ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শুকনো মৌসুমে চরভূমি

হারিয়ে যাচ্ছে নদী

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২৭ জানুয়ারি ২০১৯

হারিয়ে যাচ্ছে নদী

সমুদ্র হক ॥ বালিয়াড়ি ঠা ঠা চরভূমি। জল নেই। পানি প্রবাহ নেই। বর্ষাকালেও ভরে না। শুকনো মৌসুমে যমুনার এই অবস্থা। এভাবে কত নদী শুকিয়ে ভূমি হয়েছে আর কত নদী মরা গাঙে নাম লিখিয়েছে তার সঠিক হিসাব মেলে কি! নদীগুলো মরুপথে ধারা হারিয়ে ফেলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কাছে গিয়েও হিসাব মেলেনি। যা আছে তা অনেকটা ফাইলের বাম পাশে যা লেখা ছিল তাই ডানপাশে উঠেছে। কাগজে কলমের নদী এখনও আছে। বাস্তবে চর ভূমি পরিণত হয়েছে অনেক আগে। জেলা প্রশাসনের নদীর নথিতেও তা খুঁজে পাওয়া যায় না। ভূমি অফিসগুলোতে মরা গাঙের হিসাব বের করা সুদূর পরাহত। এত কিছুর মধ্যে একটি সুখবর : সরকার নদী রক্ষায় বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদী ব-দ্বীপ পরিকল্পনা (ডেল্টা প্রজেক্ট)। এর আগে পর্যায়ক্রমে নদীগুলোর ড্রেজিং কর্মসূচীর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এই তিনটি নদী অসংখ্য শাখা প্রশাখা নিয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। উজানের গঙ্গা এই দেশে তা পদ্মা। উজানের ব্রহ্মপুত্র এই দেশে একই নামে প্রবেশ করে সঙ্গী করেছে যমুনাকে। এই নদনদী থেকেই অসংখ্য শাখা নদী ও উপ নদীর সৃষ্টি হয়েছে। নদীগুলো প্রায় ৯ দশমিক ৬০ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রবাহিত। যার মাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এলাকা নিয়ে আছে বাংলাদেশ। এই নদীর জল প্রবাহের ৮০ শতাংশ আসে বর্ষা মৌসুমের চারটি মাসে (জুন-সেপ্টেম্বর)। প্রতিবছর এরা বহন করে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন পলি। ছোট নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো এই পলি। ভৌগলিকদের মতে প্রত্যেক নদীর পলি বহনের নির্দিষ্ট ক্ষমতা থাকে। ক্ষমতার বেশি পলি বহন করলে অথবা বন্যার সময় বাড়তি জলপ্রবাহ ধারণ করতে না পাড়লে নদীকে গতি পরিবর্তন করতে হয়। এ দেশে প্রায় ১৪ হাজার ২শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীপথ আঁকাবাঁকা অথবা মেয়েদের চুলের বেণীর মতো পেঁচানো বলে বাড়তি পলি অথবা জলপ্রবাহ ভাঙ্গনের বড় কারণ হয়। এছাড়া যেসব নদীর পাড় স্থিতিশীল নয় সেখানেও দেখা দেয় ভাঙ্গন। একদিকে পাড় ভেঙ্গে দেয়। আরেকদিকে প্রবাহ বাধা পেলেই গতিপথ পরিবর্তন করে। নদী শুকিয়ে হারিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এভাবেই অনেক নদী হারিয়ে গিয়েছে। ভাঙ্গনের মতো নদীতে চর জাগার বিষয়টিও নদীর চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। অনেক নদী ভরাট হয়ে মরাগাঙে পরিণত হচ্ছে। আবার সংস্কারের অভাবে অনেক নদী ভরাট হয়ে রুদ্ধ হয়েছে নৌপথ। বালিয়াড়ি থেকে পরিণত হয়েছে চরে। অনেক নৌকাকে আটকে থাকতে দেখা যায় বগুড়ার সারিয়াকান্দির যমুনার চরাভূমে। নদী শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চরভূমি। রাজশাহীর চারঘাট থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত ৩শ’৫০টির বেশি চর জেগেছে। কুড়িগ্রাম থেকে পাবনার ঢালারচর পর্যন্ত প্রায় এক হাজার চর জেগেছে। ঢালার চর থেকে রাজশাহী ২শ’ ৫০ এরও বেশি। এইসব চর বড় নদীতে পানি প্রবাহ কমিয়ে দিচ্ছে। এক সূত্র জানায়, নদীতে জেগে ওঠা চরের পরিমাণ অন্তত দুই হাজার বর্গ কিলোমিটার। যা মোট ভূমির প্রায় পৌনে দুই শতাংশ। যমুনায় দেড় হাজার বর্গ কিলোমিটার। গঙ্গা ও পদ্মায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার। মেঘনা উত্তর ও দক্ষিণ অববাহিকায় ৭শ’ বর্গ কিলোমিটার। একটা সময় হাটবাজার জনপদ ছিল নদী তীরে। ব্যবসা বাণিজ্য হতো নৌপথকে ঘিরে। এখন সংস্কারের অভাবে নদীই হারিয়ে যাচ্ছে। প্রবাহ কমেছে বড় নদী ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, ধরলা, তিস্তায়। যার প্রভাবে অনেক ছোট নদী অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। খলসডোঙ্গা, মহানন্দা, আত্রাই, বড়াল, তেতুলিয়া, ইচ্ছামতি, নারদ, হুরাসাগর, গুমানী, কাঁকন, কাকেশ্বরি, চিকনি, চিকনাই, করতোয়া, রূপনাই, ফুলেশ্বরি, বাঙালী, নদীশুখা, মাথাভাঙ্গা, গোমতি, গুঙ্গানী, ট্যাপাখাওয়া, উছলি ইত্যাদি নামের নদীগুলো কোথাও মরা গাঙ কোথাও খালের মতো। খরস্র্রোতা করতোয়া নদীর নাব্য হ্রাস করা হয় গত শতকের ৮৭-৮৮ সালে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালির কাছে বহমান করতোয়ার পানি প্রবাহ বন্ধ করে সেই পানি বাঙালী নদীতে ঘুরিয়ে দেয়ায় জন্য চকরহিমপুরে একটি রেগুলেটার নির্মাণ করা হয়। এর প্রবাহে করতোয়া দিনে দিনে হয়ে ওঠে খাল। শুকনো মৌসুমে অনেক নদী খুঁজে পাওয়া যায় না। পদ্মা, মেঘনা, তিস্তা ও শাখা নদীগুলোতে পানি প্রবাহ কমছে। নাব্যতা হারিয়ে মজে যাচ্ছে। বর্ষায় উজানের ঢলে পানি প্রবাহ বেড়ে যায়। হেমন্তের শুরুতেই কোথাও পানি থাকে না। শীতের শুকনো মৌসুমে নদীকে চেনাই যায় না।
×