ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অরুণ-বরুণ...

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ২৬ জানুয়ারি ২০১৯

অরুণ-বরুণ...

এই শহরের মানুষেরও প্রতিদিনের জীবন এখন আর আগের মতো নেই। ভয় আতঙ্ক ভরা সময়। শহরের পথ-ঘাট থমথমে, জনশূন্য। অরুণ অনেকদিন গ্রামে তার নানির কাছেই ছিল। মাত্র সেদিন ফিরেছে সে। সেদিন বাড়িতে পা রাখতেই বাবার গম্ভীর গলা- একা একা চলে এলি? তাকে দেখে মা অবাক- তুই না বলে কয়ে? অরুণ নানির চেনা মানুষের সঙ্গে এসেছে জানালে স্বস্তি পায় তারা। এখন শহর ছাড়াও পাক আর্মিরা গ্রাম অপারেশনে গিয়েও পাশবিক অত্যাচার করছে। আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে কৃষক, গেরস্তের ঘরবাড়ি। নিরপরাধ মানুষ মারছে দেদার। যে জন্য নানি তাকে শহরে পাঠানোর ব্যবস্থা করে ফেলে। শহরে তাদের বাড়িটার সামনের বাগান এখন ঝোপ-জঙ্গলে ভরা আর বাড়িটা যেন অন্ধকারে ঢাকা। যেমন অন্ধকারে ঢাকা এখন দেশটাও। দেশ নিয়ে তাদের অনেক চিন্তা। তেমন চিন্তা আছে বাবা-মায়ের তাকে নিয়েও। তাই বাইরে যাওয়া মানা অরুনের। স্কুলে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। ফাঁকা স্কুলে কেবল ঘণ্টাই বাজে ঢং ঢং। বিশাল মাঠে ধু-ধু বাতাসে ঝরা পাতাদের ওড়াউড়ি। রাতে গভীর মন দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের নিউজ শোনে সেও। বায়ান্নোর একুশের সাহসী ভাষা সৈনিক বাবাকে সেদিন অরুনের প্রশ্ন- বাবা কেন যুদ্ধে যাচ্ছ না? বাবার হতাশ উত্তর-বয়স হয়েছে, আছে হাই ব্লাডপ্রেশার, চোখে মোটা চশমা। তাই ইচ্ছে থাকলেও...। অরুনের মনে এই প্রশ্ন জাগে তেরো বছর কি যুদ্ধে যাবার জন্য অনেক কম? আর কিভাবে সে যুদ্ধে যাবে, কোন পথে ওপারে যেতে হবে, কার সঙ্গেই বা যাবে? সে শুনেছে শহরের অনেকে চলে গেছে মুক্তিযুদ্ধে। তারও ইচ্ছে। কিন্তু বাবা-মা কেউ রাজি হবে না। কোথাও বাইরে যেতে দিতেই তাদের কত ভয়, চিন্তা। পাছে বিপদ হয়। যুদ্ধে যাওয়া মানে তাদের চোখের আড়াল হওয়া। এলএমএফ ডাক্তার বাবা প্রায় ওকে সঙ্গ দিলেও ভেতরে যেন এক অতৃপ্তি, তাগিদ-তোমার কি কোন দায়িত্বই নেই অরুণ? দেশের স্বাধীনতা চাইলেও ছেলেকে যুদ্ধে যেতে দিতে নারাজ বয়স কম আর একটাই ছেলে বলে। কিন্তু শহরে থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য তো করা করা যায়। কিভাবে তা বোঝে না বলে মনে কষ্ট তার। এর মাঝে এসেছে আষাঢ়। প্রচন্ড বৃষ্টি। সেদিনও রাতে অঝোর বৃষ্টি। চলছে ব্লাক আউট। হঠাৎ দরজাতে কড়া নাড়ার শব্দ। কে এল এত রাতে বৃষ্টি মাথায়? বাবা এগিয়েছে দরজার দিকে। এরপরে তার সঙ্গে যাকে দেখা গেল তাকে অরুণ আগে না দেখলেও মুহূর্ত পরেই বুঝে যায়। বরুনের কত গল্প শুনেছে অরুণ। বাবা চিন্তিত স্বরে বলেন ...অরুনের মা ওকে চিনতে পেরেছ? চিনব না কেন? ও তো বরুণ...। অরুনের বাবার চাচাত ভাইয়ের ছেলে সে। ওর সঙ্গে মিল করেই অরুনের নাম রাখা। তখন ওরা এই শহরে পড়শীও ছিল। কতদিন ওদের সঙ্গে দেখা নেই। শুধু ছবি দেখা। হয়ত চিঠিতে যোগাযোগ। কিন্তু ওর কি হয়েছে? পায়ে এত রক্ত? চেহারা উদভ্রান্ত। এত বড় চুল, দাড়ি গোঁফে ঢাকা চেহারা। বাবা ততক্ষণে অরুনের শুশ্রুষা চিকিৎসা দুই শুরু করেছে। পায়ের ক্ষত ধুয়ে-মুছে তুলায় ডেটল লাগিয়ে ব্যান্ডেজ দেয়ার পর রক্তপাত কমে আসে। মার হাতে দুধের গ্লাস। বাবার কাছে বরুনের যুদ্ধে যাবার গল্প শুনেছে সে। সেই যোদ্ধাকে দেখতে পাওয়া তো ভাগ্য। একজন মুক্তি সেনাকে সাহায্য করাও তো যুদ্ধেরই অংশ। সে দুধের গ্লাস তুলে ধরে বরুনের মুখে। পরম যত্নে খাইয়ে দেয় বিছানায় আধশোয়া বরুনকে। নোংরা কাপড় বদলে ওদের পরিষ্কার কাপড় ও পরে নিয়েছে অসুস্থ অতিথি যোদ্ধা। এইবারে বরুণ জানায় কিভাবে এই অবস্থা হয়েছে। আজ সন্ধ্যায় গ্রাম থেকে দলের সঙ্গে সেও ঢোকে এই শহরে। অপারেশন করার কথা ছিল ওদের। কিন্তু মিলিটারিদের নজরে পরে যাওয়াতে সে আর কিছুই করতে পারেনি। পাকসেনাদের নজর এড়িয়ে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে দিগি¦দিক ছোটার সময় গাছের তীক্ষ্ন ডালের খোঁচা লাগে তার পায়ে। এতে ক্ষত, অনেক রক্তপাত। ভাগ্যক্রমে এই পাড়াতেই সে ছিল বলে চেনা আপনজনের বাড়িতে ঢুকে গিয়েছে সুযোগ বুঝে। একবার তারা সকলে বেড়াতে এসেছিল বলে চেনা বাড়িটি। এর আগে লুকিয়ে ছিল নদীর ধারে জঙ্গলে। এক ফাঁকে বেড়িয়ে আসতে পেরেছে। বরুনের শোবার ব্যবস্থা হয়েছে এর মধ্যে। হারিকেন হাতে অরুণ নিয়ে যায় বরুনকে। ওখানে শতরঞ্চির ওপরে মেঝেতে মোটা তোষক বিছিয়ে সুন্দর বিছানা করা হয়েছে। অরুণ খুবই আন্তরিক...এখন আজকের মতো ঘুমিয়ে যাও। সুস্থ না হয়ে কোথাও যেতে পারবে না কিন্তু। বাবার দেয়া ব্যথা কমার ওষুধে পায়ের ব্যথাও এখন কিছু কম বলে রক্ষা। ব্লিডিংও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই খুব ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত তরুণ যোদ্ধা ঘুমিয়ে গেলেও তুমুল বৃষ্টিভরা রাত প্রায় জেগে কাটায় ওরা। সকলেই চিন্তিত... পাক সেনা কোনভাবে জেনে চলে আসে যদি? এমন আতঙ্কে রাত আরও গভীর হয়। ভোর হলেও মেঘে ছাওয়া আকাশ দেখে বোঝা যায় না। রাতভর চিন্তিত বাবা-মা জাগাই ছিল বলে তারা ঘুমিয়ে এখন। অরুণ নিজে রাতে এক সময় ঘুমিয়ে গিয়েছিল তাই সে জেগেছে। সে চুপিচুপি বের হয় যাতে বাবা-মায়ের ঘুম না ভাঙ্গে। কেরোসিন চুলা ধরিয়ে ডিম সিদ্ধ বসায়। ফ্লাক্সে রাখা পানিতে দিব্যি এককাপ হরলিক্সও বানানো শেষ। সে রেডি পাশের রুমে যাবার জন্য। খুব তৃপ্তি পায় তারা এক যোদ্ধাকে নিজেদের বিপদ হতে পারে জেনেও আশ্রয় দিয়েছে বলে। এ তো মুক্তিযোদ্ধাই। এখন মুক্তিযোদ্ধাকে খাইয়ে দিতে পারলে ভাল লাগবে তার। আবছা অন্ধকার ঘরে বিছানা খালি দেখে বুক কেঁপে ওঠে তার। তবে কি রাতে কোন বিপদ হয়েছে..? নাহ, ওরা জানত তাহলে। এবারে সে দেখে শূন্য বিছানায় রাখা চিঠিটি যাতে লেখা...আমি এখন সুস্থ। তাই নদীর ওপারে সহযোদ্ধাদের কাছে যাচ্ছি। তাদের জানানো আছে অশেষ কৃতজ্ঞতা। তাদেরও মুক্তিযোদ্ধা বলেছে বরুণ। অরুণ, তুমিও তো এক যোদ্ধা। আমার কত যত্ন করেছ। বলেছিলে আমার কাছে যুদ্ধের গল্প আর কিভাবে যোদ্ধাদের সাহায্য করা যায় শুনবে। এই তো এভাবেও করা যায় । অরুনের চোখ ভিজে আবছা হয়ে আসে চিঠি। অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×