ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রথমবারের মতো দৃষ্টি দিচ্ছে বইমেলা কর্তৃপক্ষ

মেলার পথে পুরনো জঞ্জাল, দেখে চোখ কপালে

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯

মেলার পথে পুরনো জঞ্জাল, দেখে  চোখ কপালে

মোরসালিন মিজান ॥ বাংলা একাডেমির নতুন মহাপরিচালক। নতুন বটে। দু’ হাতে পুরনো জঞ্জাল ঠেলতে হচ্ছে। মাত্র কিছুদিন আগে দায়িত্ব পেয়েছেন কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী। তার পর থেকে নানা কাজ। তবে বর্তমানে অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে আরও সফল, সুন্দর ও সুরুচির করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। রুটিন কাজের পাশাপাশি নতুন কিছু বিষয় নজড়ে এসেছে তার। এবার মেলার মূল ভেন্যু নিয়ে পড়ে থাকা নয় শুধু, বহিরাঙ্গন পরিচ্ছন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। বহুকাল ধরে যাতায়াতের পথগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী। এত অনুপযোগী যে, প্রতি বছর মেলায় আসতে বইপ্রেমীদের যুদ্ধে নামতে হয়। এবার যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কর্মসূচীর অংশ হিসেবে রবিবার সাধারণ দর্শনার্থীদের মতো হেঁটে গোটা এলাকা পরিদর্শন করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। তার সঙ্গে ছিলেন গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হয়ে এসেছিলেন উপ-উপাচার্য ড. মুহাম্মদ সামাদ ও প্রক্টর গোলাম রব্বানি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি ছিলেন সহকারী প্রকৌশলী নির্মল চন্দ্র দে। দুপুর ১২টার কিছু পরে শাহবাগ থেকে হাঁটা শুরু করেন তারা। মেলা চলাকালে প্রতিদিন এ পথ ধরে যেভাবে সাধারণ দর্শনার্থীরা হেঁটে বাংলা একাডেমির দিকে যান, ঠিক সেভাবে এগিয়ে চলে পরিদর্শক দল। এবং তখনই চোখ কপালে। এ কী ভয়ঙ্কর চিত্র! গাড়ি করে প্রতিদিনই পাশ দিয়ে যাওয়া আসা হয়। কিন্তু সংলগ্ন ফুটপাথ ধরে হাঁটতে গিয়ে হতবাক হয়ে যান তারা। হাজার হাজার মানুষ টানা একমাস যে রাস্তাটি ব্যবহার করবেন, সেটির এই হাল! ফুটপাথগুলো ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এখানে ভাঙ্গা। ওখানে বিশাল গর্ত। কোথাও কোথাও ফুটপাথ ভেঙ্গে মূল রাস্তার সঙ্গে এসে মিশে গেছে। দাঁত বের করে থাকা ইটে পা পড়লেই বিপদের আশঙ্কা। ফুটপাত ছোট করে দাঁড়িয়ে আছে চায়ের দোকান। ভ্যানগাড়ি। শত শত ডাবের খোসা ফেলে রাখা হয়েছে। শাহবাগ থানার ঠিক পাশে এমন দৃশ্য। একটি বড় গাছ ঘিরে আবর্জনার স্তূপ। এর নিচে সম্পূর্ণ চাপা পড়েছে ফুটপাথ। জানা গেল, সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরাই এটা ওটা ফেলে রেখে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছেন। এক পর্যায়ে নিচে নেমে মূল রাস্তা ধরে হাঁটতে বাধ্য হন কর্মকর্তারা। স্বাধীনতা জাদুঘরে প্রবেশের পথটি পার হয়ে সামনে এগোতেই দুর্গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। জায়গাটা বেশ প্রশস্ত। কিন্তু পাবলিক টয়লেটে পরিণত হয়েছে! কেউ দেখলো না এতদিন? পরিদর্শক দলের সদস্যরা একে অন্যের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকান। পরের অংশটুকু মাথা নুইয়ে কোনরকমে পার হতে হয়। কারণ ফুটপাথের ওপর বিপজ্জনকভাবে ঝুঁকে আছে বড়ই গাছ। বাড়তি ডালপালা সাফ করা হয়নি কোনদিন। একটু অসচেতনভাবে হাঁটলেই কাঁটায় গা জড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। টিএসসি সংলগ্ন জায়গাগুলোতে চলছে দোকানদারি। চায়ের দোকান থেকে ছুঁড়ে মারা পনিতে, ময়লায় ভেসে যাচ্ছে ফুটপাথ। গর্তগুলোতে জমা হচ্ছে সব। সেখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এত চায়ের দোকান দিয়ে কী করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? বিড়ি খায় কারা এত? অথচ সারা বছর এসব দোকানদারি বহাল আছে। টিএসসির যে জায়গাটিতে মেলার প্রবেশদ্বার করা হবে সেখানে দেখা গেল অসংখ্য তার পড়ে আছে। উপর থেকে নিচের দিকে ঝুলে থাকা তার কাদের? কেন এভাবে পড়ে আছে? জানা গেল না। আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে পরিদর্শক দল। পরিদর্শন শেষে কথা হয় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, মেলায় আসা যাওয়ার পথ নির্বিঘ্ন হওয়া চাই। এই চাওয়া মাথায় রেখেই আমরা গুরুত্বপূর্ণ ফুটপাথ পরিদর্শন করেছি। সাধারণ দর্শনার্থীদের মতো মেলায় প্রবেশ করতে গিয়ে তাদের কী দুর্ভোগ হয় সেটি উপলব্ধি করা সম্ভব হয়েছে। দুরবস্থার একটি বর্ণাও দেন তিনি। বলেন, রুচির দুর্ভিক্ষ না হলে এমনটি হতে পারে না। ফুটপাথগুলো আবর্জনারে ভাগাড়ে পরিণত হয়নি শুধু, অপরিচ্ছন্ন বা অবিন্যস্ত নয় শুধু। ব্যবহারের অনুপযোগী। আজ সোমবার থেকে ফুটপাথ হাঁটার উপযোগী করার কাজ শুরু হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। মহাপরিচালক স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ১ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্বোধন করতে এই এলাকায় আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়টিও মাথায় রেখে কাজ করতে হবে আমাদের। ফুটপাথের গর্ত ভরাট মেরামত ও পরিচ্ছন্ন করার কাজে কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষসহ সকলের সহায়তা চান তিনি। সকলের সহায়তায় আগামী ৩০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সকল বাধা দূর করা হবে বলে জানান তিনি। একই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রব্বানি জনকণ্ঠকে বলেন, পরিবেশগতভাবে এবং নন্দনতত্ত্বের দিক থেকে দেখলে রাস্তার যে অবস্থা তা সত্যি খুব খারাপ। এ জন্য সবাই মিলে কাজ করতে হবে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি আমরা জানাব। অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করতে পদক্ষেপ নেয়া হবে। এর বাইরে, প্রধানমন্ত্রী যেহেতু আসছেন, রাস্তা ও পরিবেশ ঠিক করাসহ যে কোন প্রয়োজনে মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমিকে সব ধরনের সাপোর্ট দেয়া হবে বলে জানান তিনি। মেলা আয়োজনের সঙ্গে নানাভাবে সংশ্লিষ্ট থকেন সুভাষ সিংহ রায়। এবারও আছেন। রাজনীতি বিশ্লেষক ও লেখক রাস্তা পরিদর্শনের পুরোটা সময় দলের সঙ্গে ছিলেন। কী হলো অভিজ্ঞতা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেলায় প্রতি বছরই কিছু না কিছু নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। কিন্তু ভেতরে যতই সুন্দর করি না কেন, বাইরের অবস্থা তো অথৈবচ। হাঁটতে গিয়েই দেখলাম, হাঁটা খুবই দুরুহ। মেলায় ঢুকতে বের হতে বইপ্রেমীরা এতদিন যে যন্ত্রণা ভোগ করেছেন তা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে আমার। তবে এবার অবস্থার উত্তরণ ঘটবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। বলার অপেক্ষা রাখে না, এমন আশা বইপ্রেমী সকল মানুষের। মেলার ভেতরের পরিবেশ যেমন সুন্দর গোছালো হবে, তেমনি আসা যাওয়ার পথে যে দুর্ভোগ তা কমাতে হবে। বহিরাঙ্গনের সৌন্দর্য বাড়িয়ে সুরুচির প্রকাশ ঘটাতে হবে। তা না হলে অমর একুশে গ্রন্থমেলা যে বাঙালী সংস্কৃতির উৎসব, কী করে সে দাবি আমরা করব?
×