ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্লেষকদের অভিমত

গৃহস্থ‍ালী জ্বালানি ব্যবসার পুরোটা বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়া অযৌক্তিক

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯

 গৃহস্থ‍ালী জ্বালানি ব্যবসার পুরোটা বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়া অযৌক্তিক

রশিদ মামুন ॥ সারাদেশের সীমিত সংখ্যক মানুষ পাইপ লাইনের গ্যাস ব্যবহার করছে। এর বাইরে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিজ উদ্যোগে রান্নাঘরের জ্বালানির সংস্থান করছেন। বিপুল জনগোষ্ঠী নিজ উদ্যোগে রান্নাঘরের জ্বালানির সংস্থান করতে গিয়ে নির্মম বাণিজ্যের শিকার হচ্ছেন। বিগত সময়ে রান্নাঘরের জ্বালানির সংস্থানে সরকার নানাবিধ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। যার একটিও এখনও আলোর মুখ দেখেনি। উপরন্তু দেশে আবাসিক গ্যাস সংযোগ দেয়া বন্ধ রয়েছে। একদিকে সরকারী উদ্যোগে ভাটা অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের অতি বাণিজ্যিক ভাবনায় সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। একই সঙ্গে রান্নাঘরের নিরাপত্তা এবং গৃহিনীদের সুরক্ষার বিষয়টি নিয়েও ভাবা হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের প্রায় সব ঘরে বিদ্যুত পৌঁছেও দেয়া হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে মৌলিক অধিকারের প্রথমটির জন্যই রান্নাঘরের নিরাপদ জ্বালানি সংস্থানের বিষয়ে কোন চিন্তা করা হচ্ছে না। সরকারের একই মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুত ও জ্বালানি দুই বিভাগের মধ্যে জনচাহিদা মেটানোতে দুই রকম অবস্থা দেখা গেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত গ্রিডের গ্যাসের বদলে সরকারী উদ্যোগে সারাদেশে এলপিজি সরবরাহ করছে। এক্ষেত্রে সরকার এলপিজিতে ভর্তুকিও দিচ্ছে। একটি পরিবার তার বিদ্যুত ব্যবহারের জন্য যে খরচ করে তার প্রায় সমান বা তার চেয়ে বেশি খরচ করে জ্বালানি চাহিদা মেটাতে। জ্বালানি ব্যবসার পুরোটাই বেসরকারী খাতের উপর ছেড়ে দেয়াকে যৌক্তিক মনে করেন না বিশ্লেষকরা। জ্বালানি সচিব আবু হেনা রহমাতুল মোঃ মুনিম বলেছেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত তাদের এলপিজি বিস্তার সরকারীভাবে করেছে। তবে আমাদের এখানে আমরা বেসরকারী খাতের উপর নির্ভর করছি। তিনি সম্প্রতি এলপিজিকেই রান্নাঘরের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে দেশে সবগুলো গ্যাস কোম্পানির ৩৭ লাখের মতো আবাসিক গ্রাহক রয়েছে। একটি আবাসিক সংযোগে একটি পরিবার ধরে হিসেব করলে মাত্র এক কোটি ৮৫ লাখ মানুষ গ্রিডের গ্যাসের সুবিধা ভোগ করছে। বাকি জনসংখ্যার জ্বালানি এলপিজি, বিদ্যুত এবং কাঠ। সারাদেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটির মতো পরিবার রয়েছে। এসব পরিবারের জ্বালানির সংস্থান নিজেদেরই করতে হয়। জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে এখন তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস-এলপিজিকে রান্নাঘরের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার বাড়ছে। আগের কাঠ কয়লার চুলার বদলে এখন এলপিজির ব্যবহার বাড়ছে। দেশে এখন ৩০ লাখ মেট্রিক টন এলপিজির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে সরকারীভবে সর্বোচ্চ ২০ হাজার মেট্রিক টন এলপিজি সরবরাহ করা হয়। আর দেশের বেসরকারী কোম্পানিগুলো যে উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করেছে সম্মিলিতভাবে তার উৎপাদন ক্ষমতা ২৩ লাখ মেট্রিক টনের মতো। তবে এই চাহিদার পুরোটা ব্যবহার হয় না। অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে বেসরকারী উৎপাদনকারীদের একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। আবার চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যেও সব সময়ই ঘাটতি রয়েছে। একদিকে সঙ্কট এবং অন্যদিকে সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতা দুই কারণে এলপিজির বাজার বেসরকারী উদ্যোক্তাদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। গত বছর শুরুর দিকে এলপিজির জন্য একটি নীতিমালা করা হলেও দাম নির্ধারণে এখনও সরকারের কোন ভূমিকা নেই। ফলে পাইকারি বাজারে যেমন কারসাজির সুযোগ রয়েছে তেমনি খুরচা বাজারে এলপিজি বণিজ্যের কারণে গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার সারাদেশে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়ার পর বিপিসির মাধ্যমে এলএলপিজিকে আরও বেশি সংখ্যক গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়ার কথা জানায়। কিন্তু এখনও সরকারীভাবে এমন কোন উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর সরকার মংলা এবং চট্টগ্রামে দুটি বড় এলপিজি প্লান্ট করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই প্লান্ট নির্মাণের কাজ শুরুই করা সম্ভব হয়নি। সরকারীভাবে যে এলপিজি সরবরাহ করা হয় তাও সীমিত সংখ্যক সরকারী সতর্কতা পেয়ে থাকেন। সাধারণ মানুষকে সরকারী এলপিজি পেতে হলে বেসরকারী কোম্পানির মতোই বাড়তি দরেই সংগ্রহ করতে হয়। বিপিসির এক কর্মকর্তা জানান, এলপিজি সরবরাহের ক্ষেত্রে তারা ভর্তুকি দিয়ে থাকে। প্রতি বোতল এলপিজি সরবরাহ করতে বিপিসির ১০০ টাকার মতো ভর্তুকি দিতে হয়। ফলে বিপিসি এ বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। সরকার সারাদেশে এলপিজি সম্প্রসারণ করতে চাইলে বিকল্প পন্থায় অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। এলপিজির অতি বাণিজ্যের বিষয়টি সরকারও জানে। সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগের এক বৈঠকে এলপিজির দাম নিয়ন্ত্রণে প্রতি বোতলের গায়ে এলপিজির দাম লিখে দেয়ার ব্যবস্থা করা যায় কি না তা নিয়ে আলোচনা হয়। একই সঙ্গে সরকারীভাবে এলপিজির উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকারী এলপিজি কোম্পানিকে একটি যৌথ মূলধনী কোম্পানি গঠনের চুক্তি করার বিষয়ে তাগাদা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সরকার এখনও চাইছে এ খাতের নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে। যদিও এই উদ্যোগের সব কটিই এখন আলোচনায় সীমাবদ্ধ রয়েছে। গত বছর শুরুর দিকে এলপিজির মূল্য নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালা করা হয়। কিন্তু এখনও সেই নীতিমালা ধরে দাম নিয়ন্ত্রণের কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। ফলে আমদানিকারক তার ইচ্ছামাফিক দামে এলপিজি সরবরাহ করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে নিম্নমুখী দামের কারণে এলপিজির দাম ১২ কেজি বোতলে এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকার মধ্যে রয়েছে। তবে সরকার উদ্যোগ নিলে দাম আরও কমানো সম্ভব বলে মনে করা হয়। জানতে চাইলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য (গ্যাস) আবদুল আজিজ খান কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। এলপিজির বাইরে শহর এবং গ্রামের মানুষের একটি অংশ বিদ্যুতে রান্না করছেন। এতে ভর্তুকির বিদ্যুতের উপর চাপ বাড়ছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও সাশ্রয়ী রন্ধন পণ্য আমদানির কোন উদ্যোগ নেই। আবার বাংলাদেশের বাজারে কোন মানের পণ্য বিক্রি করা হবে তাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। বাজারের সস্তা রাইস কুকার কারি কুকার এবং ইন্ডাকশন কুকার এবং ইনভারটার হর হামেশাই পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণ বাতি বা ফ্যানের চেয়ে এসব রন্ধন উপকরণ কয়েকশ’ গুণ বেশি বিদ্যুত প্রয়োজন হয়। সঙ্গত কারণে এসব পণ্যের মান যাচাই করে বাজারে বিক্রি করা যৌক্তিক হলেও তা করা হচ্ছে না। কনজুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ক্যাব এর উপদেষ্টা জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম এ সম্পর্কে বলেন, সরকার যেভাবে ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দিচ্ছে একইভাবে জ¦ালানিও পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু সরকার গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দিয়ে এলপিজি ব্যবসায়ীদের সুযোগ করে দিচ্ছে। এই সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিয়ে দাম নির্ধারণ সরকারকে করে দিতে হবে। সরকারের নির্ধারণ করা দামে ব্যবসায়ীদের এলপিজি ব্যবহার করতে হবে। তিনি বলেন, রান্নাঘরে সাধারণত নারীরাই কাজ করেন। আমাদের উচিত তাদের স্বাস্থ্যের দিকেও খেয়াল রাখা। যা করা হচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি।
×