ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তারেক রহমান দায়ী ॥ বিএনপি নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের অভিমত ॥ বর্তমান অবস্থার জন্য

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯

তারেক রহমান দায়ী ॥ বিএনপি নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের  অভিমত ॥ বর্তমান অবস্থার জন্য

শরীফুল ইসলাম ॥ এক সময় ক্ষমতায় থেকে মহাদাপটে দেশ পরিচালনা করা রাজনৈতিক দল বিএনপির এখন করুণ দশা। এ করুণ পরিণতির জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দায়ী বলে দলের ভেতরই এখন আলোচনা হচ্ছে। পদচ্যুত হওয়ার ভয়ে নেতারা তা সরাসরি বলতে চাচ্ছেন না। তবে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলা শুরু হয়েছে। অবিলম্বে জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দল পুনর্গঠন না হলে যে কোন সময় বিএনপির একটি অংশ লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে। সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মী দলকে এগিয়ে নিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারেক রহমানের নির্দেশে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য গঠনের পর তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা হতাশ হন। অবশ্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপের পর পুরোদমে নির্বাচনমুখী হওয়ার পর কেন্দ্রীয় কিছু নেতা নাখোশ থাকলেও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নির্বাচনের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা মনোনয়ন বাণিজ্য শুরু করলে আবার দলের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। বিশেষ করে দলের যেসব নেতা মনোনয়ন বঞ্চিত হন তারা চরম ক্ষুব্ধ হন এবং নির্বাচনকালে বিএনপিকে সহযোগিতা না করে পরোক্ষভাবে অসহযোগিতা করেন। আর এ কারণেই কোন কোন এলাকায় বিএনপির ভাল অবস্থান থাকার পরও ক’টি আসনে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয়। এর ফলে সার্বিকভাবে সারাদেশের ৩০০টি আসনের মধ্যে মাত্র ৬টি আসন পায় বিএনপি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পরই খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারেনি বলে অভিযোগ উঠে। সবার আগে বিএনপির এক আলোচনা সভায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির জন্য দলের নেতৃত্বকে দায়ী করেন। এ ছাড়া তারা অবিলম্বে জাতীয় কাউন্সিল করে দল পুনর্গঠনের দাবি জানান। তাদের এ বক্তব্যে নির্বাচনে ভরাডুবির জন্য কাকে দায়ী করা হয়েছে সরাসরি না বললেও পরোক্ষভাবে এর জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন। আর এ কারণেই তারেক রহমান তাদের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ হন। আর এ ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটান সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তাদের কোন কথা বলতে না দিয়েই লন্ডনে বসে স্কাইপিতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনার পাশাপাশি এ সরকারের অধীনে আর কোন নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া। শুধু তাই নয়, বিএনপির ৭ সিনিয়র নেতাকে লন্ডনে গিয়ে তারেক রহমানের নির্দেশনা নিয়ে আসারও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। তারেক রহমানের এমন নির্দেশনা পেয়ে দলের কোন কোন সিনিয়র নেতা বিব্রত হয়েছেন। দলের ভেতরে এমন কথাবার্তাও হচ্ছে দেশের রাজনীতি করতে বিদেশে গিয়ে তারেক রহমানের নির্দেশনা নিয়ে আসতে হবে কেন? তিনি নিজেও তো দেশে এসে রাজনীতি করতে পারেন, দল পরিচালনায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে পারেন। এদিকে বিএনপির বর্তমান করুণ পরিণতির জন্য যে তারেক রহমান দায়ী তা বুঝতে পেরে ক্ষুব্ধ হন দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও। সম্প্রতি কোন কোন বিএনপি নেতাসহ বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরা এ নিয়ে মুখ খুলেছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়ে তারেকের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তের বিপরীতমুখী বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, বিএনপির উচিত সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়া। বিএনপিপন্থী আরেক বুদ্ধিজীবী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী। তিনি বিএনপির কোন পদ বহন না করলেও ক’বছর ধরে বিএনপির নীতি-নির্ধারণীমূলক সব কাজে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে আসছেন। সম্প্রতি তিনিও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি ও দলটির বর্তমান অবস্থার জন্য তারেক রহমানকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, তারেক রহমানের উচিত অন্তত ২ বছর রাজনীতি থেকে দূরে থাকা উচিত। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান অতি সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাতকার দিয়ে বলেছেন দলের নেতৃত্ব দিতে হলে তারেক রহমানকে দেশে ফিরে আসতে হবে। তার এ কথার মধ্যেও বর্তমানে তারেক রহমান যে দল পরিচালনায় ব্যর্থ এবং তার প্রতি যে দলের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ তা ফুটে উঠেছে। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তৎকালীন বিএনপির প্রাথমিক সদস্য তারেক রহমানকে বনানীতে হাওয়া ভবন নামে একটি বাড়ি ভাড়া করে তারেক রহমানকে ওই বাড়িতে বসে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এই বাড়িতে মাঝেমধ্যে খালেদা জিয়াও অন্য নেতাদের নিয়ে বসতেন। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে এই ভবনে বসেই তারেক রহমান সারাদেশে বিএনপির নির্বাচন পরিচালনার সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে তারেক রহমান হয়ে উঠেন মহাক্ষমতাধর। মা খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় তারেক রহমান সর্বক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। হাওয়া ভবন থেকে নিজের পছন্দের কিছু তরুণ নেতাকে নিয়ে তিনি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয় তারেক রহমান হাওয়া ভবনে বসে কার্যত ‘বিকল্প সরকার’ প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে সরকারী কর্মকা-সহ সর্বকিছুতে হস্তক্ষেপ করায় দলের ভেতরে ও বাইরে তারেক রহমানের প্রতি ক্ষোভের সঞ্চার হলেও কেউ প্রকাশ করেনি। ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর ওয়ান-ইলেভেনের সময় তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার প্রতি যাদের চাপা ক্ষোভ ছিল তারা তা প্রকাশ করতে শুরু করেন। দলের তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়া ও প্রবীণ নেতা সাইফুর রহমানসহ প্রায় দেড়শ কেন্দ্রীয় নেতা, যারা সবাই মন্ত্রী অথবা এমপি ছিলেন তারা একত্রিত হয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেন। গড়ে তোলেন সংস্কারপন্থী বিএনপি। একপর্যায়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও তারা দখল করে নেন। তখন তারেক রহমান ও খালেদা জিয়া জেলে থাকায় দলে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন সংস্কারপন্থীরা। অবশ্য ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই খালেদা জিয়া মুক্তি পান, আর তারেক রহমানও মুক্তি পেয়ে তিনি আর রাজনীতি করবেন না জানিয়ে লন্ডন চলে যান। আশা ছিল নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হলে তারেক রহমান দেশে ফিরে আসবেন। কিন্তু সে আশা পূরণ না হওয়ায় নির্বাচনের পর থেকে এখন পর্যন্ত তারেক রহমান দেশে ফেরার চেষ্টা করেননি। এদিকে তারেক রহমান লন্ডনে থাকলেও আদালতে বিচারাধীন ক’টি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তারেক রহমান দেশে এসে মামলা মোকাবেলা করবেন বিএনপি নেতাকর্মীরা এমন আশা করলেও গ্রেফতার এড়াতে তিনি দেশে আসেননি। তবে এ বছর ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে গেলে তারেক রহমান লন্ডনে বসেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন এবং তার নির্দেশেই দল পরিচালিত হয়। তবে একাধিক মামলায় ফেরারী আসামি হয়েও কিভাবে তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পালন করছেন এ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হয়। দলের ভেতরেও এ বিষয়টি আলোচনা হয় তবে কেউ সাহস করে প্রকাশ করতে চান না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কারাগার থেকে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র নেতাদের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনের সহযোগিতা নিয়ে সার্বিক প্রস্তুতি চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিলেও সে নির্দেশনা মতে কাজ করতে পারেননি বিএনপির সিনিয়র নেতারা। দলীয় মনোনয়নসহ সকল সিদ্ধান্ত লন্ডনে বসে চাপিয়ে তারেক রহমান দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ কারণে দলের সর্বস্তরের অনেক নেতাকর্মী গাছাড়া ভাব দেখিয়ে নির্বাচনে বিজয়ের জন্য তেমন চেষ্টা করেননি। অনেক সিনিয়র নেতা প্রার্থী হয়েও ভোট চাইতে যাননি। তারেক রহমানের প্রতি ক্ষুব্ধ থাকার কারণেই তারা নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দেননি। আর এ জন্যই নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়েছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবি হলেও যে ৬টি আসনে বিএনপি বিজয়ী হয়েছে তারা সংসদে গিয়ে প্রতিদিন বিএনপির পক্ষে কথা বলতে পারেন। তাই বিএনপির উচিত সংসদে যোগ দেয়া। কিন্তু তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপির নির্বাচিত ৬ জন এখনও শপথগ্রহণ করেননি এবং সংসদেও যাবেন না বলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে সক্রিয় রাখার যে সুযোগ ছিল সে সুযোগ নেয়ার পথও বন্ধ করে দিয়েছেন তারেক রহমান। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে লন্ডন থেকে স্কাইপিতে তিনি এ সরকারের অধীনে আর কোন নির্বাচনে না যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু কেউ সাহস করে তার এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ না করলেও কেউ কেউ মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, তারেক রহমান দেশের বাইরে থেকে নির্দেশনা দিয়ে দল পরিচালনা করুক এটা সিনিয়র নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ পছন্দ করছেন না। তবে দলীয় পদ হারানোর ভয়ে তা প্রকাশ্যে স্পষ্ট করে কেউ বলতে চাচ্ছেন না। তবে পরোক্ষভাবে ইতোমধ্যেই কেউ কেউ বলেছেন। দলের নির্বাহী কমিটির বৈঠক বা জাতীয় কাউন্সিল হলে হয়ত এ বিষয়ে কেউ না কেউ মুখ খুলতেন। আর এ কারণেই নির্বাহী কমিটির বৈঠকও ডাকা হচ্ছে না, জাতীয় কাউন্সিলও সহসা হওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
×