ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘আগামীতে ৪০০ মিটারে রেকর্ড গড়ে স্বর্ণ জিততে চাই’

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ২৭ জানুয়ারি ২০১৯

‘আগামীতে ৪০০ মিটারে রেকর্ড গড়ে স্বর্ণ জিততে চাই’

রুমেল খান ॥ ছোটখাটো ও একেবারেই শুকনো গড়নের কৃষ্ণকলি কন্যাটির চেহারা দেখলেই মনে হবে এ মেয়ে আর যাই হোক কোন প্রতিযোগিতায় তাম্রপদকও জিততে পারবে না। কিন্তু শুনলে অবাক হবেন মেয়েটি সবসময় স্বর্ণই জেতে। আর কালেভদ্রে জেতে রূপা। সদ্যসমাপ্ত জাতীয় এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে বেশি ৪টি স্বর্ণ জিতেছে মেয়েটি, সেই সঙ্গে একটি রূপাও! বলতে গেলে প্রতিযোগিতার সেরা ক্রীড়াবিদ এই মেয়েটিই, যার নাম সুমি আক্তার। আগেরদিন সুমি জিতেছিলেন তিনটি স্বর্ণ। মহিলাদের ৪০০, ১৫০০ এবং ৩০০০ মিটারে। শনিবার তার ছিল আরও দুটি ইভেন্ট। চেয়েছিলেন দুটিতেই জিততে। কিন্তু অল্পের জন্য হয়নি তার আশা পূরণ। একটি স্বর্ণ ও একটি রৌপ্য জিতেছেন। স্বর্ণ জেতেন ৮০০ মিটারে। আর রৌপ্য জেতেন ৪ গুণিতক ৪০০ মিটার দলগত রিলেতে। রিলে দৌড় শেষ হবার পর সুমির কাছে যেতেই জানালো, ‘গত বছরের জুলাইয়ে সামার এ্যাথলেটিক্সে জিতেছিলাম ৪টা স্বর্ণ ও ১টি রৌপ্যপদক। এবারের জাতীয় এ্যাথলেটিক্সেও তাই। আমার জানা মতে, এই প্রতিযোগিতায় আমিই সবচেয়ে বেশি স্বর্ণপদক জিতেছি। সামার চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা এ্যাথলেট হয়েছিলাম, আশাকরি ন্যাশনালেও সেরা এ্যাথলেট হব।’ শনিবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জাতীয় এ্যাথলেটিক্সের সর্বশেষ ইভেন্টটি ছিল মহিলাদের ৪ গুণিতক ৪০০ মিটার দৌড়। এই ইভেন্টে শুরু থেকেই ভাল পজিশনে থেকেও সুমির সেনাবাহিনী দ্বিতীয় হয়ে স্বর্ণপদক হারায় (স্বর্ণ জেতে নৌবাহিনী)। স্বর্ণ জিতলে সুমির স্বর্ণসংখ্যা দাঁড়াতো ৫-এ। সেটা না হওয়াতে ক্ষণিকের জন্য সুমির মনটা আক্রান্ত হয়েছিল বিষণœতায়। কিন্তু পরক্ষণেই যখন জানতে পারেন তার দল সেনাবাহিনী এই প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তখন মুহূর্তেই সব কষ্ট দূর হয়ে যায় তার। ‘স্বর্ণ জিততে না পারায় কোন দুঃখ নেই, কারণ আমার সেনাবাহিনী চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আরও বেশি খুশি হয়েছি নৌবাহিনীকে হারিয়ে সেরা দল হতে। কারণ গত সামার চ্যাম্পিয়নশিপে এই নৌবাহিনীর কাছেই আমরা হেরে রানার্সআপ হয়েছিলাম।’ মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার মেয়ে সুমি। দুলনা বিএম উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তেন, সে স্কুলের সালাউদ্দিন স্যারের উৎসাহেই এ্যাথলেটিক্স খেলা শুরু করেন। জেলা পর্যায়ের এ্যাথলেটিক্স দিয়েই শুরু এবং শুরু থেকেই চোখ ধাঁধানো সাফল্য। তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়তেন সুমি। এখন ¯œাতকে পড়েন (উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে)। তারপর বিজেএমসিতে যোগ দেন সুমি। ‘ওখানে আমার কোচ ছিলেন গোপাল স্যার। তারপর যোগ দিই সেনাবাহিনীতে ২০১৫ সালে (বর্তমানে সৈনিক পদে কর্মরত)। কোচ ছিলেন ফারুক স্যার। তিনিই আমাকে ১০০ মিটার বাদ দিয়ে দূরপাল্লার দৌড় যেমন ৪০০, ৮০০, ১৫০০, ৩০০০ মিটার দৌড়ে খেলতে পরামর্শ দেন। আমি অবশ্য তখন শুধু ৮০০ মিটারে খেলতাম। এরপর থেকেই লাগাতার প্রতিটি আসরে অংশ নিয়ে চারটি করে গোল্ড জিতে আসছি।’ সামার এবং ন্যাশনাল প্রতিযোগিতা মিলে ২১ বছর বয়সী সুমির মোট স্বর্ণসংখ্যা কপালে চোখ উঠিয়ে দেয়ার মতো ২০টি। দরিদ্র কৃষক বাবার মেয়ে সুমিরা দুই বোন, এক ভাই। সুমি সবার ছোট। বড় ভাই বিবাহিত। বেসরকারী একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে তিনিই সংসার চালান। সুমি ভাগ্যবতী এ জন্য, শুরু থেকেই তার খেলাধুলা নিয়ে কোন বাধা দেননি বাবা-মা, বরং উৎসাহ দিয়েছেন। ভবিষ্যত লক্ষ্য? ‘আমার ক্যারিয়ারের ২০ স্বর্ণপদকের একটি রেকর্ডও টাইমিং গড়ে আসেনি। এ জন্য আমি চাই আমার প্রিয় ইভেন্ট ৪০০ মিটারে রেকর্ড টাইমিং গড়ে স্বর্ণ জেতার।’ ইন্দোনেশিয়া, ইরান এবং ভারতে গিয়ে মোট চারবার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন সুমি। ওখানে তার সেরা সাফল্য হলো ৪০০ মিটারে চতুর্থ হওয়া। সেনাবাহিনীতে অনুশীলনের জন্য ভাল সুযোগ-সুবিধা আছে বলে জানান সুমি, ‘এছাড়া বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেও এসে আমরা অনুশীলন করতে পারি। ফেডারেশন যদি আমাদের দীর্ঘমেয়াদী ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ দেয় তাহলে নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আমি ভাল ফল করতে পারা।’ বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের এ্যাথলেটিক ট্র্যাক নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সুমি, ‘রানিং সু পরে দৌড়ের সময় যখন স্পিড বাড়াই, তখন ছেঁড়া ট্যাকে সু আটকে যায়। এতে বড় ধরনের ইনজুরিতে পড়তে পারি। আশাকরি পরেরবার খেলতে আসলে ভাল-উন্নত ট্র্যাক যেন দেখতে পাই।’ নারী কিংবা পুরুষ। দেশের অধিকাংশ এ্যাথলেটই আসেন নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। ফলে জন্ম থেকেই তাদের বেশিরভাগই ভোগেন পুষ্টিহীনতায়। যে কারণে এই ইভেন্টে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মেলে না উল্লেখযোগ্য কোন সাফল্য। তাই সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ্যাথলেটদের পুষ্টি ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ে একটি আলাদা পরিকল্পনার দাবি খেলোয়াড়দের ও বিশ্লেষকদের। সেই সঙ্গে ফেডারেশনকে সুমি পরামর্শ দিলেন একজন স্থায়ী পুষ্টিবিদ নিয়োগে। অলিম্পিক, এশিয়াড কিংবা এসএ গেমসের এ্যাথলেটিক্স ইভেন্টে পদক জয়ের স্বপ্ন ভুলে যান। মাত্র ৩৪ কেজি ওজনের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ্যাথলেট সুমি আক্তারকে দেখুন। ২০ স্বর্ণজয়ী দেশসেরা এই এ্যাথলেট ভুগছেন মারাত্মক পুষ্টিহীনতায়। জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণজয়ে তৃপ্ত এসব এ্যাথলেটের শ্যেন দৃষ্টি আন্তর্জাতিক আসরেও ভাল করার। তবে সেক্ষেত্র বড় বাধার নাম ফিটনেস সমস্যা। আর যার মূলে রয়েছে এই পুষ্টিহীনতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশের এ্যাথলেটদের প্রায় ৮৫ ভাগই ভোগেন পুষ্টিহীনতায়। যার জন্য মেলে না কাক্সিক্ষত সাফল্য। এ সমস্যার উত্তরণে ফেডারেশনের পাশাপাশি কাজ করার তাগিদ দিলেন সংশ্লিষ্ট সংস্থাকেও। আলাদা করে নিয়োগ দিতে হবে একজন পুষ্টিবিদও। এখন দেখার বিষয়, আগামীতে নিজের পুষ্টিহীনতা ঘুঁচিয়ে কতটা সাফল্য পান সুমি।
×