ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনকে ‘বিতর্কিত’ করতে ‘পর্যবেক্ষক’দের ব্যবহার

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯

 নির্বাচনকে ‘বিতর্কিত’ করতে ‘পর্যবেক্ষক’দের ব্যবহার

এটা তো জনগণের জানাই ছিল যে, এবারের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি, যারা বিগত এক দশক সরকারে থাকায় দেশের সব ক্ষেত্রে- অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, রাজপথ-রেলপথ, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় উন্নয়ন ঘটিয়ে জনগণের জীবনমানের সার্বিক উন্নতি ঘটানো দল ও মহাজোটকেই ক্ষমতায় আনতে হবে জনগণের নিজস্ব স্বার্থে। তা না করে, যে জনগণ দেখেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত রীতিমতো সারাদেশে শুধু হিন্দু, আওয়ামী লীগ নয়, দলনিরপেক্ষ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, নানা পেশাজীবীর ওপর বর্বর তা-ব চালিয়েছে, মৌলবাদী জঙ্গী দলের জন্ম দিয়ে দেশকে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো বোমা-গ্রেনেড হামলা-হত্যার মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে, পেট্রোলবোমা হামলা করে শত শত মানুষ হত্যা করেছে, হাজার হাজার বাস, ট্রাক, রেল, বৃক্ষ ধ্বংস করেছে, এসব দেখা জনগণ কেন বিশাল মূর্খামি করে নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মারতে বিএনপি-জামায়াতকে ভোট দেবে? প্রকৃত সত্য সম্পর্কে বিএনপি অবহিত ছিল যে, এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে প্রভূত উপকার পাওয়া জনগণ, সব পেশাজীবী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণী আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে। তাদের পক্ষে বিএনপিকে ভোট দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি দুটো চাল চেলেছিল- ১। বিএনপির প্রার্থীরা যেহেতু পরাজিত হবে সে জন্য তারা কোন প্রচার-প্রচারণা না করে সরকারকে তাদের প্রচারে বাধা দিচ্ছে বলে দোষারোপ এবং তাদের কর্মী-সমর্থকদের গ্রেফতার করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না করার জন্য সরকারকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা। অথচ জনগণ জানে যে, বিএনপির মধ্যে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী-ক্যাডার রয়েছে, যারা ২০০১-২০০৬-এর হত্যা, দখল, ঘুষ, দুর্নীতির অপরাধে যেমন অপরাধী, তেমনি একটি বড় সংখ্যক নেতাকর্মী ২০১৪-১৫তে খালেদার হুকুমে পেট্রোলবোমা মেরে নিরীহ বাস-চালক-যাত্রী শুধু নয়, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থক, হিন্দু ছাত্র নেতাকর্মী হত্যার ফৌজদারি অপরাধে অপরাধী। সুতরাং নির্বাচনের আগে প্রকৃত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতি নির্বাচনের মতো এবারও ফৌজদারি অপরাধে অপরাধীদের গ্রেফতার করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিতে হয়েছে পুলিশকে। এরা দীর্ঘদিন পলাতক ছিল। সেজন্য তারা নির্বাচনের সময় মিছিল-সমাবেশে যোগ দিতে সবার সামনে আসে। যে কারণে তারা গ্রেফতার হয়। ২। বিএনপির আরেকটি প্ল্যান- নাশকতা, তান্ডব চালিয়ে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও নিরাপত্তা বাহিনীকে, দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দুর্বল করার জন্য মাঠে নামা। সুতরাং নাশকতাকারীরা গ্রেফতার হয়েছে স্বাভাবিক কারণেই। আগে গ্রেফতার হয়নি বলে এখন নির্বাচনী মাঠে নির্বাচনকে নাশকতামুক্ত রাখার জন্য তাদের গ্রেফতার করা হবে এটাই স্বাভাবিক নয় কি? এবং সেটিই ঘটেছে। এটা বিরোধী দলকে বাধাগ্রস্ত করা নয়, বরং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, নাশকতামুক্ত নির্বাচন সংঘটনের জন্য প্রয়োজন ছিল। ৩। বিএনপির আরেকটি বড় চাল ছিল- নির্বাচনকে নানা উপায়ে প্রশ্নবিদ্ধ করা। বিতর্কিত করে বিদেশীদের কাছে অগ্রহণযোগ্য করা। ক. এ কাজটির জন্য প্রথম ভোটার কেনার জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে, যার প্রমাণ তারেকের সাবেক এপিএস অপুর আঠারো কোটি টাকা, চেকসহ গ্রেফতার হওয়া। খ. অর্থ ব্যয় করে ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে বিএনপি প্রার্থীর গাড়ি ভাঙচুর, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটানো এবং এসব ঘটনা আওয়ামী লীগ দলীয় ব্যক্তিদের দ্বারা ঘটানো বলে ব্যাপক প্রচার চালানো। গ. অর্থ ব্যয় করে বিএনপি দলীয় ব্যক্তিদের নৌকার ব্যাজ, ক্যাপ পরিয়ে, কোন কোন ক্ষেত্রে যুবলীগ পরিচয়ধারীদের অর্থ দিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু ভোট কেন্দ্রের বাইরে ভোটারদের ভোটদানে বাধা দেয়া হয়েছে এবং ভোট না দিয়ে তাদের ফেরত পাঠানোর কাজ করা হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এরকম কিছু কেন্দ্রের কথা, পুরান ঢাকা, চাঁদপুর-এর ঘটনা জানতে পেরেছি। নৌকার ব্যাজ পরা তরুণরা যেসব ভোটারকে বাধা দিয়েছে তাদের মধ্যে সব ভোটারই ছিল নৌকার পক্ষের ভোটার। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ভোট কমানোর চেষ্টা কারা করবে? স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি। এবারের নির্বাচনকে কৃষক-শ্রমিকসহ সব পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বনাম মুক্তিযুদ্ধবিরেইধতার ভোটযুদ্ধ হিসেবে গণ্য করে দলে দলে মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন দিয়েছে। সুতরাং গ্রামে, শহরে ভোটারের দীর্ঘ সারিতে খুব কম সংখ্যক ভোটারই বিএনপির পক্ষে থাকার কথা। সত্তর থেকে আশি ভাগ ভোটার আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকার কথা, যেটি বাস্তবে প্রমাণ হয়েছে। জামায়াত অনেক ধুরন্ধর। তারা ভোটের হিসাব বুঝতে পেরে নির্বাচনের দিন নির্বাচন থেকে সব প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেয়। এটিও প্রমাণ করে বিজয়ী হবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত নয়। অর্থাৎ বাধাপ্রাপ্ত ভোটাররা প্রায় সবাই ছিল নৌকার ভোটার। যা হোক, নির্বাচন বিদেশীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি বলে প্রমাণ করতে ব্যতিব্যস্ত বিএনপি এখনও নানারকম কূটকৌশল অবলম্বন করে চলেছে, যার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে- নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের একটি গোষ্ঠীকে তাদের দেয়া মন্তব্য থেকে সরিয়ে আনার অপচেষ্টা করা। এর ধারাবাহিকতায় তাদের আগের দেয়া মন্তব্য- ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে’ কে ‘নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ’-এ রূপান্তরিত করা হয়েছে! ঐ গোষ্ঠীর প্রেসিডেন্ট এমনও বলেছেন যে, ‘ভোটার ও প্রিসাইডিং অফিসারের কাছ থেকে আগের রাতেই আওয়ামী লীগের কর্মীদের দ্বারা ব্যালট বাক্স ব্যালট পেপার দিয়ে ভর্তি করার সংবাদ জেনে এবং ভোটারদের হেনস্থা করার খবরে এখন তিনি তার প্রথম মন্তব্যের বদলে বিশ্বাস করছেন যে, ভোটগ্রহণ নতুন করে করা দরকার।’ আশ্চর্য এই যে, তিনি নির্বাচনের বিশ-বাইশ দিন পর কোন্ কোন্ ভোটারের কাছে গেছেন এবং কোন্ কোন্ প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছেন, তা তাকে অবশ্যই জানাতে হবে। কারণ এটি কি আদৌ সম্ভব? উপরন্তু, জনগণের মনে এই সন্দেহ জেগেছে যে, তার ও অন্য সদস্যের নির্বাচন সম্পর্কে মন্তব্য পরিবর্তন করতে বিএনপির সব অপকৌশলের হোতার কাছ থেকে কোন বড় ধরনের ‘ইনসেনটিভ’ বা ‘পুরস্কার’ পেয়েছেন কিনা! দ্বিতীয়তঃ কেন তাদের মুখে বিএনপির নির্বাচন নিয়ে প্রচারণার বিশেষ দাবিটি হুবহু বিএনপির নেতাদের মন্তব্যের মতো একইরকমভাবে উচ্চারিত হলো ‘নতুন নির্বাচন দিতে হবে’? এতদিন পর একদম একই সুরে একই দাবি করা হলো কেন? সন্দেহজনক নয় কি? এর আগে একটি সংস্থা বিএনপির নির্বাচনকে বিতর্কিত করার জন্য ব্যবহৃত বক্তব্যগুলোকে তাদের গবেষণার ফল হিসেবে উল্লেখ করেছে, যেমন- পর্যবেক্ষণ করা পঞ্চাশটি ভোট কেন্দ্রের সাতচল্লিশটিতে ‘অনিয়ম’ হয়েছে উল্লেখ করে ‘অনিয়মের’ মধ্যে ‘জালভোট’, ‘রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা’, ‘ভোটারদের বাধা দান’, ‘পোলিং এজেন্টদের বাধা দান’, ‘শুধুমাত্র সরকারী দলের প্রার্থীর প্রচার চালানো’, ‘নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তা’ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এই ‘অনিয়ম’ অনেক বিএনপিপন্থী চ্যানেল, প্রিন্ট মিডিয়া, বিএনপিপন্থী ব্যক্তি, প্রার্থী, সমর্থকদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ফেসবুকে আপলোড হলো না কেন? এত সব ‘অনিয়মে’র একটি সুযোগও কি বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের হারানোর কথা? তবে বিএনপি-জামায়াত এর জন্য এই নির্বাচন, যেটিতে তারা পরাজিত হতো বলে শুধু তাদের নয়, তাদের পর্যবেক্ষকদেরও স্পষ্ট ধারণা ছিল, সেটিকে বানচাল করার জন্য বহুবিধ নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- সংঘটনের পরিকল্পনাগুলো নিরাপত্তা বাহিনী বানচাল করতে পেরেছিল এবং নির্বাচনের আগে বিএনপির নাশকতাকারী অপরাধী ক্যাডার ও জামায়াতের জঙ্গীদের গ্রেফতার করা হয়েছিল বলে নির্বাচনটি সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। নতুবা বিএনপি-জামায়াতের দ্বারা ২০১৪-১৫ সালের মতো হাজার হাজার নাশকতামূলক অপঘটনা সংঘটিত হয়ে বহু প্রাণ যেমন যেত, তেমনি নির্বাচনও এমন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হতো না। এসব সংবাদ প্রচারের লক্ষ্য- পশ্চিমা দেশগুলো, যারা প্রধানত আমাদের গার্মেন্টসের ক্রেতা, তাদেরকে বর্তমানে বিপুলভাবে বিজয়ী সরকারের প্রতি বিমুখ করে তোলা এবং অর্থনীতির একটি সমৃদ্ধ খাতকে ধ্বংস করা। যেমনÑ পদ্মা সেতুর অর্থ না আসা সত্ত্বেও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতু থেকে বিশ্ব ব্যাংককে সরিয়ে নিতে সক্ষম হওয়া। বর্তমানে গার্মেন্টস খাতকেও তেমনই শত্রুর সম্মুখীন হতে হচ্ছে ঐ দেশবিরোধী গোষ্ঠীর দ্বারা। উপরন্তু, বাম দলগুলোও কেন বিএনপির ভাষায় কথা বলছে? কেউ কেউ বিএনপির মতো গার্মেন্টসে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে দেশের ক্ষতি করতে চাচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না। তারা কি শান্তি চায় না? বিএনপির মতো নাশকতা-অস্থিতিশীলতা চাইলে তাদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের পার্থক্য কোথায় থাকে? লেখক : শিক্ষাবিদ
×