ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিটিসেলের স্থাপনা ও টাওয়ার এখন জঞ্জাল

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯

 সিটিসেলের স্থাপনা ও টাওয়ার এখন জঞ্জাল

ফিরোজ মান্না ॥ সারাদেশে সিটিসেলের বিভিন্ন স্থাপনা ও টাওয়ারগুলো জঞ্জাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৪৭৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা বকেয়া পরিশোধ সাপেক্ষে সিটিসেলের সব স্থাপনা তুলে নেয়ার নির্দেশ দেয় বিটিআরসি। ২০১৬ সালের ৩১ জুলাই এই নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর দুই বছরের বেশি সময় কেটে গেলেও সিটিসেল কর্তৃপক্ষ স্থাপনাগুলো সরিয়ে নেয়নি। বর্তমানে যেসব স্থানে তাদের টাওয়ার রয়েছে তার ভাড়া ও বিদ্যুত বিল বাবদ সিটিসেলের দেনার পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। দুই বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও বিটিআরসির নির্দেশ মানেনি সিটিসেল। বিটিআরসিও আর কোন উদ্যোগ নেয়নি। এখন বেকায়দায় পড়েছেন ভবন মালিকরা। যারা সিটিসেলের টাওয়ার স্থাপনের জন্য ছাদ বা জায়গা ভাড়া দিয়েছিলেন। বিদ্যুত কর্তৃপক্ষ টাওয়ারে যে বিদ্যুত ব্যবহার হয়েছে- তার বিল দাবি করে নোটিস দিয়েছে ভবন বা জায়গার মালিকদের। সূত্র জানিয়েছে, বিটিআরসির এই নির্দেশ সিটিসেল কর্তৃপক্ষ কানেই নেয়নি। অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে অপারেটরটির বিটিএস বা টাওয়ারগুলো। তরঙ্গ (স্পেক্ট্রাম) বাতিল হওয়ার পর টাওয়ারগুলো প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে যারা (বিভিন্ন বাড়ি বা ভবনের মালিক) অপারেটরটির টাওয়ারের জন্য জায়গা লিজ বা ভাড়া দিয়েছেন, তারা বিপাকে পড়েছেন। মূলত বাড়ি বা ভবনের ওপরেই রয়েছে টাওয়ারগুলো। সিটিসেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। বছরের পর বছর লিজ বা ভাড়ার টাকা ও বিদ্যুত বিল বকেয়া থাকায় বিপদে পড়েছেন ভবন বা বাড়ির মালিকেরা। টাওয়ার ভাড়ার টাকা না পেলেও এখন ভবন মালিকরা বিটিএসগুলো সরিয়ে নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। বকেয়া টাকা শোধ না করায় ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর সিটিসেলের তরঙ্গ স্থগিত করা হয়। এরপর ১৭ দিন বন্ধ থাকার পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ৬ নবেম্বর সিটিসেলের স্থগিত তরঙ্গ ফিরিয়ে দেয়ার পরে অপারেটরটির সুইচ রুম চালু করা হয়। কিন্তু কোন গ্রাহক অবশিষ্ট না থাকায় কার্যত বন্ধই হয়ে যায় সিটিসেল। এরপরে বকেয়ার কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় সিটিসেল পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। যদিও সিটিসেলের লাইসেন্স এখনও সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে। ১৯৮৯ সালে বিটিআরসি থেকে টেলিযোগাযোগ সেবার লাইসেন্স পেয়েছিল সিটিসেল। সবচেয়ে পুরনো অপারেটর হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি শুরুর দিকে কোটি কোটি টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। সর্বশেষ তাদের গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৬৮ হাজার। সিটিসেলের সক্রিয় গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ (বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত)। ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট বিটিআরসি প্রকাশিত তথ্যে সিটিসেলের গ্রাহক সংখ্যা ১ লাখ ৪২ হাজার উল্লেখ করা হয়েছিল। সিটিসেলের বকেয়া ৪৭৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা দুই কিস্তিতে পরিশোধ করার কথা থাকলেও তারা করেনি। অন্যদিকে সিটিসেল কর্তৃপক্ষের টাওয়ারে ব্যবহৃত বিদ্যুতের বিল মাসের পর মাস পরিশোধ না করায় তা বাড়ির মালিককে পরিশোধের জন্য তাগাদা দিচ্ছে বিদ্যুত বিতরণ কর্তৃপক্ষ। মহাখালীতে সিটিসেলের প্রধান কার্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ওই অফিসে এখন আর কেউ বসেন না। সারাদেশে অপারেটরটির টাওয়ারের সংখ্যা ৮৭৬টি। সিটিসেল বন্ধের আরও দুই বছর আগে থেকে টাওয়ার ভাড়া ও বিদ্যুত বিল পরিশোধ করা হয়নি। চূড়ান্তভাবে বন্ধ হওয়ার আগে দীর্ঘদিন বিদ্যুত বিল বকেয়া থাকার অভিযোগে ৭শ’ টাওয়ারের বিদ্যুত সংযোগ কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দেয়। পরে মাত্র ১৭৬টি টাওয়ার দিয়ে মোবাইল সংযোগ চালু রেখেছি অপারেটরটি। ভবন মালিকরা জানিয়েছেন, ২০০৬ সালে প্রথম তিন বছরের জন্য টাওয়ার ভাড়া বাবদ মাসিক ৬ হাজার, পরের তিন বছরের জন্য মাসিক ৬ হাজার ৬শ’, তার পরের তিন বছরের জন্য মাসিক ৭ হাজার ২শ’ টাকায় চুক্তি হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৬ সালের জন্য মাসিক ৭ হাজার ৮শ’ টাকা ভাড়ায় সিটিসেলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে কর্তৃপক্ষ ভাড়া বাকি ফেলতে শুরু করে। সিটিসেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ভাড়া দেয়া তো দূরের কথা-তারা মূল অফিসই বন্ধ করে দিয়েছে। কোন ভবন বা জায়গার মালিক সিটিসেল অফিসে গিয়ে কাউকে পাননি। দুই তিনজন সিকিউরিটি গার্ড ছাড়া ওই অফিসে আর কেউ বসেন না। তারা কারও সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছেন না। প্রতিটি টাওয়ারে এক লাখ টাকার বেশি বিদ্যুত বিল বাকি পড়েছে। এই বিলের চাপ এখন ভবন মালিক বা জায়গার মালিকদের ওপরে এসে পড়েছে। যদিও এই টাকা সিটিসেলের দেয়ার কথা। বিদ্যুত অফিস বার বার তাগাদা দিচ্ছে বিল পরিশোধের জন্য। বিল না দিলে ভবনের বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবে বলে জানিয়েছে বিদ্যুত কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সিটিসেলের প্রধান নির্বাহী মেহবুব চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (সিটিসেল) এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের (পিবিটিএলইইউ) কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, টাওয়ারগুলো এক সময় সিটিসেলের সম্পদ হিসেবে থাকলেও এখন তা কোম্পানির জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। এগুলো বিভিন্ন ভবন বা বাসাবাড়ি থেকে সরিয়ে নিতে হলো বকেয়া (ভাড়া ও বিদ্যুত বিল) পরিশোধ করতে হবে। ফলে ধরেই নেয়া যায় সিটিসেল এগুলো আর ফেরত নেবে না। সিটিসেল প্রথম দিকে টাওয়ারগুলো নিজেরা ব্যবস্থাপনা করলেও পরে ‘থার্ড পার্টির’ মাধ্যমে করা হয়েছে। সিটিসেলের টাওয়ারগুলো সিডিএমএ প্রযুক্তির। দেশের কোন মোবাইল অপারেটর এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে না। টাওয়ার শেয়ারিংয়ের জন্য গঠিত চার কোম্পানির কোনটির কাজে লাগবে না সিটিসেলের টাওয়ারগুলো। এই টাওয়ারগুলো কোন অপারেটরই কাজে লাগাতে পারবে না।
×