ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের বুদ্ধি ও যুক্তির সম্মান

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ২৭ জানুয়ারি ২০১৯

আমাদের বুদ্ধি ও যুক্তির সম্মান

তথ্য প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের মানুষের বুদ্ধি ও যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা কম বলে অনেককাল আমরা বাইরের দেশে, এমনকি নিজের দেশেও একশ্রেণীর মানুষের কাছে উপহাসের পাত্র ছিলাম। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প সে ধারণার অনেক পরিবর্তন করে দিয়েছে। এখন নিজদের চিন্তা নিজেদের মতো করতে আমরা যথেষ্ট সক্ষম। তথ্য প্রযুক্তি সেবা বিকাশের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি বুদ্ধি ও যুক্তির চর্চা হয়েছে এর ভেতরের কাঠামো ব্যবস্থাপনায়। বাইরে থেকে আমরা যত যন্ত্রপাতি দেখি সে তুলনায় এর অভ্যন্তরে যন্ত্রপাতি প্রায় নেই বললেই চলে, সেখানে সব বুদ্ধি ও যুক্তির খেলা। যা আছে সব সহায়ক ও বুদ্ধি ধারণের জন্যে, নিজে থেকে সে কোন যন্ত্র বা যন্ত্র কৌশলের ওপর নির্ভরশীল নয়। উপরন্তু বুদ্ধির প্রয়োগ, যা মূলত সফটওয়্যার নামে পরিচিত তা ধারণে প্রধানত যন্ত্রটি চালু থাকাতে সমর্থ থাকলেই হলো। আর সে যন্ত্র চালু অব্যাহত রাখতে আমরা যে বুদ্ধির যুক্তি ব্যবহার করি তা সিস্টেম সফটওয়্যার নামে পরিচিত। কিন্তু এর ব্যবহারকারী রূপ কার্যকর থাকে যদি আমরা ব্যবহারের জন্যে বুদ্ধিকে প্রায়োগিক কাজে টেনে নিতে পারি, যাকে আমরা এ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার বলে থাকি। আর তা তৈরি করে নিতে আমাদের যে কৌশলের বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ দরকার হয় তা হলো প্রোগ্রামিং সফটওয়্যার। বুদ্ধি ও যুক্তি ব্যবহারের এই কঠিন কথাগুলো সহজ করে বলা কঠিন। বিশেষ করে বাংলায়। কারণ, প্রযুক্তি বিকাশের বেশিরভাগ কাজ হয়েছে ইংরেজী ভাষাভাষীদের হাতে। ব্যতিক্রম কেবল চীন, জাপান, কোরিয়া ও ইউরোপের কিছু দেশ। ধনী-গরিব সৃষ্টির মতো ডিজিটাল বৈষম্য বা ডিজিটাল ডিভাইজ যা তৈরি করেছে পশ্চিমা ধনী দেশগুলো, বিশেষ করে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরে। তাদের কাছে পুঁজির বিকাশে বা ব্যবসা-বাণিজ্যে তথ্য প্রযুক্তির দরোজা খুলে দেয়া ছাড়া তখন আর কোন উপায় ছিল না। ফলে এই জগতে পশ্চিমাদের দিয়ে তৈরি এক বিশাল ব্যবধান সংঘটিত হয়েই আছে। বাণিজ্যিক স্বার্থ ছাড়া তাই তথ্য প্রযুক্তি খাতে উন্নয়নশীল দেশের জন্যে বাজার হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় এই কিছুদিন আগেও ছিল না। যেটুকু ছিল তা সহায়ক মেধাশক্তির বিনিয়োগ কিন্তু তা হয়ে গেলো শ্রম বাজারের অধীন! গরিব দেশগুলো তাদের মেধা বিক্রি করে বুদ্ধি ও যুক্তির জগতে ঠাঁই করে নিল বটে কিন্তু সীমিত কিছু ক্ষেত্র ছাড়া মেধার স্বাধীন বিকাশে ও মালিকানায় অংশ নিতে পারল না। ফলে জন্ম হলো আউট সোর্স নামে এক শিল্পের যা পদানত থাকা থেকে বুদ্ধি ও যুক্তির অংশীদার বা মালিকানায় গরিব দেশগুলোকে কোন স্বাধীন স্বার্থ দিল না। আজ থেকে দশ-পনেরো বছর আগে ভারত যখন যুক্তি অপচয়ের এই বাজার থেকে তার মেধা সরিয়ে নিতে চাইল তখন পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে কোন স্বত্ব অর্জনের দাবি না দিয়েই পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি করে নিলো। ফলে মেধাসম্পদের জগতে এশিয়ার অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলো যাদের মেধাসম্পদ বিশ্বমানের তারাও নতুন এক বৈষম্যের শিকার হলো। অনেকটা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের মতো, শ্রমশক্তি দিয়ে আমরা নির্মাণশিল্পে অংশ নিলাম কিন্তু মেধাশিল্পের কোন বাণিজ্যিক মালিকানা বা স্বত্ব আমরা পেলাম না। আন্তর্জাতিক ব্যবসাশিল্পে তাই আমাদের বুদ্ধির স্বীকৃতি কম, যতটা সম্মান আমাদের শ্রমশক্তির আছে তা ক্রমশ হয়ে উঠেছে প্রতিযোগিতামূলক। যেখানে এখন দেখা যাচ্ছে টিকে থাকাই কঠিন। বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছে যার অনেক অর্জন বিশ্বকে চমকে দেবার মতো। তথ্য প্রযুক্তি খাতে তাই আমাদের চিন্তা করা দরকার: কেমন করে পশ্চিমা দুনিয়ার বাণিজ্যিক স্বার্থ দেখভাল করার চেয়ে নিজেদের বুদ্ধি ও যুক্তির সামর্থ্য দিয়ে যারা নিজেদের বড় বলে দাবি করে তাদের ফিরিয়ে দেয়া যায়। আর সেটা কেমন করে সম্ভব দু-একটি উদাহরণ ধরে আলোচনা করলেই বোঝা যাবে। আমরা জানি, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা জনসংখ্যা যা বঙ্গবন্ধু খুব সুচিন্তিতভাবে চিহ্নিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এই স্ফীত জনসংখ্যাকে মেধাসম্পদে বিকাশের লক্ষ্যেই ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প গ্রহণ করেন। অনেক আগে থেকেই এই রূপকল্প পরিকল্পনার পটভূমিপত্র তৈরি করেছিলেন বর্তমান টেলিকমিউনিকেশন ও তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। ফলে এখানে উদ্দেশ্য অর্জনের একটি সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ ও অবকাশ আছে। আমরা যারা মাঠে ময়দানে কাজ করি আমাদের প্রত্যাশা তাই অনেক বেশি। যেমন আমরা আশা করছিÑ আমাদের মেধাসম্পদ বাংলায় চিন্তা করবে ও বাংলায় যুক্তি দিয়ে প্রযুক্তিকে বশে রাখবে। এখন আমাদের প্রযুক্তি পড়তে হয় ইংরেজীতে, শেখাতে হয় ইংরেজীতে, চিন্তা করতে হয় ইংরেজীতে, বুদ্ধির প্রয়োগও করতে হয় ইংরেজীতে। কাজগুলো বাংলায় সম্ভব যদি আমরা সে মতো উদ্যোগ নেই। মোস্তাফা জব্বার যখন বাংলাদেশের জন্যে বাংলা কী-বোর্ড নিয়ে লড়াই করছিলেন (এখনও করছেন) তখন একটি ঘটনার আমি সাক্ষী। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে বিল গেটস বাংলাদেশ সফরে এলে তার একটি উপস্থাপনা শেষে ভিস্তা অপারেটিং সিস্টেমে বাংলা থাকা নিয়ে বাংলাদেশেরই কেউ একজন প্রশ্ন করেন, ভিস্তার বাংলা কি বাংলাদেশের বাংলা কী বোর্ড অনুসরণ করবে নাকি ভারতের বাংলার? উত্তরে বিল গেটস উভয় দেশের জন্যে আলাদা কী-বোর্ড অনুসরণ করা হবে বলেছিলেন। এখন প্রশ্ন হলো, সেই কী বোর্ডের মীমাংসা আজও হয়েছে? বিল গেটস নিশ্চয়ই এটা অনুধাবন করেছিলেন একটি স্বতন্ত্র দেশের মাতৃভাষার সম্মান রাখতে তাকে এ রকম সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। এই প্রসঙ্গ উত্থাপনের প্রধান কারণ হলো, ডিজিটাল বাংলাদেশের বাংলা ইউনিকোড, কী-বোর্ড নিয়ে গবেষণা ও বিশ্ববাজারে ঠাঁই করে নেবার দেনদরবারের অবকাশ এখনও আছে। যেহেতু মোস্তাফা জব্বার এখন মন্ত্রী। আমার বিশ্বাস সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা মন্ত্রণালয় এ নিয়ে যে কাজ করতে পারে তাতে সাফল্য আসতে বাধ্য। তার চেয়ে বড় কথা হলো, এই গবেষণা কাজগুলো কে করবে? নিশ্চয়ই আমাদের মেধাশক্তি। আমাদের হরফের ইতিহাস, ব্যাকরণ ও মুদ্রণশিল্প থেকে কম্পিউটার বর্ণমালায় সাজাতে বাংলা ভাষার ছাত্র হিসেবে মোস্তাফা জব্বার যে আনুপূর্বিক বিবেচনা রেখেছেন তা নিয়ে এখনও প্রচুর কাজ ও গবেষণা করার সুযোগ আছে। সে কাজগুলো নিয়ে আমাদের জন্যে কারিগরি নির্দেশনা থাকা দরকার। নিজেদের সামর্থ্য অর্জন ও প্রমাণের জন্যও কাজগুলো শেষ করে নেয়া জরুরী। এখন ভার্চুয়াল কী-বোর্ড ও স্পিচ কী-বোর্ড নিয়ে দেশে দেশে কাজ হচ্ছে; আমরা কেন পিছিয়ে থাকব যখন আমাদের কী-বোর্ডের মৌলিক কাজ করার অভিজ্ঞতা ও অভিভাবকত্ব দুটোই আছে? বিশ্ববাজারের চিন্তা না করেও আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের কথা মাথায় রাখলে আমাদের মেধা ও যুক্তি জগতের কাজ অসীম। মাথা খাটিয়ে আমরা যে বাজার তৈরি করতে পারি তা তো ‘বিকাশ’ বা ‘পাঠাও’ দেখলেই বোঝা যায়! কিন্তু সেসব মৌলিক কাজের সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে পশ্চিমা পুঁজি। আমাদের সে রকম নীতি এখন দরকার যাতে দেশীয় পুঁজির সমাবেশ এখন দেশের মেধাসম্পদ দিয়ে অর্জিত জ্ঞানের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ হয়। যেমন আমরা যদি চিন্তা করি, আমাদের সব বই আমরা ডিজিটাল করব যা যুগের দাবি হয়ে উঠছে সে কাজের উদ্ভাবনী যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে তার গবেষণা কে করবে? নিশ্চয়ই এদেশের শ্রমশক্তি? সে কারণেও আমাদের ভাবা দরকার কেমন করে দেশের অভ্যন্তরে আমরা এই কাজগুলো করতে একটি সহায়ক নীতিমালা করে নিতে পারি। অ্যামাজন এখন ভারতে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। কারণ, সে বাজারে ঢোকার সুযোগ পেয়েছে। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই সে রকম বাজারের কারিগরি কৌশল জানে যা দিয়ে সে অ্যামাজনকে বশে রেখে নিজের বাজার সম্প্রসারণ করে নিতে পারে। সে সুযোগ ও অধিকার ডিজিটাল বাংলাদেশের আছে। সহায়ক পুঁজি বা অর্থের অভাবে আমাদের ছেলেমেয়েরা বুদ্ধি দিয়ে কোন এ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার তৈরি করা শুরু করে শেষ করতে পারে না। যুক্তির অভাবে অনেক কাজ মাঝপথে ফেলে সে অন্য কোন সুযোগ খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু বুদ্ধির বাজারে তো দেখা গেছে অনেক বেশি উচ্চ শিক্ষিত বা বড় ডিগ্রীধারী লোকবল খুব কম। আধাখেঁচড়া পড়ে যদি কেউ বুদ্ধির জোরে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি টাকার মালিক হতে পারে বাংলাদেশের একজন কেন সামান্য সহায়ক পুঁজি পেয়ে বুদ্ধি খাটিয়ে তার সংসার চালাবার মতো সামর্থ্য অর্জন করতে পারবে না? ডিজিটাল বাংলাদেশের জ্ঞানসমাজে নিশ্চয়ই এমন বৈষম্য আমরা তৈরি করতে চাই না। বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের মানুষের বেশিরভাগই কৃষিকাজে জড়িত। সেসব পরিবারের সবাই নিশ্চয়ই তথ্য প্রযুক্তির কর্মী হবে না কিন্তু সর্বশেষ সেবাটুকু পেতে সে প্রস্তুত। আমার বিশ্বাস, সাধারণ মানুষের বুদ্ধি ও যুক্তির সম্মানে আমাদের চিন্তা ও কাজ দেশের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়াই ভাল। সরকার শুধু সে পরিবেশ আর একটু সম্প্রসারণ করে দিলেই হবে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্যে তথ্য প্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×