ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছে কয়েক ঋষি পরিবার

প্রযুক্তির চাপে ঐতিহ্য হারাচ্ছে কুটির শিল্প, ভাল নেই কারিগররা

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৬ জানুয়ারি ২০১৯

প্রযুক্তির চাপে ঐতিহ্য হারাচ্ছে কুটির শিল্প, ভাল নেই কারিগররা

বিশ্বজিৎ মনি ॥ কালের বিবর্তনে পেশাগত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে কুটির শিল্প। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো নওগাঁ অঞ্চলের কুটির শিল্পের কারিগররাও এখন আর খুব একটা ভাল নেই। নিজেদের জাত পেশা ছেড়ে অনেকেই এখন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন অন্য পেশা। এর পরেও বাঁশ আর বেতকেই জীবিকার প্রধান বাহক হিসেবে আঁকড়ে ধরে রেখেছে জেলার রানীনগর উপজেলার কুটির শিল্পের কারিগররা। এই বাঁশ আর বেতই বর্তমানে তাদের জীবিকার প্রধান বাহক। কিন্তু দিন দিন বাঁশ আর বেতের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় ভাল নেই এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগররা। তবুও বাপ-দাদার এই পেশাকে এখনও ধরে রেখেছে কিছু সংখ্যক ঋষি পরিবার। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে নওগাঁর রানীনগর উপজেলায় বাঁশ ও বেত শিল্পের তৈরি মনকাড়া বিভিন্ন জিনিসের জায়গা করে নিয়েছে স্বল্প দামের প্লাস্টিক ও লোহার তৈরি পণ্য। তাই বাঁশ ও বেতের তৈরি মনকাড়া সেই পণ্যগুলো এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। কদর না থাকায় গ্রামগঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের তৈরি বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় আকর্ষণীয় আসবাবপত্র। অভাবের তাড়নায় এই শিল্পের কারিগররা দীর্ঘদিনের বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে আজ অনেকে অন্য পেশার দিকে ছুটছে। শত অভাব অনটনের মাঝেও উপজেলায় হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার আজও পৈত্রিক এই পেশাটি আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে রানীনগর উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের কাশিমপুর ঋষিপাড়ার ৩০-৩৫টি, মিরাট ইউনিয়নের কনোজ গ্রামে ৪০/৫০টি, গোনা ইউনিয়নের নিজামপুর গ্রামে ১১০টি পরিবার, কৃষ্ণপুর গ্রামের ৫০টি ও ঝিনা গ্রামের ৭০টি পরিবারই বর্তমানে এই শিল্পটি ধরে রেখেছেন। পুরুষদের পাশাপাশি সংসারের কাজ শেষ করে নারী কারিগররাই বাঁশ দিয়ে এই সব পণ্য বেশি তৈরি করে থাকেন। বর্তমানে বেত তেমন সহজ লভ্য না হওয়ায় বাঁশ দিয়েই বেশি এই সব চিরচেনা পণ্য তৈরি করছেন এই কারিগররা। বর্তমানে আধুনিকতার যুগে বাজারে সহজলভ্য ও আর্কষণীয় বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য ও আন্যান্য দ্রব্য মূল্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারায় এই শিল্পের অনেক কারিগররা তাদের বাপ-দাদার পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এসব বাঁশ শিল্পের কারিগররা তাদের পূর্ব পুরুষের এ পেশা আঁকড়ে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেও হিমশিম খাচ্ছেন। দিন দিন বিভিন্ন জিনিসপত্রের মূল্য যেভাবে বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না এই শিল্পের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের দাম। যার কারণে কারিগররা জীবন সংসারে এই পণ্যকে টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। কয়েক দশক আগে নওগাঁ জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হতো এসব কারিগরদের তৈরি বাঁশ ও বেতের পণ্যগুলো। এক সময় রানীনগরসহ দেশের ঘরে ঘরে ছিল বাঁশের তৈরি ডালা, কুলা, চালুন, খলই, খৈচালাসহ নানা সামগ্রী। এসবের কদরও ছিল অনেক। কালের বিবর্তনে ব্যাপকভাবে আর চোখে পড়ে না এই পণ্যগুলো। অপ্রতুল ব্যবহার আর বাঁশের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাঁশ শিল্প আজ হুমকির মুখে। বাঁশ ও বেত থেকে তৈরি সামগ্রী বাচ্চাদের দোলনা, র‌্যাক, পাখা, ঝাড়ু, টোপা, ডালি, মাছ ধরার পলই, খলশানীসহ বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র গ্রামঞ্চলের সর্বত্র বিস্তার ছিল। এক সময় যে বাঁশ ২০ থেকে ৩০ টাকায় পাওয়া যেত, সেই বাঁশ বর্তমান বাজারে কিনতে হচ্ছে দুই শ’ থেকে আড়াই শ’ টাকায়। সেই সঙ্গে বাড়েনি এসব পণ্যের দাম। জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ ঘর-বাড়ি নির্মাণে যে পরিমাণ বাঁশের প্রয়োজন, সে পরিমাণ বাঁশের ঝাড় বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এই পরিবারগুলো বিভিন্ন সময়ে আসা সরকারীভাবে সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। তাই বাপ-দাদার এই পেশাকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে আজ তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। রানীনগরের কাশিমপুর ঋষিপাড়ার নারী কারিগর রত্না, কাজলী, দহর চাঁদ, রুহিদাস, উপেন দাসসহ অনেকে বলেন, এই গ্রামের পরিবারগুলো আজও এ কাজে নিয়োজিত আছে। একটি বাঁশ থেকে ১০-১২টি ডালি তৈরি হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিটি পণ্য থেকে ১০-২০ টাকা করে লাভ থাকে। তবে আগের মতো আর বেশি লাভ হয় না এখন। তাই এই সীমিত লাভ দিয়ে পরিবার চালানো অতি কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা নিজেরাই বিভিন্ন হাটে গিয়ে ও গ্রামে গ্রামে ফেরি করে এই সব পণ্য বিক্রি করে থাকেন। তারা আরও জানান, খেয়ে-না খেয়ে অতি কষ্টে তাদের বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী এই বাঁশ শিল্প টিকে রাখতে ধার-দেনা ও বিভিন্ন সমিতি থেকে বেশি হারে সুদ দিয়ে টাকা নিয়ে কোন রকম বাপ-দাদার এই পেশাকে আঁকড়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। আমাদের এই শিল্পটির উন্নতি কল্পে যদি সরকারীভাবে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া হয়, তাহলে বাঁশ শিল্পের কারিগররা অন্তত স্বাবলম্বী হতে পারবে। আর হারিয়ে যাওয়া এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে তারা।
×