ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রাচ্যনাট স্কুলের ‘খোয়াবনামা’

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ২৭ জানুয়ারি ২০১৯

প্রাচ্যনাট স্কুলের ‘খোয়াবনামা’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশের থিয়েটারের বিস্তারে এবং দক্ষ থিয়েটারকর্মী তৈরিতে সুদীর্ঘ ১৯ বছর ধরে কাজ করছে প্রাচ্যনাট স্কুল অব এ্যাকটিং এ্যান্ড ডিজাইন। এই স্কুলের ৬ মাসের পাঠ্যসূচীতে একজন প্রশিক্ষণার্থী থিয়েটারের সকল আনুষঙ্গিক বিষয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা পায়। এরই মধ্যে এই স্কুলের ৩৪টি ব্যাচ সফলভাবে কোর্স সম্পন্ন করেছেন। ৩৫তম ব্যাচেরও সমাপনী হতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে আগামীকাল সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে ৩৫তম ব্যাচের সনদপত্র বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস এবং অভিনেত্রী বিপাশা হায়াত। নাট্য প্রদর্শনী ছাড়াও ঐ দিন মিলনায়তনের বাইরে থাকবে উন্মুক্ত পোস্টার প্রদর্শনী। ৩৫তম ব্যাচ তাদের সমাপনী প্রযোজনা হিসেবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসের (অংশবিশেষ) উপস্থাপন করবে। উপন্যাসটির নাট্যরূপ দিয়েছেন মোঃ শওকত হোসেন সজীব। নির্দেশনা দিয়েছেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। সঙ্গীত নীল কামরুল, কোরিওগ্রাফি স্নাতা শাহরিন, মঞ্চ ও আলোক ভাবনা এবি এস জেম। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করবেন ফজলে রাব্বী, সৌমিক কুমার সাহা জয়, রথি দাশগুপ্ত, সাদিয়া জান্নাত জয়া, উচ্ছ্বাস তালুকদার, সাগর বড়ুয়া, মাহবুব উর রহমান, জাহারুল ইসলাম হৃদয়, জোনায়েত ফেরদৌস প্রান্ত, সাইম বিন মুজিব, আব্দুল মুকিত রাজু, শায়লা মারিয়াম হোসেন, মনোয়ার হায়দার খান, সাজ্জাদুর রহমান, আহনাফ আবিদ রহমান, ফাইরুজা কৃষ্টি, শোয়েব আহম্মেদ শুভ, স্বর্ণালী রায় পুতুল, সাদিয়া সুলতানা হোসেন, মোঃ রাসেল কবির নাজমুল, আফাজ আল আরাফ, বৃষ্টি আক্তার, সিনথিয়া হাই, সৌন্দর্য প্রিয়দর্শিনী, ঊর্মি সাহা রায়। ‘খোয়াবনামা’ নাট্যকাহিনীতে তুলে ধরা হয়েছে মেলাদিন আগেকার কথা। কাতলাহার বিলের ধারে ঘন জঙ্গল সাফ করে বাঘের ঘাড়ে জোয়াল চাপিয়ে আবাদ শুরু করার দিনের এক বিকালবেলায় মজনু শাহের অগুনতি ফকিরের সঙ্গে মহাস্থান গড়ের দিকে যাওয়ার সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেপাই সর্দার টেলারের গুলিতে মারা পড়ে মুনসি বয়তুল্লাহ শাহ। কাতলাহার বিলের দুই ধারের গিড়িরডাঙা ও নিজগিড়িরডাঙার মানুষ সবাই জানে, বিলের উত্তরে পাকুড়গাছে আসন নিয়ে রাতভর বিল শাসন করে মুনসি। দূরে কোথাও ভূমিকম্প হলে যমুনা বদলে যায়। বন্যায় ভেঙ্গে পড়ে কাতলাহারের তীর। মুনসির নিষ্কণ্টক অসিয়তে চাষীরা হয় কাতলাহার বিলের মাঝি। সময়ের আবর্তনে বিলের মালিকানা চলে যায় জমিদারের হাতে। মুনসির শোলোকে শোলোকে মানুষের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে বেড়ায় চেরাগ আলি ফকির। তমিজের বাপ শোলোক শুনে আর ঘুমের মধ্যে বিলে গিয়ে কাদায় পা ডুবিয়ে দেখতে চায় পাকুড়গাছের মুনসিকে। ভবানী পাঠকের সঙ্গে পূর্বপুরুষের জের টেনে বৈকুণ্ঠনাথ গিরি প্রতীক্ষা করে ভবানীর শুভ আবির্ভাবের। তমিজ দেখে জমির স্বপ্ন। আর চেরাগ আলির নাতনি কুলসুম খোয়াবে কার কায়া যে দেখতে চায় তার দিশা পায় না। তেভাগার কবি কেরামত শেষ পর্যন্ত আটকে পড়ে শুধুই নিজের কোটরে; সে নাম চায় বৌ চায় ঘর চায়। কোম্পানির ওয়ারিশ ব্রিটিশের ডা-া উঠে আসে দেশী সাহেবদের হাতে। দেশ আর দেশ থাকে না, হয়ে যায় দু’টো রাষ্ট্র। দেশী সাহেবরা নতুন রাষ্ট্রের আইন বানায়, কেউ হয় টাউনবাসী, কেউ হয় কন্ট্রাক্টর। আবার নিজদেশে পরবাসী হয় কোটি কোটি মানুষ। হিন্দু জমিদার নায়েব চলে যাওয়ার পরও আজাদ পাকিস্তানে জমি আর বিলের মানুষ নিজেদের মাটি আর পানির পত্তন ফিরে পায় না। পাকুড়গাছ নাই। মুনসির খোঁজ করতে করতে চোরাবালিতে ডুবে মরে তমিজের বাপ। ভবানী পাঠক আর আসে না। বৈকুণ্ঠ নিহত হয় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায়। জেলেরা নিজেদের ইচ্ছেমতো মাছ ধরতে পারে না কাতলাহার বিলে। কাতলাহারের জেলেদের সঙ্গে যমুনার জেলেদের মাছ ধরা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সেখানে তমিজের হাতে খুন হয় এক জেলে। ক্ষমতাবান ভদ্রলোকের বাড়িতে চাকর হয়ে বিল দ্বন্দ্বের আসামি তমিজ পুলিশকে এড়ায়। কিন্তু তার কানে আসে কোথায় কোথায় চলছে তেভাগার লড়াই। নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে তমিজ বেরিয়ে পড়ে তেভাগার খোঁজে। ফুলজানের গর্ভে তমিজের ঔরসজাত মেয়ে সখিনাকে নিয়ে ফুলজান ঠাঁই নেয় কোথায়! কিন্তু মোষের দীঘিরপাড়ে শুকনা খটখটে মাঠের মাটিতে দাঁড়িয়ে কাতলাহার বিলের উত্তরে সখিনা দেখতে পায় জ্বলন্ত হেঁসেলে বলকানো ভাত। খোয়াবনামার জিম্মাদার তমিজের বাপের হাত থেকে খোয়াবনামা একদিন বেহাত হয়ে গিয়েছে। এখন সখিনার খোয়াব। খোয়াবনামা স্বপ্নের ব্যাখ্যা তা। কিন্তু স্বপ্নের ব্যাখ্যায় যা বিবেচ্য তা স্বপ্ন নয়, স্বপ্নদেখা মানুষ। নির্দেশক কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন বলেন অনেকদিন ধরে বড় পরিসরে কাজের একটা পরিকল্পনা, আর তার সঙ্গে প্রাচ্যনাটের বিশ বছর, সবকিছু মিলে মাথায় আসলো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় প্রদত্ত নাট্য প্রণোদনা পাওয়ায় আরও তোড়জোড়ের সঙ্গে কাজে নেমে পড়া। দলের জন্য ‘খোয়াবনামা’ করার আগে তার প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে প্রাচ্যনাট স্কুলের সমাপনী অনুষ্ঠানে ‘খোয়াবনামা’র কিছু অংশ উপস্থাপন। এতো বিস্তারের একটা উপন্যাসের মঞ্চে উপস্থাপনা খুবই দুরূহ কাজ। একটু একটু করেই আগাতে চাই। শুরুটা হোক, তারপর নিশ্চয়ই গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে। এতে যারা অভিনয় করছে বা যা অভিনীত হচ্ছে ভালমন্দ এখনই বিচার করতে না বসি। এই অভিনয়ের প্রেরণা তাদের পথ দেখাক আর তাদের প্রেরণা আমাদের উদ্দমী করে তুলুক, পথ দেখাক, তবেই না আমাদের খোয়াবগুলো পূর্ণতা পাবে। জয় হোক থিয়েটারের।
×