ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এস এম মুকুল

অর্থকরি খাত হিসেবে আশা জাগাচ্ছে মৌচাষ

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ২৭ জানুয়ারি ২০১৯

অর্থকরি খাত হিসেবে আশা জাগাচ্ছে মৌচাষ

আমরা জানি, মৌমাছি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ফসলের পরাগায়ন ঘটানোর ফলে উৎপাদন বাড়ে। বিশেষ করে ফলের উৎপাদন এক্ষেত্রে বেশি বাড়ে। বাংলাদেশে ৬ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়, ২০ হাজার হেক্টর জমিতে কালিজিরা, ৪৮ হাজার হেক্টর জমিতে ধনিয়া, ২০ হাজার হেক্টর জমিতে তিল এবং বিপুল পরিমাণ জমিতে লিচু উৎপাদিত হয়। যেখানে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে পরাগায়নের মাধ্যমে মৌমাছি দারুণভাবে ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে বাড়ছে মধু আহরণের পরিমাণ। দেশে যে চার হাজার টন মধু উৎপাদিত হয়, তার ৭০ শতাংশ আসে সরিষা থেকে, ১০ শতাংশ লিচুবাগান এবং বাকি মধু অন্যান্য উৎস থেকে। ডিএই -এর এক গবেষণা ও মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের কাছ থেকে পাওয়া জরিপে দেখা গেছে, মৌ চাষের জমিতে অনেক বেশি ফলন বাড়ছে। কোথাও কোথাও ২০ ভাগের বেশি ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। তার মানে মধুর চাষ পরিবেশ ও কৃষির জন্যও উপকারী। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা (এফএও) এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের গবেষণা একই কথা বলছে, মধুর চাষ হয় এমন এলাকায় ফসলের উৎপাদন বেড়ে যাচ্ছে। ২০১৬ সালে ফসল চাষে মৌমাছির ভূমিকা নিয়ে করা এফএওর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মধু আহরণ করতে আসা মৌমাছির কারণে বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আয়তনের জমিতে চাষ হওয়া ফসলের উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, মৌ চাষ হওয়া জমিতে ফসলের ফলন শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে জমির মালিক ও মৌ চাষী উভয়ই লাভবান হচ্ছেন। তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ বাড়ছে মৌচাষে মৌমাছি পালনের মাধ্যমে মধু আহরণকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন শিক্ষিত তরুণরা। এটি খুবই আশাবাদের খবর। তারচেয়েও বড় আশাবাদের ব্যাপারটি হলো- ফসলের জমিতে মধু আহরণের উদ্দেশ্যে তাদের এই মধু আহরণকে কেন্দ্র করে মৌমাছির পরাগায়নের মাধ্যমে বাড়ছে ফসলের ফলন। বিশেষত সরিষা, তিল, তিসি, লিচু, মৌরি, কালিজিরা, ধনিয়া ইত্যাদি ফসলের ফলন ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে সংশ্লিষ্ট এলাকায় মৌ খামারিদের মধু আহরণের কারণে। এজন্য কৃষকরাও খুশি। আশা জাগাচ্ছে মধু দেশে ব্যাপক হারে বাণিজ্যিক মধুর চাষ শুরু হয় ২০১২ সালে। ২০২০ সাল নাগাদ দেশে ১ লাখ টন মধু উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে বিসিক। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে- দেশে মধু উৎপাদনে সরাসরি জড়িত প্রায় ১৮ হাজার মৌচাষীসহ মধু শিল্পে জড়িত প্রায় ২ লাখ মানুষ। কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদফতরের হিসাবে, বাংলাদেশে সাড়ে ৬ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা, ২০ হাজার হেক্টর জমিতে কালিজিরা, ৪৮ হাজার হেক্টর জমিতে ধনিয়া, ২০ হাজার হেক্টর জমিতে তিল ও বিপুল পরিমাণ জমিতে লিচু উৎপাদিত হয়। এই পুরো ক্ষেত্রটিকে মধু আহরণের আওতায় আনতে পারলে ফসলের উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি হবে বলে অনেকের ধারণা। হিসাব মতে, দেশে এখন প্রায় সাড়ে ছয় লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হলেও সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ থেকে মধু সংগ্রহ করা যাচ্ছে। অথচ পুরো সরিষার মাঠ মধু সংগ্রহের আওতায় আনা গেলে উৎপাদন অনেক বাড়ানো সম্ভব। তবে আশার খবর হলো- লক্ষ্য বাস্তবায়নে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিসিকের আওতায় মৌচাষ সংক্রান্ত মধু উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বিষয়ক একটি প্রকল্প মৌচাষীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মানসম্পন্ন মৌ বাক্স সরবরাহ করে। রফতানি হবে শত কোটি টাকার মধু মধুকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম পানীয়, যা একই সঙ্গে সুস্বাদু এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিকারী। নানা ধরনের রোগের ওষুধ হিসেবে মধু খুবই কার্যকর। বেলজিয়ামসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মধু বিশ্বমানের। তত্যানুসন্ধানে জানা যায়, আগে ভারতের ডাবরসহ কয়েকটি কোম্পানি কাঁচামাল হিসেবে বাংলাদেশের মধু কিনে নিত। সেদিন আর নাই, এখন দেশের প্রতিষ্ঠান এপি, প্রশিকা, বাসা, ট্রপিকা হানি, প্রাণসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি মধু প্রক্রিয়াজাত কারখানা স্থাপন করায় খুলে গেছে মধু শিল্পের সম্ভাবনার দ্বার। আশার খবরটি হলো- এসব দেশীয় কোম্পানির মধু ব্র্যান্ড হিসেবে দেশ ও দেশের বাইরের বাজারে সাড়া ফেলেছে। এরই ফলশ্রুতিতে বিশ্ববাজারে মধুবাণিজ্য এখন বেশ জমজমাট। একই সঙ্গে বাংলাদেশেও মধুর জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে- এটিও আশার দিক। আর চাহিদা বাড়ার কারণে মধু উৎপাদনে দেশী উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি পেশা হিসেবে মৌচাষের সঙ্গে যোগ হচ্ছে আমাদের সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজ। স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত মধুর ব্যবসা দেশের বাজারে দ্রুত প্রসার লাভ করছে। কিন্তু বিস্ময়ের খবর হলো- ঢাকা ও বিদেশের বাজারে বেশি বিক্রি হওয়া ভারতের ডাবর ব্র্যান্ডের ‘ডাবর হানি’ মধু কিনে নেয় বাংলাদেশ থেকে। তারমানে বাংলাদেশের ব্রান্ডেড কোম্পানিগুলোর সামনে অনেক সম্ভাবনা আছে এই মধু শিল্পকে কেন্দ্র করে। দেশে উৎপাদন বাড়ার ফলে মধু রফতানির বিরাট সুযোগ তৈরি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আগামী ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে রফতানি হবে শত কোটি টাকার মধু। মধু রফতানির অপার সম্ভাবনাকে সামনে রেখে বিসিক চলতি ২০১৭ সাল থেকে মৌচাষের ব্যাপক সম্প্রসারণের কর্মসূচী নিয়েছে। জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি মধু রফতানি হয়। বিসিক সূত্রে জানা গেছে ইউরোপে বাংলাদেশের মধু বিপণনের লক্ষ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ স্লোভেনিয়ার ঐতিহ্যবাহী মধু উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান মেডেক্সের সঙ্গে বিসিকের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। বিশ্বের বৃহত্তম মধু রফতানিকারক দেশটির নাম চীন। সবচেয়ে বেশি মধু আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- ভারত, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জাপান। নতুন বাজার সৃষ্টি হওয়ায় বাংলাদেশের মধু এখন বিশ্বের বেশ কিছু দেশে রফতানি হচ্ছে। বাংলাদেশের কয়েকটি কোম্পানি ২০১৪ সাল থেকে ভারতে ও জাপানে মধু রফতানি করছে। এখন চেষ্টা চলছে ইউরোপে রফতানির। বিসিএসআইআর’র ল্যাবরেটরিতে বাংলাদেশী মধু পরীক্ষা করে দেখা গেছে, আমাদের দেশের মধুর গুণগত মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। অলওয়েলস মার্কেটিং নামের একটি কোম্পানি ভারতে মধু রফতানি করে এবং এই কোম্পানির মধুর ব্র্যান্ডের নাম ‘ট্রপিকা হানি’। আয়ুর্ভেদিয়া ফার্মাসি (ঢাকা) লিমিডেট জাপানে মধু রফতানি করছে। বাংলাদেশের বাজারে তাদের ব্র্যান্ডের নাম এপি মধু। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্ভাবনা কাজে লাগালে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১ থেকে দেড় লাখ টন মধু বিদেশে রফতানি করা সম্ভব।
×