ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বসন্তের আগেই রঙিন ফুল, ভরপুর বাগান

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ২৭ জানুয়ারি ২০১৯

বসন্তের আগেই রঙিন ফুল, ভরপুর বাগান

মোরসালিন মিজান ॥ শীতের বিকেল। একটা মিষ্টি রোদ। হঠাৎই কী মনে করে যেন রমনা পার্কে ঢুকে পড়া। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই সবুজ ভ‚মি অসংখ্যবার চষে বেড়ানো হয়েছে। এরপরও শনিবারের দেখাটা আলাদা মনে হলো। যেদিকে চোখ যায় ফুল আর ফুল। একসঙ্গে ফুটে আছে! দেখে শিশুর মতো নেচে ওঠে মন। সরু ওয়াকওয়ে থেকে নেমে তাই ফুলের কাছে ছুটে যাওয়া। পায়ের নিচে শুকনো আধমরা ঘাস। সেই ঘাস মাড়িয়ে বাগানের কাছে পৌঁছতেই নতুন মনে হয় চারপাশটাকে। রঙিন মনে হয়। বার্তাটা পরিষ্কা- ফাল্গুন আসছে। ভেতরে অদ্ভুত একটা পুলক অনুভূত হয়। বসন্ত বাতাসে সইগো বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে...। রমনাজুড়ে, হ্যাঁ, বসন্তের বাতাস। ইতোমধ্যে মাঘের প্রায় অর্ধেক সময় গত হয়েছে। বাকিটুকু দেখতে দেখতে চলে যাবে। প্রকৃতি সে হিসাব রাখে বৈকি। এ কারণেই যেন সেরে রাখছে প্রস্তুতি! ৬৮ দশমিক ৫ একর আয়তনের এই উদ্যানে অসংখ্য প্রজাতির বৃক্ষ। কী কী গাছ আছে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন- নেই কোন্টি? সেই তুলনায় ফুলের গাছ একটু কম। অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গাগুলোতে আলাদা করে বাগান করা হয়েছে। বসন্তের আগমনী টের পেয়ে ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে বাগান। গোলাপ, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, জার্বেরা, ডালিয়া, সূর্যমুখী, স্যালভিয়া ইত্যাদি ফুলের গাছ ভূমিভাগের খুব কাছাকাছি থেকে নিজেদের মেলে ধরেছে। ফুলগুলোও ঘন হয়ে ফুটেছে। মুগ্ধ চোখে দেখছেন সবাই। একেক জাতের ফুল দিয়ে একেকটি স্বতন্ত্র বাগান করা হয়েছে। একটি বাগানে শুধুই চন্দ্রমল্লিকা। বড় বড় ফুলের ভারে গাছ কিছুটা মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ছিল। তাই নরম কান্ডের সঙ্গে সরু খুঁটি জুড়ে দেয়া হয়েছে। সাদা, হলুদ, বেগুনি ও গোলাপী রঙের একটিই ফুল। এত এত রঙের চন্দ্রমল্লিকা দেখতে কী যে ভাল লাগে! জার্বেরাও চন্দ্রমল্লিকার মতো কিছুটা। লাল, হলুদ, কমলা, সাদা, গোলাপী, বেগুনি ইত্যাদি রঙ নিয়ে ফুটেছে। আলাদা করে বলতে হয় গোলাপের কথা। একাধিক বাগানে সদ্য ফোটা ফুল। কিছু ফুল। কিছু এখনও কলি। ফোটার অপেক্ষা। গাছগুলো নির্ধারিত দূরত্বে লাগানো হয়েছে। সংখ্যায়ও খুব বেশি হবে না। তবে লাল টুটটুকে গোলাপ দেখতে ভিড় করেছিলেন ফুলপ্রেমীরা। গাঁদা ফুলেরও প্রকৃত সময় এখন। বিভিন্ন বাগানে ফুলটি ফুটে আছে। কোনটি হলুদ দেখতে। কোনটি কমলা রঙের। দূর থেকে দেখলে মনে হয় রঙের ফোয়ারা। গাঁদা ফুলের কাঁচা ঘ্রাণেও কী যেন আছে। শুকে দেখতেই হলো আবার। সত্যি কী যেন আছে! স্যালভিয়া ফুলের রংটা শুধু লাল নয়। গাড় লাল। মাটি থেকে সামান্য উঁচুতে ফুটে আছে। গাছ দেখা যায় না। পুরোটাই ফুলেল মনে হয়। অসংখ্য ফুল পাশাপাশি ফুটে আছে। অনেক দূর থেকে চোখ যায়। সঙ্গত কারণেই দারুণ আকর্ষণ করে। কোন কোন জায়গায় আবার অনেক জাতের ফুল। হাঁটতে হাঁটতে উদ্যানের মাঝামাঝি আসলে এমন একটি চত্বরের দেখা মেলে। চত্বরটি ঘিরে ফুল গাছ লাগানো হয়েছে। একেক অংশে একেক রঙের ফুল অঙ্গনটিকে অনেক বেশি নান্দনিক করে তুলেছে। রমনা পার্কে আছে জারুল, সোনাপাতি, কামিনী ইত্যাদি গাছও। সবকটিতে ফুল এসেছে। এগুলো ঠিক বাগানের ফুল নয়। অপেক্ষাকৃত বড় গাছ। উদ্যানের বিভিন্ন অংশে দেখা গেল হলুদ সোনাপাতি। কড়া হলুদ রঙে ‘মাইক ফুল।’ থোকা থোকা ফুলে বসন্তের আগমনী। জারুলও কয়েকটি রঙে নিজেকে প্রকাশ করছে। ফুল দিয়েছে দীর্ঘ আকৃতির পথতরু নাগেশ্বর। অনেক উঁচু বৃক্ষে ধবধবে সাদা ফুল। মাঝখানে সোনালি রঙের এক থোকা পরাগ কেশর। তুলোর মতো ফুল অনেকেই দেখেননি আগে। আগ্রহ নিয়ে দেখছিলেন তারা। পলাশের কথা না বললেই নয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুলটি এবার প্রথম দেখা হয়েছিল। তার পর দেখা হলো রমনায়ও। শীতে পাতা ঝড়ে যাওয়ায় ফুলগুলো বিশেষভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। গাঢ় লাল ফুলে ফাগুনের আগুন! কবিগুরুর ভাষায়: ওরে পলাশ, ওরে পলাশ,/রাঙা রঙের শিখায় শিখায় দিকে দিকে আগুন জ্বলাস...। উদ্যানজুড়ে আরও অনেক ফুল। বহু জাত পাত। পার্কের দর্শনার্থীরা একটি দেখা শেষ করে অন্যটির দিকে ছুটে যাচ্ছিলেন। ছবি তুলছিলেন। প্রেমিক প্রেমিকারাও ফুল ভর্তি বৃক্ষের নিচে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছিলেন। এক ফাঁকে কথা হয় ইমা ও রাশেদুল জুটির সঙ্গে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল প্রণয়ের সম্পর্ক। একান্তে কিছু সময় কাটাতে রমনায় এসেছেন। তাদের জন্য ফুল হয়েছে বাড়তি পাওয়া। ইমা খুব খুশি। বললেন, রমনায় তো শুধু গাছই দেখি। আজ এত ফুল দেখা হলো, এখন মনে হচ্ছে পুরোটা ঘুরে দেখতে হবে। কথা শুনে নিজের হাতঘড়িটির দিকে তাকান রাশেদুল। অতো সময় হবে? পরে নিজেই বলেন, হবে। চল। ফুলের বাগানের চারপাশে ছোটাছুটি করছিল শিশুরাও। কোন কোন শিশু তো ফুল ছেঁড়ার জন্য বার বার ছুটে যাচ্ছিল। শুধু কি ফুল? সোমা নামের এক কিশোরী জানালো, ফুলের ওপর মৌমাছিও আছে। তার কথা শুনে কাছে যেতেই দেখা চোখ ছানাবড়া! প্রায় সবকটি ফুলে একটি করে মৌমাছি। মধু সংগ্রহ শুরু করে দিয়েছে তারা! প্রজাপতিও দেখা গেল। রঙিন পাখা মেলে ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পার্কে পাখিদের ডাকাডাকিও বেড়ে গেছে বলে মনে হলো। ‘আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,/ এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়...।’ ফুল তো দেখা গেল। পাখির দেখা মিললো না। আড়াল থেকে ডেকে যাচ্ছিল ওরা। কুকিলের কুহু ডাকটিও কি কানে আসছে? না, আর খোঁজ খবর করা গেল না। ফেরার সময় হয়ে গেছে। ‘কুহু সুরে মনের আগুন আর জ্বালাইও না’ বলে চলে আসতে হলো। তবে যারা আগেভাবে বসন্ত উৎসবে যোগ দিতে চান তাদের স্বাগত জানতে প্রস্তুত রমনা। ঋতুরাজ হাত বাড়িয়ে আছে। যন। মিলিত হোন।
×