ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়নের মহাসড়ক এবং আগামীর চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২৭ জানুয়ারি ২০১৯

উন্নয়নের মহাসড়ক এবং আগামীর চট্টগ্রাম

(গতকালের পর) বিকল্প সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প চট্টগ্রাম বন্দরের বাড়তি চাপ কমানোর লক্ষ্যে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন রয়েছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর সমুদ্রবন্দর। সেখানে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য জাহাজ ভিড়ানোর চ্যানেল ও টার্মিনালকে ঘিরে ইতোমধ্যে এই সমুদ্রবন্দরের প্রাথমিক অবকাঠামো তৈরি হয়ে গেছে। সেখানে রয়েছে ভূ-প্রাকৃতিক অবকাঠামো সুবিধাও। সেখানে ৩২০ থেকে ৩৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এবং ১৬ মিটার ড্রাফটের আট হাজার টিইইউএস কন্টেইনারবাহী বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে। যেসব মাদার ভ্যাসেল চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে আসতে পারে না সেসব বড় আকারের জাহাজ এ বন্দরে ভিড়তে পারবে। জাপানের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় যাবতীয় প্রস্তুতি শেষে আগামী ২০২০ সালের আগস্টের মধ্যে বন্দরের মূল অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হবে। আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হবে এই গভীর সমুদ্রবন্দর। এটি দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে জাইকা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কারিগরি সম্ভাব্যতার সমীক্ষা প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। জাইকার বিশেষজ্ঞদের সূত্রমতে মাতারবাড়ীতে এ সমুদ্রবন্দরটি জাপানের কাশিমা বন্দর এবং নিগাতা বন্দরের মডেল অনুসরণ করে নির্মাণ করা হচ্ছে। দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ‘দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ শীর্ষক উদ্যোগের আওতায় জাপান সরকার মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে একটি কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্র, এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। জাপানের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১২শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণে কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছিল। এ পর্যায়েই মাতারবাড়ীতে বাণিজ্যিক, গভীর সমুদ্রবন্দরের সম্ভাবনা উদঘাটিত হয় জাইকার গবেষণায়। এছাড়াও যমুনা রেল সেতু, মেট্রোরেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুতকেন্দ্র, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সেবাসহ বাংলাদেশের ছয়টি মেগা প্রকল্প বাস্তাবায়নে ১৮০ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দেবে জাপান। জাপানের ৩৯তম সরকারী উন্নয়ন সহায়তা ঋণ প্যাকেজের আওতায় এই অর্থ দেয়া হবে। জাপানী মুদ্রায় এর পরিমাণ ২০০ দশমিক ৩৭১ বিলিয়ন ইয়েন। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে জাপান এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিনিময় নোট স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্যকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দরের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আবাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এবং দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বন্দরনগরীর আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় নির্মিত হয়েছে সুরম্য বিশ্ব বাণিজ্যকেন্দ্র । চিটাগাং চেম্বার অব কমার্সের উদ্যোগেই এটি নির্মিত হয়েছে। যা বাংলাদেশে প্রথম ডব্লিউটিসি। চট্টগ্রামে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভবনের ৫৩ হাজার ৯১৩ বর্গফুট আয়তনের বিশাল পরিসরে রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের কনভেনশন সেন্টার, কনফারেন্স হল, হেলথ ক্লাব, দেশীয় পণ্যসামগ্রীর প্রদর্শনী হল, সুইমিং পুল, মূল অফিস, আইটি ও মিডিয়া সেন্টার, অফিস স্পেস, পাঁচ তারকামানের হোটেল, আন্তর্জাতিকমানের ব্যবসা-বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট পরিসেবা ইত্যাদি। এ ছাড়াও চট্টগ্রামের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য, আরব্য, পর্তুগীজ, তুর্কি, পারস্য, চীনা বণিকদের চট্টগ্রামে গমনাগমনের তথ্যাবলী রয়েছে বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রটির মিডিয়া সেন্টারে। পতেঙ্গায় পর্যটন সম্ভাবনা বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পর্যটনের জন্য যেসব উপাদান অত্যাবশ্যক সবই আছে; শুধু ছিল না সমন্বিত উদ্যোগ। প্রাচ্যের রানীখ্যাত এই চট্টগ্রামকে স্বরূপে ফিরিয়ে আনতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সাগর তীরবর্তী পর্যটন এলাকা পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বর্ধনের মাধ্যমে বিশ্বমানের পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলছে। দেশী-বিদেশী পর্যটক আকর্ষণ করতে পরিকল্পিতভাবে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতকে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। কর্ণফুলীর মোহনা থেকে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে ৫ কিলোমিটার এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে আধুনিক ও বিশ্বমানের পর্যটনকেন্দ্র। প্রকল্পের আওতায় পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের হাঁটার জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে। সৈকতের পাশেই সিঙ্গাপুরের আদলে বিলাসবহুল স্মার্ট সিটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে এই বিচে। পাঁচ কিলোমিটার ওয়াকওয়ের মধ্যে প্রায় চার কিলোমিটারের কাজ শেষ। আগামী মার্চের মধ্যে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতকে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হতে পারে। এক্সপ্রেসওয়ে বাস্তবায়ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক সিদ্ধান্তে ১৮ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। কাঠগড় এলাকায় পাইলিং কার্যক্রম উদ্বোধনের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হলো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এয়ারপোর্টে যাতায়াতের জন্য তিন-চার ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। এয়ারপোর্ট ছাড়াও পতেঙ্গা এলাকায় নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীর ঘাঁটিসহ সরকারী অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। এসব বিবেচনায় যানজট আর জনদুর্ভোগ কমাতে তিন ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে এই মেগা প্রকল্পটি। বাণিজ্যিক রাজধানী বন্দরনগরীর প্রধান সড়কে এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা যায়। এছাড়া ও সরকার গৃহীত ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার’ অর্থনৈতিক করিডোরের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নেও এই প্রকল্প কার্যকর ভূমিকা রাখবে। ১৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হলে চট্টগ্রাম শহর এলাকা এবং এর দক্ষিণ অংশের সঙ্গে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সৃষ্টি হবে। এতে যানজট হ্রাস পাবে এবং বিমানবন্দরে যাতায়াতের পথ সুগম হবে। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে জুন ২০২০ সালের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে চলছে কার্যক্রম। ২৪টি র‌্যাম্পসহ এক্সপ্রেসওয়েটির মোট দৈর্ঘ্য হবে ২৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে মূল এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য সাড়ে ১৬ কিলোমিটার। এর প্রস্থ হবে সাড়ে ১৬ মিটার। এতে ৯টি এলাকায় ২৪টি র‌্যাম্প থাকবে। ৩০ জানুয়ারি ২০১৬ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্ববৃহৎ এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। আউটার রিং-রোড চট্টগ্রাম নগরীর যানজট সমস্যার সমাধান, চট্টগ্রাম বন্দর, ইপিজেড ও বিমানবন্দরমুখী বিকল্প পণ্য পরিবহন সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, শহর রক্ষা, শিল্পায়ন, আবাসন ও পর্যটনের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি হচ্ছে আউটার রিং-রোড। ট্রাঙ্ক রোড নেটওয়ার্কের আওতায় দুটি রিং রোড এবং মহানগরীর চারপাশে বৃত্তাকার সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে ছয়টি রেডিয়েল রোড নির্মাণের অংশ হিসেবে আউটার রিং রোড প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল। ফৌজদারহাট থেকে বায়েজিদ বোস্তামি পর্যন্ত চিটাগাং বাইপাসের নির্মাণকাজও শেষ পর্যায়ে। বায়েজিদ থেকে অক্সিজেন এবং অক্সিজেন থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ হয়ে কাপ্তাই রাস্তার মাথা পর্যন্ত সড়ক ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে চাক্তাই-কালুরঘাট আউটার রিং রোড প্রকল্পের কাজও পুরোদমে শুরু হয়েছে। চাক্তাই খালের মুখ থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত রাস্তা রয়েছে। ফলে নগরীর চারদিকে একটি বৃত্তাকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে যানজট নিরসনের পাশাপাশি কর্ণফুলীর তীরবর্তী সন্নিহিত পিছিয়ে পড়া এলাকার উন্নয়ন, পর্যটন শিল্পের বিকাশসহ বৃত্তাকার এই সড়কটি বিস্তীর্ণ এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। নগরীর চারদিকে বৃত্তাকার সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার গাড়িগুলো শহরে প্রবেশ না করে টানেল হয়ে পতেঙ্গা থেকে আউটার রিং রোড ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলে যাবে। একইভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে আসা রাঙ্গামাটির কোন গাড়ি ফৌজদারহাট থেকে বায়েজিদ হয়ে অক্সিজেন কিংবা কাপ্তাই রাস্তার মাথা হয়ে শাহ আমানত সেতুতে পৌঁছতে পারবে। ইতোমধ্যে পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত আউটার রিং রোডের নির্মাণকাজ প্রায় শেষের পথে। আগামী মার্চ নাগাদ সড়কটি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। পতেঙ্গা থেকে সাগরিকা স্টেডিয়াম পর্যন্ত সাগরপাড়ের সড়কটি চালু হলে বহুমাত্রিক সুফল মিলবে। কমবে নগরের যানজট। সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরের যানবাহনের জন্য এটি বিকল্প সড়ক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। পতেঙ্গার তীরে অবস্থিত সরকারী-বেসরকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষা এবং শহর রক্ষা বাঁধ হিসেবেও কাজ করবে। বর্তমানে সাগরপাড়ে ১৫ দশমিক ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে মূল সড়কের কাজ চলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০ মিটার উঁচু সড়কটির প্রশস্ততা ২০ দশমিক ৫ থেকে ২৪ দশমিক ৫ মিটার। চারলেনের সড়কের নিচের অংশে স্থাপন করা হচ্ছে পাথরের ব্লক। শেখ হাসিনার প্রবল আগ্রহে গত দশ বছরে চট্টগ্রামের উন্নয়নের পালে হাওয়া লেগেছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের উন্নয়নে গৃহীত প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, যানজট নিরসনের পাশাপাশি জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে নগরবাসী। কর্ণফুলী টানেল এবং আউটার রিং রোডকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম শহরের বিস্তীর্ণ এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ, বদলে যেতে শুরু করেছে হালিশহর, পতেঙ্গা, কাট্টলী এবং কালুরঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকার আর্থ-সামাজিক চিত্র। উন্মোচিত হতে চলেছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। শেখ হাসিনার উন্নয়নে অচিরেই বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম রূপান্তরিত হবে উন্নত সমৃদ্ধ এক নগরীতে। (সমাপ্ত) লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×