ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

বাংলারঐতিহ্যের ধারক জামদানি

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ২৭ জানুয়ারি ২০১৯

বাংলারঐতিহ্যের ধারক জামদানি

জামদানি শিল্প বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই শিল্প বাংলাদেশের অহঙ্কার। শিল্পের ভেতরের যে ঐশ্বর্য ছড়িয়ে আছে আমাদের ঐতিহ্যে, তার ধারক হয়ে আজও জনপ্রিয়তায় অনন্য হয়ে আছে জামদানি বয়ন। একসময় মসলিনের পরিপূরক হয়ে আমাদের ফ্যাশন ঐতিহ্যে বসতি গেড়েছিল জামদানি। ক্রমেই তা বাংলার তাঁতিদের আপন মমতায় আর সুনিপুণ দক্ষতায় হয়ে উঠে ঐতিহ্যের পাশাপাশি আভিজাত্যের পোশাক। খ্রিস্টপূর্ব যুগে জামদানির বিকাশ ঘটে। ফারসী শব্দ থেকে আসা জামদানি নামটির ব্যবচ্ছেদ করলে দাঁড়ায়, ‘জামা’ এবং ‘দানি’। জামা শব্দের অর্থ কাপড় এবং দানি শব্দের অর্থ বুটি। অর্থাৎ জামদানি শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো, বুটিযুক্ত কাপড়। রুবি গজনবীর মতে ফরাসী অপর শব্দ জাম-দার অর্থাৎ ফুলকরা বা বুটি দ্বারা খচিত করা থেকে জামদানির নামকরণ। জামদানি প্রসিদ্ধ হয়েছে তার বিখ্যাত জ্যামিতিক ডিজাইনের কারণে। জামদানির ব্যাপারে আরও একটি বিষয় না বললেই নয়, সেটি হলো, জামদানি তৈরির পেছনের কাহিনী। জামদানি তৈরিতে এদেশের মাটি ও আবহাওয়া ও বিশেষ ভূমিকা রাখে। অনেকেই এই জামদানি রূপগঞ্জ ছাড়াও অন্য অনেক জায়গায় বোনার চেষ্টা করেছিলেন। একই সুতা, একই খাটিয়া, একই তাঁতি, কিন্তু স্থান ভিন্ন। হয়নি বোনা জামদানি, পারেনি বুনতে সেই জ্যামিতিক ডিজাইনের জামদানি। আমার দেশের জামদানির এটি একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যা একেবারেই বাংলাদেশের নিজস্ব। যা কখনই অনুকরণ করা যাবে না। ঢাকাই জামদানির ইতিহাস ঢাকার ইতিহাসের চেয়েও পুরনো। ১৬১০ সালে সুবেদার ইসলাম খান যখন তার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন তখনই ঢাকার ইতিহাসের জন্ম। অথচ জামদানির ইতিহাস তারচেয়েও পুরনো। ঢাকার মসলিন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সম্ভবত মুসলমানরাই জামদানির বুনন কর্মটির প্রচলন করেন এবং এখনও তাদের হাতেই এ শিল্প একচেটিয়াভাবে সীমাবদ্ধ আছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকেও বঙ্গ থেকে সোনারগাঁও বন্দরের মাধ্যমে মসলিনের মতো সূক্ষ্ম-বস্ত্র ইউরোপে রফতানি হতো। কেননা, ঢাকা সোনারগাঁও, ধামরাই, বাজিতপুর ছিল জামদানি ও মসলিন কাপড়ের জন্য ঐতিহাসিক স্থান। জামদানি শাড়ির প্রকৃত অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছিল মধ্যযুগের মুসলিম আমলেই। আসলে পারস্য ও মুঘল-এই দুটি মিশ্র সংস্কৃতির ফসল এই শাড়ি। জামদানি বলতে এখন শুধু শাড়ি বোঝালেও সে সময় অর্থাৎ, মুসলিম আমলে জামদানি বলতে স্কার্ফ ও রুমালও বোঝাত। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জামদানির ব্যবসা মুসলমানরাই শুরু করেছেন। দীর্ঘদিন এবং একচেটিয়াভাবে তারাই এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এসেছেন। এটি বাংলার ঐতিহ্যের ধারক। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতেও শতাধিক পণ্য বাংলা থেকে ইউরোপিয়ানরা হামবুর্গ, লন্ডন, মাদ্রিদ, কোপেনহেগেন এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠাত যার মধ্যে জামদানিই সর্বাধিক সমাদৃত ছিল। একসময় শুধুমাত্র গজ কাপড় হিসেবে বোনা হলেও পরবর্তীতে তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে জামদানি শাড়িতে। জামদানি ও তাঁতশাড়ির ফ্যাশন এবং ডিজাইনে বৈচিত্র্য এনে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। তাদের মতে, রফতানি ও বিক্রি বাড়াতে জামদানি শাড়ির দাম সাধারণের নাগালের মধ্যে রাখা এবং ঐতিহ্যবাহী এ শাড়ির রং ও নকশার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে গবেষণা চালানো উচিত। সর্বজন স্বীকৃত জামদানির বহুমুখী ব্যবহার, আন্তর্জাতিক বাজারে সুনাম ও ঐতিহ্যের কারণে জনপ্রিয়তা ও চাহিদা অনেক বেড়েছে। রফতানি হচ্ছে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে বাঙালী। গুণগত মান, রং ও বাহারি ডিজাইনের কারণে বাংলাদেশী জামদানির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালী নারীদের মধ্যে জামদানি শাড়ির প্রচলন বেড়ে চলেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অধিক পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আনাসহ এ পণ্য ভারতের সঙ্গে আমাদের আমদানি রফতানি ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, রফতানি ও বিক্রি বাড়াতে জামদানি শাড়ির দাম সাধারণের নাগালের মধ্যে রাখা এবং ঐতিহ্যবাহী এ শাড়ির রং ও নকশার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে গবেষণা চালানো উচিত।
×