ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে ওয়ান স্টপ সার্ভিস

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২৭ জানুয়ারি ২০১৯

বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে ওয়ান স্টপ সার্ভিস

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশে কমেছে বিনিয়োগ। কমেছে বিনিয়োগ নিবন্ধনও। ফলে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পরিকল্পনা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের ও ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশের যে রূপকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে, তা পূরণ করতে হলে প্রতি বছর শুধু বিদেশী বিনিয়োগই প্রয়োজন হবে ১ হাজার কোটি ডলার। এছাড়াও ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার শর্ত পূরণ করতে হলেও প্রচুর বিদেশী বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্যানুসারে এক বছরে বিডায় নিবন্ধন কমেছে ৩ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকার। ২০১৮ সালে বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে ৯৬ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৯৯ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। একইভাবে গত বছর বিদেশী ও যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগের নিবন্ধন হয়েছে ৯৩২ কোটি ডলারের। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ১ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলার। এ হিসাবে বিদেশী বিনিয়োগও কমেছে। গত চার বছরে প্রায় দেড় শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। এই হিসেবে ৬ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ বাড়ার কথা থাকলেও বেড়েছে আড়াই শতাংশের কম। অর্থনীতিবিদদের মতে বিনিয়োগের সঙ্গে প্রবৃদ্ধি সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এদিকে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন-২০১৮ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড)। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০১৬ সালে দেশে ২৩৩ কোটি ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ এলেও ২০১৭ সালে তা কমেছে প্রায় ২১৬ কোটি ডলার। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে বিদেশী বিনিয়োগ টানার শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের এই অবস্থান পঞ্চম। আঙ্কটাড প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গত বছর মিয়ানমারে বিদেশী বিনিয়োগ ৪৫ শতাংশ বেড়ে ৪৩০ কোটি ডলার হয়েছে, যা এলডিসিগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এরপর যথাক্রমে ইথিওপিয়া, কম্বোডিয়া, মোজাম্বিক ও বাংলাদেশের অবস্থান। এই পাঁচ দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ শুধু আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের চেয়ে এগিয়ে আছে। ২০১৩-১৮ সময়ের বা গত পাঁচ বছরের গড় প্রবৃদ্ধির হার থেকে এটা স্পষ্ট হয়। এই সময়ে মোজাম্বিকের গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ১৪ শতাংশ, আর বাংলাদেশের ৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আলোচ্য পাঁচ বছরে মিয়ানমার ও কম্বোডিয়ার গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশের ওপরে আর ইথিওপিয়ার ৮ শতাংশের ওপরে। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, জানুয়ারি মাসের মধ্যেই ব্যবসায়ীদের জন্য ওয়ান স্টপ সেবা চালু করা হবে, এর ফলে একই জায়গা থেকে সব সেবা পাওয়া যাবে। এছাড়া গত বছর সারাবিশ্বে বিনিয়োগ ছিল নিম্নমুখী। সেই তুলনায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ কমেনি। বিডা সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে দেশে শুধু কৃষি ও গার্মেন্টস খাতে বিনিয়োগ এসেছে। এখন তথ্যপ্রযুক্তি ও বিদ্যুত খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগ আসছে। বিনিয়োগের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে আদর্শ গন্তব্যস্থল বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হলে সরকারকে বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করে তা বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। এজন্য রফতানিমুখী শিল্পসহ অন্যান্য বড় প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে বিভিন্ন সুযোগ ও সেবা নিশ্চিত করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির মতো সম্ভাবনাময় খাত নির্বাচন করে বিনিয়োগকারীদের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে চ্যালেঞ্জ তা মোকাবেলা অনেক খানি সহজ হয়ে আসবে- এমনটাই মনে করেন বিশিষ্টজনরা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশে এমন কী হয়েছে, যে পুঁজির উৎপাদনশীলতা বাড়বে। এখানে অবকাঠামো দুর্বলতা রয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুত সমস্যা, ডুয়িং বিজনেস (সহজে ব্যবসা করা) সূচক ও সুশাসনের সূচকও ভাল নয়।’ মির্জ্জা আজিজুল আরও বলেন, ‘অর্থনীতির স্বাভাবিক হিসাব অনুযায়ী ইনক্রিমেন্টাল ক্যাপিটাল আউটপুট রেশিওর অর্থ হলো ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য জিডিপির কত শতাংশ বিনিয়োগ দরকার। গত কয়েক বছরের হিসাবে দেখা গেছে তা ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এই হিসাবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য জিডিপির ৩৫ শতাংশ বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু বিনিয়োগ সেভাবে হচ্ছে না। জানা গেছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্তত ১৭টি খাতে কর অবকাশ সুবিধা পাচ্ছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। তাদের মুনাফা ফিরিয়ে নেয়ার শর্ত শিথিল করা হয়েছে। নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠায় যন্ত্রপাতির অবচয় সুবিধা, শুল্কমুক্ত যন্ত্রাংশ আমদানি এবং রফতানি উন্নয়ন তহবিল থেকে কম সুদে ঋণ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন বিদেশীরা। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রতি বছর যে পরিমাণ বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়, তার ৪০ শতাংশও বাস্তবায়ন হয় না। বিডার তথ্য অনুসারে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট ১ হাজার ৬৪৩টি প্রকল্পে মোট ২ লাখ ৭২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে। এতে প্রস্তাবিত কর্মসংস্থান ছিল ২ লাখ ৮৭ হাজার ৫৪৬। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৮৩টি প্রকল্পে স্থানীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। স্থানীয় কর্মসংস্থান হওয়ার কথা ২ লাখ ৬০ হাজার ৫৫৫ জনের। আর বিদেশী ১৬০টি প্রকল্পের বিপরীতে ৮১ হাজার কোটি টাকা নিবন্ধন করা হয়। এতে প্রস্তাবিত কর্মসংস্থান ছিল ২৬ হাজার ৯৯১ জন।
×