ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিভিন্ন মহলের শঙ্কা

রোহিঙ্গাদের সহজে ফিরিয়ে নেবে না মিয়ানমার

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২৭ জানুয়ারি ২০১৯

রোহিঙ্গাদের সহজে ফিরিয়ে নেবে না মিয়ানমার

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বিশ্বশক্তির কার্যকর চাপ ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুর আক্ষরিত অর্থে কোন যে সমাধান নেই তা এখন সুস্পষ্ট। ইতোমধ্যে দেশের উচ্চসহ সকল মহলে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে এই বলে যে, বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সহজে ফিরিয়ে নেবে না। আর রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশ থেকে ফিরে যাবে না। ফলে বাংলাদেশের ওপর ভর করে আছে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা, যারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সে দেশের সেনা বর্বরতার মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। আর বাংলাদেশ মানবিক কারণে এদের অন্ন বস্ত্র ও বাসস্থানের সুবিধা দিয়ে প্রাণে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইতোপূর্বে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেও তা বাস্তবায়নের পথ থেকে পিছিয়ে গেছে। আর প্রত্যাবাসনের একটি দিনক্ষণ ঠিক হলে ওইদিনই হাজার হাজার রোহিঙ্গা অভিন্ন কণ্ঠে জানান দিয়েছে তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না। সে থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন যে থমকে গেছে তা থেকে উত্তরণের আর কোন আভাস মিলছে না। অর্থাৎ কার্যত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ভেস্তে গেছে। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ সাময়িকভাবে বসবাসের জন্য হাতিয়ার ভাসানচরে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছে। এ আবসন প্রকল্পেও রোহিঙ্গাদের নেয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। ভাসানচর প্রস্তুত। কিন্তু কোথায় যেন গোল বেঁধেছে। গত সংসদ নির্বাচনের আগেই প্রায় একলাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার একটি কর্মসূচী ছিল। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর সরেজমিনে ভাসানচর পরিদর্শনের কথা ছিল। সেটিও পিছিয়ে গেছে। এমনিতর পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার মিয়ানমারে নিয়োজিত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক দূত ইয়াং হি লির নেতৃত্বে অপর তিন সদস্য ভাসানচরে নবপ্রতিষ্ঠিত বাসস্থান প্রকল্প পরিদর্শন করে গেছেন। প্রকল্প নিয়ে তাদের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ইয়াং হি লি শুক্রবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে যে বার্তা দিয়েছেন সেটাও স্থানান্তর প্রক্রিয়ার বিপক্ষে। তিনি বলেছেন, স্থানান্তরের আগে রোহিঙ্গাদের সেখানে পরিদর্শনে নিয়ে তাদের মতামত গ্রহণ করতে হবে। অথচ, বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, গোটা বাংলাদেশে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে নৌবাহিনীর একক নেতৃত্বে সরকারী তহবিলের প্রায় ২৩শ কোটি টাকার এমন দৃষ্টিনন্দন বসবাসযোগ্য প্রকল্প এ পর্যন্ত আর কোথাও গড়ে তোলা হয়নি। এরপরও কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফে রোহিঙ্গা ভার কিছুটা হলেও কমাতে সরকারী উদ্যোগ কি ভেস্তে যাবে-এমন প্রশ্নও সংশ্লিষ্ট মহলগুলোতে ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাসানচরে সাময়িকভাবে থাকার জন্য রোহিঙ্গাদের যে বাসস্থান প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে জাতিসংঘের নির্দেশনার চাইতেও অনেকাংশে বাড়তি করা হয়েছে। এদেশে ঘূর্ণিঝড়ের শতবছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে এ প্রকল্প নৌবাহিনীর সহায়তায় গড়ে তোলা হয়েছে। পুরো দ্বীপে স্থাপন করা হয়েছে সোলার সিস্টেম। ফলে রাতের আলোতে ঝলমল পরিবেশ আকাশ থেকে প্রতিনিয়ত লক্ষণীয় হচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর যে বর্বরতা শুরু হয় তাতে প্রাণ হারায় অসংখ্য রোহিঙ্গা। এ প্রক্রিয়ায় প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ সরকার তাদের আশ্রয় দিয়েছে। দেশী ও বিদেশে বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা এবং এর পাশাপাশি বিভিন্ন রাষ্ট্রের আর্থিক ও সাহায্য সামগ্রী দিয়ে এদের প্রাণে বেঁচে রাখার ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের পক্ষে ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক দরবারে দফায় দফায় আবেদন নিবেদন করা হয়েছে এ ইস্যুর কার্যকর সমাধানে। বিশ্ব শক্তির কয়েকটি দেশ ছাড়া গোটা পৃথিবী একযোগে রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে। আহ্বান জানানো হয়েছে এদের নাগরিকত্বসহ সকল সুযোগ সুবিধা দিয়ে ফিরিয়ে নেয়ার। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা সারাবিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে শক্তিশালী কয়েকটি দেশের নেতিবাচক ভূমিকার কারণে সবই নিস্ফল হয়ে আছে। বিষয়টি অমানবিক হলেও সেটাই এখন বাস্তবতা। এ অবস্থায় মিয়ানমারে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি দমনের নামে রাখাইনে আবারও সেনা অভিযান শুরু হয়েছে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এর আগে রোহিঙ্গাদের দমনে আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা সেলভেশন আর্মি) দমনের নামে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতম দমন নিপীড়ন চালানো হয়েছে। ফলে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এখন যখন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ইস্যুটি সর্বাগ্রে চলে এসেছে এবং মিয়ানমারও স্বীকার করে নিয়েছে তাদের দেশ থেকে চলে আসা নাগরিকদের তারা ফিরিয়ে নেবে। তখন আবারও পরিস্থিতি গোলমেলে করে তোলা হয়েছে। ফলে শঙ্কিত রোহিঙ্গারা এখন নিজ দেশে ফিরে যেতে চায় না। এছাড়া বাংলাদেশ তাদের প্রতি যে মানবিক আচরণ দেখিয়েছে তাতে তারা বিমুগ্ধ। এমন পরিবেশ পেয়ে ওরা ফিরে যাওয়ার ভাবনা থেকে দিন দিন সরে যাচ্ছে। এর ফলে কক্সবাজারের টেকনাফ উখিয়া অঞ্চলে নেমে এসেছে এক মহাবিপর্যয়। এলাকার স্থায়ী বাসিন্দারা নজিরবিহীন ক্ষতির মুখে রয়েছে। সরকারী সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন দিয়ে উখিয়া টেকনাফ অঞ্চলের বাসিন্দারা এখন দিশেহারা। জমিজমা রাস্তাঘাট, পাহাড় ও বনাঞ্চল সর্বত্র বড় ধরনের ক্ষতিসাধন হয়ে গেছে। যা সহজেই পূরণ করা যাবে না। উখিয়া টেকনাফ অঞ্চলের পরিস্থিতি পর্যটন নগরী কক্সবাজারকেও ক্ষতির মুখে ফেলছে। রোহিঙ্গাদের যত্রতত্র যাতায়াত ও কাজকর্মে নিয়োজিত হওয়া ভিন্ন পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পরিবারে প্রতিনিয়ত সদস্যসংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। যা উদ্বেগজনক। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে কম বেশি শতাধিক এনজিও কাজ করছে। এক্ষেত্রে সুবিধাভোগী কিছু এনজিও রয়েছে বলেও এন্তার অভিযোগ। এসব এনজিও নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনবিরোধী কর্মে লিপ্ত রয়েছে, যা কখনও কাম্য হতে পারে না। এসব এনজিওর বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে সরকারী পর্যায়ে ব্যবস্থা নেয়ার কথা থাকলেও তা অকার্যকর রয়েছে। এদিকে, আশ্রিত রোহিঙ্গা শিবিরে নানা ধরনের অপকর্ম দিন দিন বাড়ছে। শুধু তাই নয়, যে মাদকের বিরুদ্ধে সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, সে মরণনেশা মাদক ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের মধ্যে সংখ্যাধিক্যে রয়েছে রোহিঙ্গারা। সব মিলিয়ে বলা যায় আশ্রিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের ঘাড়ে যেভাবে চেপে বসেছে তা থেকে পরিত্রাণের পথ খুবই বন্ধুর। বিষয়টি অনুধাবনে এনেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন সিলেটে শনিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের যে ফিরিয়ে নেবে না তা এখন স্পষ্ট। বাস্তবেও পরিস্থিতি তাই। মিয়ানমার সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেছে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে। এখন তারা সফল। তাদের এ কাজে ইন্ধন দিয়েছে চিহ্নিত কয়েকটি দেশ, যা বিশ্ব দরবারে ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। সঙ্গত কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্লেষকদের ধারণা, বিশ্বশক্তির কার্যকর চাপ ছাড়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা কখনও সম্ভব হবে না। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা এখন এদেশের জন্য গলার কাটা হিসাবে পরিণত হয়েছে।
×