ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জলি রহমান

বিকাশমান জাহাজ নির্মাণ শিল্প

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ২৭ জানুয়ারি ২০১৯

বিকাশমান জাহাজ নির্মাণ শিল্প

জাহাজ নির্মাণ বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় এবং ক্রমবিকাশমান শিল্প। আধুনিক যুগের শুরু থেকে বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণের একটি দীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও স্থানীয়ভাবে তৈরি জাহাজ রফতানি করার মাধ্যমেই মূলত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাহাজ নির্মাণ একটি প্রধান প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ২০০শ’র মতো জাহাজ নির্মাণ কোম্পানি রয়েছে যেগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল ও খুলনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ থেকে জাহাজ রফতানি শুরু হয় ২০০৮ সালে। ঢাকার আনন্দ শিপইয়ার্ড ডেনমার্কে এমভি স্টেলা মরিস নামের ছোট আকারের একটি জাহাজ রফতানি করে। এর পরেই যুক্ত হয় চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। তারা জার্মানির গ্রোনা শিপিং কোম্পানির কাছ থেকে ৮৫ মিলিয়ন ডলারের আটটি জাহাজ নির্মাণের কার্যাদেশ পায়। এ দুটি প্রতিষ্ঠান যখন জাহাজ রফতানিতে যুক্ত হয়, তখন জাহাজ নির্মাণের বিশ্ববাজার ছিল চাঙ্গা। রফতানির বাজার ধরতে তখন এগিয়ে আসে দেশীয় আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। শুধু ২০০৮ সালে ৫০টি জাহাজ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি পায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে পাঁচ বছরের মাথায় ইউরোপে আর্থিক সঙ্কট শুরু হয়ে যায়। বাংলাদেশে উঠতি শিল্পটি বৈশ্বিক মন্দার কারণে আক্রান্ত হয়। কারণ, এই শিল্পে বড় রফতানি আদেশ আসত ইউরোপের দেশগুলো থেকে। আর্থিক সঙ্কটের কারণে এ সময় ইউরোপের ব্যাংকগুলো জাহাজ নির্মাণ খাতে বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়। ফলে ইউরোপের আমদানিকারকরা বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও তাদের অনেক রফতানি আদেশ বাতিল করতে বাধ্য হয়। তবে রফতানি-বাণিজ্যের এ ধাক্কা সামাল দিতে রফতানিমুখী জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বাজারের জন্য জাহাজ নির্মাণে ঝুঁকে পড়ে। কর্মী ছাঁটাই করে খরচ কমিয়ে আনে। পাশাপাশি ইউরোপের বাজারের বদলে আফ্রিকার বাজার ধরার চেষ্টা করে তারা। মধ্যপ্রাচ্যের জাহাজ রফতানির বাজারেও প্রবেশ করে। এ সময় চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে জাহাজ রফতানির বেশ কিছু কার্যাদেশ পায়। এরপরও ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি কেউ। তবে সরকারী নীতি সহায়তায় এই খাত এখন ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছেন উদ্যোক্তারা। এ শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য সুখবর হয়ে আসে সরকারী নীতি ও আর্থিক সহায়তা। তিন বছর কোন ডাউনপেমেন্ট পরিশোধ ছাড়া এবং ১০ বছর মেয়াদে (ত্রৈমাসিক কিস্তিতে) ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিয়েছে অর্থ-মন্ত্রণালয়। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সবপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে অর্থ-মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নেয়। গত ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সব তফসিলি ব্যাংককে এ সিদ্ধান্ত অনুসরণ করার পরামর্শ দেয়া হয়। গত জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ধাপে ধাপে বেশির ভাগ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে। আবার এ খাতে নেয়া ঋণের সুদের ওপর ৪ শতাংশ হারে ভর্তুকি দেয়ারও নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। সুদের ওপর ভর্তুকি প্রদান কার্যকর হলে এই শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছেন উদ্যোক্তারা। বর্তমানে নরওয়েতে রফতানির জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে উচ্চপ্রযুক্তির মাছ ধরার ট্রলার, যার রফতানি মূল্য প্রায় ১৭২ কোটি টাকা। জাহাজটির নির্মাণকাজ শেষ করতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রথম পাঁচ মাসে তথা জুলাই থেকে নবেম্বরে বাংলাদেশ জাহাজ নির্মাণ শিল্প থেকে তিন কোটি চার লাখ ৫০ হাজার (৩০ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন) ডলার আয় করেছে, যা একই সময়ে গত অর্থবছরে ছিল ৫৪ লাখ ৩০ হাজার (৫ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন) ডলার অর্থাৎ এ খাতে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৪৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাংলাদেশের আগে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জাহাজ নির্মাণশিল্প সুরক্ষা দিতে নানা পদক্ষেপ নেয়। যেমন ভারত সরকার ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত জাহাজের রফতানি মূল্যের ওপর ২০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা অনুমোদন করেছে। চীনের উদ্যোক্তারা স্বল্প সুদে ঋণের পাশাপাশি নিজেদের কাঁচামাল ব্যবহারে ভর্তুকি পাচ্ছে। মন্দা থেকে এই ভারি শিল্প খাতকে সুরক্ষা দিতে এসব উদ্যোগ নেয়া হয় দেশগুলোতে। বর্তমানে এই শিল্পে প্রায় ৫০ হাজার দক্ষ এবং ১ লাখ আধাদক্ষ কর্মী নিয়োজিত রয়েছে। দেশে আনুমানিক ১০ হাজার টন ক্ষমতার আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জাহাজ তৈরির ক্ষমতাসম্পন্ন প্রায় ১১টি স্থানীয় শিপইয়ার্ড রয়েছে। রফতানির নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প। সরকারের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা এবং পুঁজি বিনিয়োগকারীরা এ খাতে মনোযোগী হলে আগামীতে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক খাতে নতুন এক বিপ্লবের সূচনা ঘটবে। প্রতিবছর আয় হবে কয়েক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। এ খাতে কর্মসংস্থান হবে লক্ষাধিক দক্ষ শ্রমিকের। শুধু তাই নয়, জাহাজ নির্মাণে বাংলাদেশ পরিপূর্ণ সুযোগ পেলে এ খাতটি দেশের বিদ্যমান সব ক’টি খাতকে ছাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রথম স্থানে চলে যাবে। সরকারী-বেসরকারী এবং জাহাজ নির্মাণ খাতে পুঁজি বিনিয়োগকারী সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এ খাতের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বাংলাদেশের গর্বিত অতীত আছে। বলা যায়, জাহাজ নির্মাণে বাংলাদেশ আবার সেই গৌরবোজ্জ্বল অতীত ফিরিয়ে আনার পথে। এদেশে নির্মিত জাহাজ বেশ উন্নত বলে ইউরোপে প্রশংসিত হয়েছে। নানা কারণেই জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য বাংলাদেশ অন্যতম স্থান হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় তুলনামূলক কম খরচ। জাহাজ নির্মাণে প্রচুর দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণে স্বল্প খরচে প্রচুর শ্রমিক পাওয়া যায়। আর এ কারণে নির্মাণ খরচ অনেক কম। দক্ষিণাঞ্চল সমুদ্রবেষ্ঠিত হওয়ায় ভৌগোলিক সুবিধা এ সম্ভাবনার ক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা আন্তর্জাতিক নৌ-সংস্থা আইএমও’র জারিকৃত আইএসপিএস কোডের কারণে ২৫ বছরের বেশি পুরনো জাহাজগুলো আগামী বছর থেকে চলাচল করতে পারবে না। আইএমও’র এ নির্দেশনার কারণে কেবল ইউরোপীয় দেশগগুলোকেই কিছুদিনের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার নতুন জাহাজ বাদ দিতে হবে এবং এর স্থলে নতুন জাহাজ যোগ করতে হবে। আর এ জাহাজ নির্মাণে বাংলাদেশই হতে পারে অন্যতম বিকল্প। কারণ বিশ্বের অন্যতম জাহাজ নির্মাণকারী দেশ চীন, ভিয়েতনাম, ভারতের সব ক’টি শিপইয়ার্ড আগামী ৫ বছরের জন্য বুকড হয়ে আছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিলে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার উন্মোচিত হবে বলে আশা করা যায়।
×