ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মন্ত্রণালয় পরিদর্শন কালে বললেন প্রধানমন্ত্রী

সঠিক দায়িত্ব পালন না করলে ডাক্তার নার্স ওএসডি

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯

 সঠিক দায়িত্ব পালন না করলে ডাক্তার নার্স ওএসডি

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসকদের বেসরকারী হাসপাতালে এসে যেন রোগী দেখতে না হয় সেজন্য হাসপাতালগুলোতেই ‘বিশেষ ধরনের সেবা’ চালুর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কর্মস্থলে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতিতে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সবার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। চিকিৎসকদের যেখানে বদলি করা হবে, তারা যদি সেখানে কাজ না করে তাহলে তাদের ওএসডি করে দিতে হবে। নতুন চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে। কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে তাৎক্ষণিক ওএসডি করতে হবে। আর নার্সরা যদি সেবা দিতে না চায়, তাহলে তাদেরও চাকরি ছেড়ে দিতে বলেন প্রধানমন্ত্রী। রবিবার সকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী এমন নির্দেশ দেন। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের ডাক্তাররা সব সময় প্রাইভেট চিকিৎসা দিতেই পছন্দ করেন। পৃথিবীর বহু দেশ আছে, সরকারী চাকরি যতদিন করে ততদিন প্রাইভেট চাকরি করতে পারে না। এমনকি সিঙ্গাপুরেও এনইউএইচের ডাক্তাররা প্রাইভেট চিকিৎসা করতে গেলে ওই হাসপাতালের মধ্যেই আলাদা ব্যবস্থা আছে। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃবিভাগে এ ধরনের একটি ব্যবস্থা চালু থাকার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা কিন্তু আমরা অন্যান্য জেলা হাসপাতালেও করে দিতে পারি, যেন তাদের বাইরে না যেতে হয়। সন্ধ্যার পরে বা ছুটির সময় ওখানেই একটা প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা বা আলাদা একটা উইং করে দেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, হাসপাতালে রোগী দেখার পরে প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে কেউ (চিকিৎসক) রাত ১২টা, একটা, দুটো পর্যন্ত নাকি অপারেশন করেন। যে ডাক্তার রাতভর অপারেশন করবেন, তিনি আবার সকাল আটটায় এসে রোগী দেখবেন কি করে? তার মেজাজ তো এমনিই খিটখিটে থাকবে। এটা যেন না হয় সেদিকে একটু দৃষ্টি দেয়া দরকার। দেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয়া হবে। কোন্ জেলাণ্ড কোন্ উপজেলার জন্য হাসপাতাল লাগবে, তা কত শয্যার হতে হবে, চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য কি সুবিধাদি প্রয়োজন তা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে একটি জরিপ করে দেখতে হবে এবং সে অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হবে। তবে, এর আগে জরিপ করে দেখতে হবে হাসপাতালগুলোয় কত রোগী যাচ্ছেন? কতজন এটেনডেন্ট রয়েছেন? ডাক্তাররা সেখানে থাকছেন না কেন? শেখ হাসিনা বলেন, দেশে কত মেডিক্যাল কলেজ আছে সেটারও একটা সার্ভে করা উচিত, সেগুলোর কি অবস্থা তা জানার জন্য। কত শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক রয়েছে, শিক্ষার কি কি সুযোগ রয়েছে, সেটা আগে দেখা দরকার। বড় জেলা, যেগুলোর ১০ থেকে ১২/১৩ উপজেলা রয়েছে সেখানে আমরা মেডিক্যাল কলেজ করতে পারি। তিনি বলেন, তার সরকার অনেক হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা বাড়িয়ে আড়াই শ’ বেডের করে দিলেও দেখা যায়, সেখানে রোগী যাচ্ছে না বা রোগী পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অনেক হাসপাতালে সার্জন বা এ্যানেসথেসিস্ট পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, এখন থেকে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় সেখানকার জনগণের প্রয়োজন সাপেক্ষে হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে এবং প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং সেখানকার সকল মেডিক্যাল কলেজ এর অধিভুক্ত হবে। চিকিৎসার জন্য রেফারেল সিস্টেম চালুসহ দেশে প্রথম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রত্যেকটি হাসপাতালেই অনলাইন রেফারেল সিস্টেম চালু করতে হবে। তার সরকার দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে এবং নার্সদের প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে তিনি এ সময় নার্সদের পেশাকে দ্বিতীয় গ্রেডে উন্নীত করার প্রসঙ্গ তুলে ধরে রোগীদের সেবার বিষয়ে তাদের আরও আন্তরিক হওয়ার নির্দেশ দেন। অনেক নার্স ভালভাবে দায়িত্ব পালন না করার সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের তো রোগীদের সেবা দিতে হবে। সেজন্যই আমরা তাদের পদমর্যাদা এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছি। রোগীর সেবা না দিলে ঐ দ্বিতীয় শ্রেণীর নার্সদের দরকার নেই। আমার পরিষ্কার কথা, আমি তাদের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছি। কারণ, রোগী যেন সেবা পায়। নার্সদের মাঝে মানসিকতা আছে যে তারা যেহেতু দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে উন্নীত হয়েছেন, তাই তারা রোগীকে সেবা দেবেন না। না, এটা হবে না। তাদের অবশ্যই রোগীকে সেবা দিতে হবে, আমরা তাদের এত সম্মান দিয়েছি যাতে তারা সেবা দেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, একজন নার্সের কাজ কিন্তু শুধু ওষুধ খাওয়ানো নয় বরং পাশ্চাত্যে নার্সরাই রোগীর সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে রোগী সম্পর্কে সার্বিক রিপোর্ট তৈরি করে ডাক্তারকে দেখায়, ডাক্তার সেই রিপোর্ট দেখে চিকিৎসা দেয় এবং রোগীর সার্বিক সেবা করাটাই নার্সের দায়িত্ব। তিনি বলেন, নার্সদের আমি সম্মান দিয়েছি ঠিক। কিন্তু রোগীর সেবাটা করতে হবে, এটা বাধ্যতামূলক। না করলে তারা কাজে থাকবে না, চলে যাবে। আমরা নতুন লোক প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে আসব। সরকারপ্রধান এ সময় চিকিৎসকদের ইন্টার্নশিপ দু’বছর করে দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এক বছর তারা থাকবে যে প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রী নিয়েছে সেই প্রতিষ্ঠানে এবং আর একটি বছর তাদের যুক্ত থাকতে হবে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। তার সরকার এটি চালুর উদ্যোগ নেয়ার পরে বিষয়টি এখন কি অবস্থায় রয়েছে তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চান প্রধানমন্ত্রী। তিনি এ সময় তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশব্যাপী কমিউনিটি ক্লিনিক চালুতে তার সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে বলেন, এটা কিন্তু পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল হবে না। হাসপাতাল হবে উপজেলা হাসপাতাল। আর এখানে একটি প্রাথমিক চিকিৎসা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে। এর পর হাসপাতালে সংশ্লিষ্ট রোগীকে রেফার করা হবে। মিডওয়াইফ প্রশিক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের গ্রাম-গঞ্জে এটা চালু আছে, ‘দাই’ বলে যাদের। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া। কেউ চাইলে ঘরে বসে যাতে ডেলিভারির (সন্তান প্রসব) কাজটা করতে পারে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার, নার্স এবং বিশেষ করে ডাক্তার না থাকার অনবরত অভিযোগ রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এজন্য প্রত্যেকটি হাসপাতালে অনুপস্থিতির বিষয়টি তদারকির জন্য বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থাটাও চালু করতে হবে। তিনি এ সময় রোগীদের চিকিৎসার জন্য ডিজিটাল হেলথ কার্ড চালুর প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসক এবং নার্সদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রতিটি হাসপাতালে সিসি ক্যামেরা ইনস্টল থাকা গুরুত্বপূর্ণ এবং রোগীর কিছু হলেই চিকিৎসকের ওপর চড়াও হওয়ার মতো মানসিকতা জনগণকে পরিবর্তন করার পরামর্শ দিয়ে ডাক্তার এবং নার্সদের উদ্দেশে বলেন, যখনই একটা রোগী আসে সঙ্গে সঙ্গেই তারা যেন চিকিৎসার ব্যবস্থাটা নেয়, ফেলে না রাখে। সেবামূলক মানসিকতাটা যেন চিকিৎসকদের মাঝে গড়ে ওঠে সেজন্য সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার। তিনি এজন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি ভালভাবে প্রচারের ওপর জোর দেয়ার পাশাপাশি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন কারিকুলাম যুগোপযোগী করার এবং দেশ-বিদেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচী আরও গতিশীল করার পরামর্শ প্রদান করেন। শেখ হাসিনা এ সময় চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়ের ক্ষেত্রে ডিজিটাল অটোমেশন পদ্ধতি চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এক্ষেত্রে একটা জবাবদিহিতা থাকবে এবং অপচয় রোধ হবে এবং যেটা প্রয়োজন শুধু সেটাই ক্রয় করা হবে, যেটা না হলেও চলে সেটা ক্রয় করা হবে না। তিনি এ সময় সঠিক মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপরও গুরুত্বারোপ করে বলেন, এটা (বর্জ্য) নাকি সিটি কর্পোরেশনকে দিয়ে দেয়। সিটি কর্পোরেশন এটা নিয়ে কি করল তার কোন হদিস পাওয়া যায় না। এটা হলো একটা বাস্তব অবস্থা। সে কারণে আমি মনে করি, এটার একটা বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া দরকার। বর্জ্য যাতে সঠিকভাবে বাইরে ফেলতে পারে, সেই সিস্টেমটা তৈরি করতে হবে। সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে তার সরকারের সাফল্য তুলে ধরার পাশাপাশি আজকাল কিডনি, হার্ট ও ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এগুলো কেন হচ্ছে তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের খুঁজে দেখতে হবে। দেশে ডিজিটাইজেশনের প্রভাবে জনগণের ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি আসক্তি বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্য সচেতনতা কমে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং যারা দিনের নির্দিষ্ট সময় কাজে ব্যস্ত থাকেন তারা যেন কাজের পর যথাযথ বিশ্রাম নেন এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখেন সেজন্য প্রচার চালাতেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, রোগ সারানোর দিকে দৃষ্টি দেয়ার চেয়ে রোগ যাতে না হয় সেদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালিক এবং প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মুরাদ হাসান অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
×