্ষা চরের লোকজনের কথা, এই ঘোড়ার গাড়ি চরে যাতায়াতের যে সমস্যা ছিল তা কমিয়েছে। তারা এখন পণ্য পরিবহন, বিয়ে শাদিসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে ঘোড়ায় চালিত গাড়ির ওপর নির্ভরশীল। দেশে ঘোড়ার সংখ্যা কমে যাওয়ার পরও চরের যাত্রী ও পরিবহনে ঘোড়াকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
×