ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ॥ জামায়াতমুক্ত সংসদ এবং আমাদের প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ২৬ জানুয়ারি ২০১৯

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ॥ জামায়াতমুক্ত সংসদ এবং আমাদের প্রত্যাশা

(গতকালের সম্পাদকীয় পাতার পর) ২. বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মী ও ভোটাররা চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ দেয়া মেনে নিতে পারেননি। এই একটি কারণে বিএনপির বহু সমর্থক এবার ভোট দিতে যাননি। ৩. গত আট বছরে যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচারের মাধ্যমে ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্ততার যে সব প্রমাণ প্রকাশ্যে এসেছে তাতে জামায়াতের প্রতি সাধারণ মানুষের ঘৃণা অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় বেড়েছে। ৪. ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদের প্রাক্কালে উচ্চতর আদালত কর্তৃক জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার কারণে জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। জামায়াত যেহেতু দল হিসেবে নির্বাচন করতে পারবে না- তারা বিএনপিকেও নির্বাচন করতে দেয়নি। সেবার জামায়াত-বিএনপি শুধু নির্বাচন বর্জনের ঘোষণাই দেয়নি, তাদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে তারা- বিশেষভাবে হিন্দু সম্প্রদায় ব্যাপক সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে জামায়াত-বিএনপির জোট যে নজিরবিহীন আগুন সন্ত্রাস সংঘটিত করেছে তাতে সাধারণ মানুষ এ দল দুটি সম্পর্কে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এবার তাদের ভয় ছিল- নির্বাচনে জিতলে বিএনপি-জামায়াত ২০০১-এর চেয়ে বেশি সন্ত্রাস করবে। ৫. একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং সমমনা বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নির্বাচনের প্রাক্কালে জামায়াত-বিএনপির দুঃশাসন ও সন্ত্রাসের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে বহুমাত্রিক প্রচারাভিযান পরিচালনা করেছে। এবারে নির্বাচন উপলক্ষে নির্মূল কমিটি ছয় মাসে শতাধিক সভা-সমাবেশ করেছে, ৭টি পুস্তক/পুস্তিকা, ৪টি পোস্টার ও দুটি লিফলেট প্রকাশ করে সারাদেশে লাখ লাখ কপি বিতরণ করেছে। এছাড়া প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করেছে, ঝুঁকিপূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় ‘সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করেছে সম্ভাব্য হামলা থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষার পাশাপাশি তারা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে তা নিশ্চিতকরণের জন্য। ৬. এবারের নির্বাচনে দেশের সুপরিচিত শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করার জন্য যেভাবে কাজ করেছেন, জামায়াত-বিএনপির শিবিরে তেমন কেউ ছিলেন না। ৭. বিএনপির নেতারা সব সময় বলেছেন- শেখ হাসিনার অধীনে তারা নির্বাচন করবেন না, খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত না করে তারা নির্বাচনে যাবেন না। কামাল হোসেন গং বিএনপি-জামায়াত জোটে শামিল হওয়ার পর বিএনপির নেতারা বলেছেন আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা নির্বাচনে যাচ্ছেন- এটি প্রমাণের জন্য যে, শেখ হাসিনার অধীনে কোন নির্বাচন হতে পারে না। এর ফলে সর্বস্তরের কর্মী ও সমর্থকরা প্রচণ্ড বিভ্রান্তির মধ্যে ছিল। আন্দোলন না নির্বাচন- এটি শেষ মুহূর্তে বিএনপির নেতারা স্পষ্ট করতে পারেননি। ৮. আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে এক বছর ধরে, অথচ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যে প্রস্তুতি নেয়া দরকার বিএনপি কিছুই করেনি। যার ফলে ৪০ হাজার কেন্দ্রে দুই লাখেরও বেশি বুথে পোলিং এজেন্ট দেয়ার সামর্থ্য বা প্রস্তুতি কোন কিছুই বিএনপির ছিল না। মামলার ভয়ে বিএনপির বহু কর্মী এলাকা ছেড়েছে কিংবা আত্মগোপন করেছে। ৯. প্রধান দুই নেতা- খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান মাঠে না থাকায় বিএনপির নেতৃত্বশূন্যতা ও শীর্ষনেতাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব এত দৃশ্যমান ছিল যে, কর্মী ও সমর্থকরা নির্বাচনে লড়বার মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল। গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে বারবার জানতে চাওয়া হয়েছে- বিএনপি-জামায়াত জোট এবং কামাল হোসেনদের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সম্মিলিতভাবে অভিন্ন প্রতীকে নির্বাচন করলেও তাদের প্রকৃত নেতা কে, জোট জয়ী হলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন এটি কেউ বলতে পারেননি, যা কর্মীদের হতাশ করেছে। ১০. কামাল হোসেন ও কাদের সিদ্দিকীদের সঙ্গে বিএনপির আঁতাতে জামায়াত প্রথম থেকেই ক্ষুব্ধ ছিল। দাবি অনুযায়ী আসন না পেয়ে তারা আরও ক্ষুব্ধ হয়েছে। যে কারণে অন্যান্যবার বিপুল সংখ্যক জামায়াত-শিবির কর্মী ধানের শীষের এজেন্ট হিসেবে কাজ করলেও এই নির্বাচনে জামায়াত তাদের যাবতীয় লোকবল নিজেদের দলীয় প্রার্থীদের এলাকায় কেন্দ্রীভূত করেছে। ১১. বিএনপির শীর্ষ নেতাদের চরম ভারত বিরোধিতার পাশাপাশি দিল্লী গিয়ে নানা ধরনের তদবির এবং বিজেপির সমর্থন লাভের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা জামায়াতকে প্রচণ্ডভাবে অসন্তুষ্ট করেছে এবং দলীয় কর্মীরা বিভ্রান্ত হয়েছে। অন্যদিকে আইএসআইর সঙ্গে বিএনপি নেতাদের গোপন বৈঠক, টেলিফোন সংলাপ ও ষড়যন্ত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা ক্ষুব্ধ এবং হতাশ হয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর সঙ্গে জামায়াত-বিএনপির সম্পৃক্ততা সাধারণ ভোটারদের ভেতরও এই দল দুটি সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করেছে। ১২. আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের তুলনায় বিএনপি-জামায়াত জোট এবং কামাল হোসেনদের ইশতেহার এত নি®প্রভ ছিল যে, ভাসমান ভোটারদের তা বিন্দুমাত্র আকৃষ্ট করতে পারেনি। বিএনপির প্রধান দাবি খালেদা জিয়ার কারামুক্তি দলের সমর্থকদের আকৃষ্ট করতে পারে, ভাসমান ভোটাররা এতে বিন্দুমাত্র আগ্রহী ছিল না। তারা দেখতে চেয়েছিল শেখ হাসিনার সরকারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অভিযাত্রার বিপরীতে বিএনপি-জামায়াতের অবস্থান, যা এই দুই দলের ইশতেহারে ছিল না। যার ফলে সর্বত্র নির্বাচনী হাওয়া নৌকার পালেই লেগেছিল, ধানের শীষে নয়। আরও কারণ উল্লেখ করা যায়, তবে মোটা দাগে বিএনপি-জামায়াতের ভরাডুরি বোঝার জন্য উপরের কারণগুলোই যথেষ্ট। একটি বিষয়ে নাগরিক সমাজ এবং ১৪ দলীয় জোটকে সতর্ক থাকতে হবে- একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিশাল বিজয় এবং জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের অতি নগণ্য উপস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করতে হলে, সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে জাতীয় সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা প্রয়োজন। অন্যথায় সরকারী দলের পদস্খলনের সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এ বিষয়গুলো অনুধাবন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সরকারের শীর্ষ নেতারা শুরু থেকেই সুশাসন ও জবাবদিহিতার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, যা প্রশংসার যোগ্য। ক্ষমতাসীন দল ও সরকারকে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে মৌলবাদী ও মাদক সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দলবাজি, অন্তর্কলহ ও অন্তর্ঘাত মোকাবেলার ক্ষেত্রে। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অংশ নিতে গিয়ে দেখেছি সাতক্ষীরার মতো জামায়াত অধ্যুষিত এলাকায় জামায়াত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলে দলে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়ছে আত্মরক্ষা এবং অন্তর্ঘাতের জন্য। এর আগের মেয়াদে জামায়াত-শিবিরের বহু সদস্য আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের হাত করে বিভিন্ন সরকারী, আধা-সরকারী প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনে ঢুকে পড়েছে। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড যদি এখনই সতর্ক না হয় এটি শুধু দল বা সরকার নয়, দেশ ও জাতির জন্য সমূহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। জামায়াত যেভাবে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভেতর জঙ্গিবাদী-জিহাদী কার্যক্রম পরিচালনা করছে এটি আগামীতে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সমূহ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পরিধি আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। দলীয় ইশতেহার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হতে পারে সরকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবস্থানকারী জামায়াত-বিএনপির অন্তর্ঘাতীরা। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা গত তিন মেয়াদে সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতুলনীয় সাহস, প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে শেখ হাসিনার নাম। বর্তমান সরকারের সাফল্য এবং ইতিবাচক কার্যক্রম বিতর্কিত ও বাধাগ্রস্ত করার জন্য জামায়াত-বিএনপির লবি অতীতের মতো দেশে-বিদেশে সক্রিয় থাকবে। এটিও মহাজোট সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। শেখ হাসিনার সরকারের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার উত্তরাধিকারত্ব। এই সরকারের মেয়াদকালে উদযাপিত হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে দেশে আমরা কোন স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন ও কর্মকা- দেখতে চাই না। আমরা আশা করব, এই দুটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদার আরও উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হবে। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচারে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচার করার জন্য আমরা গত আট বছর ধরে বলছি। আমরা পাঁচ বছর ধরে বলছি ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের শাস্তির অংশ হিসেবে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। নতুন মন্ত্রিসভার দায়িত্ব গ্রহণ করে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক এ দুটি দাবি পূরণের ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা নির্বাচনের আগে আবারও বলেছিলাম, দ্রুত দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল পুনরুজ্জীবিত করে গণহত্যাকারীদের সংগঠনগুলোর বিচার আরম্ভ করার জন্য। আশা করি সেটি বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে সম্পন্ন হবে। আমাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি- সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণী থেকে আরম্ভ করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের ও বাঙালীর ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রাক্কালে আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাংস্কৃতিক বিপ্লব। বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে, রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে, মনোজগতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাঋদ্ধ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিকল্প নেই। (সমাপ্ত) ১৯ জানুয়ারি ২০১৯
×