ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল মালেক

ওয়াশিংটন ও ঢাকায় ক্যাপিটলে ফ্রেশম্যান সমাচার ॥ নবীন মুখের জয়জয়কার

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ২৭ জানুয়ারি ২০১৯

ওয়াশিংটন ও ঢাকায় ক্যাপিটলে ফ্রেশম্যান সমাচার ॥ নবীন মুখের জয়জয়কার

রাজধানী ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলে ২০১৮ সালের মিডটার্ম ইলেকশনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত আইনসভার নবীন সদস্যদের অভিষেক ঘটে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের তিন তারিখে। অপরদিকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার জাতীয় সংসদ ভবনে একই মাসের শেষ প্রান্তে ৩০ জানুয়ারি যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের নবীন সংসদ সদস্যদের। এ বিষয়ে আর একটা সাযুজ্যের মজার দিকটি হলো আমেরিকা ও বাংলাদেশ উভয় দেশেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আইন প্রণেতাগণ একেবারেই আনকোরা। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর আমেরিকায় এ বছরই কংগ্রেসে এসেছেন সর্বাধিক সংখ্যক ফ্রেশম্যান। এখানে জানানো প্রয়োজন যে, মার্কিন দেশে প্রথমবারের মতো যে সব নারী বা পুরুষ সদস্য নির্বাচিত হন ফার্স্ট ইয়ার কলেজ স্টুডেন্টদের মতো তাদের অভিহিত করা হয় ফ্রেশম্যান নামে। এবারের ১১৬তম ইউ এস কংগ্রেসে এই সব ফ্রেশম্যানদের সর্বমোট সংখ্যা হলো ৯২ জন। যাদের মধ্যে ডেমোক্র্যাট দল থেকে ৬১ জন বিজয়ী হয়েছে এবং ৩১ জনের জয় এসেছে রিপাবলিকান দলের টিকেট নিয়ে। এ বিষয়ে উল্লেখ করার আরও একটি বিষয় হলো গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি অর্থাৎ রিপাবলিকান পার্টি থেকে বিজয়ী ফ্রেশম্যানদের মধ্যে অধিকাংশই পুরুষ এবং শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের। কিন্তু বিপরীতে ডেমোক্র্যাট পার্টি থেকে নবনির্বাচিতদের পরিচয়ে রয়েছে রংধনুর বৈচিত্র্য। এই দলে একদিকে যেমন নির্বাচিত হয়েছেন প্রথম একজন মুসলিম নারী অন্যদিকে একজন করে প্রথম নেটিভ-মার্কিন ও কোরিয়ান-আমেরিকান। চলতি বছরেই কংগ্রেসের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ২৯ বছর বয়সী আলেকজান্দ্রিয়া অক্সনা কর্টেজ। শুধু তাই নয়, বহু অঙ্গরাজ্য থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মার্কিন আফ্রিকান নারী ভোটে বিজয়ী হয়ে কংগ্রেসে এসেছেন। বলতেই হবে এবারের মিডটার্ম ভোটটিতে ছিল কালো নারীদের সংখ্যাধিক্য। মোট ১১০ জন বিজয়ী নারীর মধ্যে চল্লিশ জনই হচ্ছেন ওম্যান অফ কালার অর্থাৎ কৃষ্ণাজ্ঞ রমণী। ইতোমধ্যে কংগ্রেসে যোগদানকারী এসব ফ্রেশম্যানদের কিভাবে আইনসভায় একজন অভিজ্ঞ সদস্য হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে সে সম্পর্কে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। সে কারণে প্রসঙ্গক্রমে টেনে আনতে চাই ২০১৮ সালে নির্বাচিত ফ্রেশম্যানদের অন্যতম একজনকে যিনি কানেক্টিকাটের বাসিন্দা জ্যানা হেস। হেস সেখানকার ওয়াটার ব্যারী এলাকায় সরকারি হাউসিংয়ে অর্থাৎ দুস্থদের জন্য সরকার প্রদত্ত দারিদ্র্য আবাসনে মানুষ হয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে থেকে উঠে এসেও তিনি লেখাপড়ায় রেখেছিলেন মেধার স্বাক্ষর। কৃতিত্বের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত হবার পর জ্যানা বেছে নিয়েছিলেন বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশা। সেখানেও তিনি তার প্রতিভাবলে সাফল্যজনকভাবে নির্বাচিত হন ‘ন্যাশনাল টিচার অব দ্য ইয়ার।’ কিন্তু এরপরেও না থেমে ১৮ সালে যাত্রা করলেন ওয়াশিংটন ক্যাপিটলের সর্বোচ্চ শিখরের দিকে। দুস্থ আবাসনের মেয়ে এবার আইন সভার সদস্য হওয়ার জন্য নির্বাচন করে হলেন বিজয়ী। তবে একটি কথায় বলতে হবে পূর্ববর্তী পেশায় জ্যানা হেস যতই দক্ষতার পরিচয় দিলেও ফ্রেশম্যান হিসেবে তিনি কংগ্রেসে এসেছেন একেবারে নবিস হয়ে। কিন্তু তিনি এবং তার মতো আনকোরারা কিভাবে হয়ে উঠবেন একজন অভিজ্ঞ সদস্য? এক্ষেত্রে আমাদের দেশের মতো বছরের পর বছর ধরে তাকে আইনসভায় যাতায়াত করে যথাযোগ্য যোগ্যতা অর্জন করতে হয়নি হেস ও অন্যান্য ফ্রেশম্যানদের। নবিস সদস্যদের চৌকসভাবে তৈরি করার দায়িত্ব আইন সভারই। নবনির্বাচিতরা যাতে কার্য দিবসের প্রথম দিন থেকেই যোগ্যতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন সে কারণে কংগ্রেসে প্রণীত রয়েছে একটি কংগ্রেশনাল ওরিয়েন্টাল কোর্স। জানুয়ারিতে কংগ্রেস শুরুর পূর্ব পর্যন্ত কোর্সের স্থায়িত্ব ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই কংগ্রেশনাল ওরিয়েন্টাল কোর্সের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের রাজধানীকে শাসন করার জন্য কিভাবে আইন প্রণয়ন করতে হয় এবং সেই সঙ্গে ক্ষমতা সঠিকপথে পরিচালনা করার বিষয়ে জ্ঞান অর্জন। এমন এক কোর্সে যোগদানের জন্য বিজয়ী হবার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে তার মতো নবিসদের উঠে আসতে হয়েছিল ক্যাপিটলের কয়েক ব্লকের মধ্যে একটি হোটেলে।সেই সঙ্গে বাই পার্টিজান লেজিস্লেশন সম্পর্কে ফ্রেশম্যানদের গত ডিসেম্বের মাসে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনেডি স্কুল অব গবর্নমেন্টে ট্রেনিং গ্রহণ করতে হয়েছে। সেখানে তাদের জন্য নির্ধারিত বিভিন্ন পাবলিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেছেন মার্কিন বিজনেস ও গবর্নমেন্টের বিশিষ্ট কর্মকর্তারা। এর মধ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্সপোর্টেশন মন্ত্রী এলেনি এল চাও এবং গোল্ডম্যান স্যাকের প্রেসিডেন্ট গ্যারি দি কোহন। অতঃপর তাদের জ্ঞানার্জন করতে হয়েছে আইটি বিষয়ে- নতুন প্রযুক্তির টেলিফোন এবং ল্যাপটপ প্রশিক্ষণও এর অন্তর্ভুক্ত থাকে। জ্যানাদের মতো ফ্রেশম্যানদের শিক্ষণীয় বিষয় সম্পর্কে হাউস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন কমিটির স্পোক পার্সন কোর্টনি পেরেলা বলেছেন এসব ছাড়াও কিভাবে নিজেদের জন্য ১৬ জন স্টাফ নিয়োগ করতে হবে এবং তাদের নিয়ে সেট করতে হবে নিজ অফিস। কংগ্রেসের ভোটদানের পদ্ধতি কি সেটিও এই পূর্ববর্তী সময়ে তাদের শিখে নিতে হয়। তাছাড়া ফ্রেশম্যানরা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অবগত হয়েছেন তাদের নিজ নিজ অধিকার সম্পর্কেও। চলতি বছর থেকে ওয়ার্ক প্লেস এবং রেসপনসিবিলিটি সম্পর্কে নতুন যেসব বিষয় সংযোজিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সেক্সচুয়াল হ্যারাসমেন্ট। ডিরেক্টর অব দ্য অফিস এমপ্লয়ী এ্যাডভোকেসি নামে একটি নতুন বিভাগ রয়েছে এই দায়িত্বে। এ সম্পর্কে ফ্রেশম্যান জ্যানা হেস বলেন, ইতোমধ্যে নৈতিকতা বিষয়ে তাদের জন্য অনেক ওয়ার্কশপ করা হয়েছে। কিন্তু বিগত কংগ্রেসে হ্যাশ মি টু স্ক্যান্ডাল শেয়ার করা হয়েছে বটে কিন্তু সেটা নিয়ে সামনে অগ্রসর হবার পদ্ধতি বিষয়ে যথাযথ আইন প্রণয়নে ছিল মন্থরতা। জ্যানা হেস তার নির্বাচনে প্রচারণায় মি টু নিয়ে ছিলেন সোচ্চার। কংগ্রেসে ইটা তার অন্যতম কাজ হলেও ইতিহাসের প্রাক্তন শিক্ষক হিসেবে কংগ্রেসে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি এডুকেশন ইস্যু নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া দরিদ্র আবাসন এবং ক্ষুদ্র শিল্পবিষয়ক কংগ্রেসনাল কমিটিতে তিনি কাজ করতে ইচ্ছুক। জ্যানাদের প্রশিক্ষণ হচ্ছে বহু বিষয়ে। যেমন অফিস বাজেট, পারসোনাল রেগুলেশন এবং ভ্রমণ সীমিত রাখার ব্যাপারেও তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পূর্বে ধারণা না থাকলেও এখন তিনি জানেন কংগ্রেসম্যানদের বার্ষিক বাজেট এক দশমিক তিন মিলিয়ন থেকে এক দশমিক চার মিলিয়ন পর্যন্ত বরাদ্দ রয়েছে। ননপ্রফিট কংগ্রেসনাল ম্যানেজমেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ব্রাডফোর্ড ফিটে এ বিষয়ে তাদের জানিয়েছেন যে সদস্যদের নির্বাচনী ডিস্ট্রিক্ট থেকে ওয়াশিংটন গমনাগমন খরচ এই বাজেটরি অন্তর্ভুক্ত। কোন সদস্য যদি নিজ বরাদ্দের অঙ্ক অতিক্রম করেন তখন সে বাড়তি ব্যয় তার বেতনের চেক থেকে কেটে রাখার বিধান আছে। তিনি আরও বলেছেন সেশন চালুর সময় কংগ্রেস সদস্যদের সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টার অধিক সময় ধরে কঠোর পরিশ্রম সাধ্য কাজ করতে হয়। বলা বাহুল্য, ফ্রেশম্যানদের হোটেলসহ এসব নানাবিধ কোর্সের ব্যয় ভার বহন করে হাউস কমিটি। কংগ্রেস ফ্রেশম্যানরা ওরিয়েন্টেশনের শুরুতে ক্যাপিটল হিলের নতুন কলিগদের সঙ্গে পরিচয় করা, তাদের সঙ্গে ছবি তোলা, ক্যাফেটেরিয়ায় আহার করা এমন কি হাউসের নিকটতম বাথরুম কোনটি সেটিও তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শেখানো হয়। এছাড়া তাদের দেয়া হয় সিকিউরিটি ব্রিফিং এবং প্রেসের সঙ্গে কথা বলাও এর অন্তর্ভুক্ত। ডেট্রয়েট থেকে নির্বাচিত অপর একজন ফ্রেশম্যান যার নাম ত্লাইব বলেছেন সারকথা। তিনি জানান, পুরো ওরিয়েন্টেশনে সবাই পরামর্শ দিয়েছেন নির্বাচনী ডিস্ট্রিক্ট ও কমিউনিটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করলে তবেই তোমার কাজে সফলতা আসবে নইলে নয়। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ২০১৮ সালের নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নবীন মুখের সমাগম ঘটেছে। স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকান ফ্রেশম্যানদের মতো আইনসভা সম্পর্কে তারাও নভিস। এই বিষয়গুলো তাদের জন্য প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে মার্কিন পথ অনুসরণ করে বাংলাদেশ এসব সদস্যকে জন্য সংসদ পরিচিতি ও প্রশিক্ষণ চালু করতে পারে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয় তাদের জন্য একটি ব্যাপক কোর্সের আয়োজন করা একটি আবশ্যিক বিষয়। কারণ, সংসদ সচিবালয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি নতুন সংসদ সদস্যরা অধিবেশন চলাকালীন সময়ে কোন পর্যায়ে পয়েন্ট অফ অর্ডার নিয়ে কথা বলা যায় তা নিয়ে নবীনরা প্রায়শই ঝামেলা বাধিয়ে ফেলেন। তাছাড়া কতদিন আগে ও কিভাবে তাদের লিখিত প্রশ্নোত্তর সংসদ সচিবালয়ে জমা দিতে হয় সে বিষয়েও তারা সচেতন থাকেন না। সংসদ নেতা বা মন্ত্রীদের প্রশ্নের জবাবের পর কিভাবে সম্পূরক প্রশ্ন করতে হয়, মূলতবি প্রস্তাব উত্থাপনের কি কি বিধি রয়েছে এসব বিষয় শিখে নেয়া দরকার সংসদে বসবার পূর্বেই। তাছাড়া সদস্যদের অবশ্যই জানতে হবে নয়া আইন উত্থাপনের পদ্ধতি, সংসদের কোরাম, লাইব্রেরি ব্যবহারের পদ্ধতিসহ আরও কিছু বিষয়। এসব তারা আপন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে ঠুক ঠুক করতে করতে শেখেন। এখন প্রশ্ন হলো, এ বিষয়ে আমাদের ফ্রেসম্যানরা কিভাবে অতি দ্রুত সংসদের প্রয়োজনীয় এবং জরুরী বিষয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ পেতে পারেন? অনেকেই জানেন, বাংলাদেশের পার্লামেন্ট সচিবালয়ে যথেষ্ট সংখ্যক প্রবীণ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা রয়েছেন। এদের প্রণীত একটি কোর্সের মাধ্যমে বক্তা হিসেবে সাবেক স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ, সংসদ সচিবালয়ের সচিবসহ মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারা তাদের প্রশিক্ষণ দেবেন। এদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন বর্তমানের ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেননদের মতো আরও কিছু সুযোগ্য পার্লামেন্টারিয়ান। প্রবীণদের পুরনো অভিজ্ঞতা ও কৌশলগুলো নতুনদের সঙ্গে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভাগ করে নিলে শুরুর দিনগুলো থেকেই বাংলাদেশের ফ্রেশম্যানরা অতিসত্বর হয়ে উঠবেন এক একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান। এ এছাড়া পৃথকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স, পাবলিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশন, আইন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ সমন্বয়ে তৈরি করতে পারে একটি ওরিয়েন্টেশন কোর্স। প্রশিক্ষণের স্থান হতে পারে পিএসসি বা সংসদ সচিবালয়ের কোন বড়সড় কক্ষ। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও বিশ্লেষক [email protected]
×