ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মলয় বিকাশ দেবনাথ

নকশাবিদ মোহাম্মদ ইদ্রিস

প্রকাশিত: ০৭:৩১, ২৫ জানুয়ারি ২০১৯

নকশাবিদ মোহাম্মদ ইদ্রিস

সতেরো বছরের তরুণ ইদ্রিস। দেশভাগের তিন বছর পর ২৩ মার্চ নিজ উদ্যোগে কিছু সমমনা অগ্রজ-অনুজদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন মুনশীপাড়া পাবলিক লাইব্রেরি রংপুর। বইপড়া অন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন একজন পথপ্রদর্শক। তাঁর সম্পাদনা প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জার প্রকাশিত করেন লাইব্রেরির বার্ষিক মুখপাত্র ‘মশাল’। স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য ছিল, পুরো পত্রিকাটি হাতে লেখা ও আঁকা। বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির জন্য তিনি তৎকালীন বিভিন্ন পত্রিকায় সুঅঙ্কিত বিজ্ঞাপন চিত্র প্রচার করেছেন। যেমন : ‘বই পড়া অপরাধ নয়, বই প্রাণের বাহক, বিচিত্র মনের সন্ধান পাবেন। ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমি ও ন্যাশনাল বুক সেন্টার অব পাকিস্তানের সহযোগিতায় তাঁর সম্পাদনা ও অঙ্গসজ্জায় প্রকাশিত ‘বই পড়া’ পুস্তকটি সুনির্বাচিত সঙ্কলন হিসেবে পাঠক মহলে সমাদৃত হয়। এ ছাড়া তিনি ‘ইদু বাউদিয়া’ ছদ্মনামে শিশুতোষ ছড়াকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর সম্পাদিত শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ ‘এলের পাত বেলের পাত; লেকেজ ও আধুনিক ছড়ার এক অনন্য মিথষ্ক্রিয়া। এ ছাড়া ‘হাসির দেশ’ তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য ছড়াগ্রন্থ। তিনি বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য ও ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশ এবার ঢেলে সাজানোর পালা। প্রতিটি জায়গায় সংস্কার ও নতুনভাবে বিনির্মাণ করাই ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মূল লক্ষ্য। আধুনিক মানসিকতায় স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর তার সমস্ত কর্মে প্রমাণ রেখেছেন। প্রতিটি জায়গায় সুযোগ্য ও দক্ষ কর্মীদের দিয়ে ঢেলে সাজানো হয়। ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে ডাক বিভাগের খাম ও ডাকটিকেটের জন্য নকশা আহ্বান করে। মোহাম্মদ ইদ্রিস সেই সময় খামের জন্য নকশা পাঠান। ডাক বিভাগের জুরি বোর্ড তার পাঠানো নকশাটি নির্বাচন করেন। শাপলা ফুলের নকশা ছিল বাংলাদেশ ডাক বিভাগের প্রথম চিঠির খাম যা আজও দেখা যায়। ডাক টিকেটের জন্য তিনি আবহমান বাংলাকে উঠিয়ে এনেছিলেন তার নকশায়। মোহাম্মদ ইদ্রিস ছিলেন জয়নুল আবেদিন প্রতিষ্ঠিত আর্ট কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। পাঠ শেষে তিনি প্রথম যোগ দেন তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভারে। পাশাপাশি তিনি যুক্ত ছিলেন। পটুয়া কামরুল হাসানের ‘রূপায়ণ’ নামক হস্ত শিল্পজাত শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। সদ্য স্বাধীন দেশ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় পতাকা জাতীয় প্রতীক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রাম করার জন্য কামরুল হাসানকে দায়িত্ব দেন। শিল্পী কামরুল হাসান তার অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ও নিপুণ শিল্পী মোহাম্মদ ইদ্রিসসহ বেশ কয়েকজনকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রদান করেন। তাঁর তৈরি ভাসমান শাপলা ও শামসুল আলমের করা দুই পাশে ধানের শীষ বেষ্টিত পাটপাতা ও চারটি তারকা। দু’জনের এই ডিজাইন মিলে প্রতীকটির চূড়ান্ত ডিজাইন দাঁড় করানো হয়। এভাবেই ইতিহাসের নিজেকে নিবেদন করেন তাঁর কর্মের মধ্য দিয়ে। প্রচারবিমুখ এই গুণী শিল্পী প্রথম সার্ক সম্মেলনে দায়িত্বপ্র্রাপ্ত ডিজাইনার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ৭২ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এলে বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় উপহার হিসেবে যে ময়ূর অঙ্কিত জামদানি শাড়িটি উপহার দিয়েছিলেন সেই শাড়ির নকশা ছিল তাঁরই করা। হস্তজাত শিল্পের উৎকর্ষ সাধন ও তার প্রসারে তিনি নিরলস শ্রম দিয়েছেন। জীবনের অধিকাংশ সময়ই পার করেছেন এসব কর্ম নিয়ে। জামদানি শিল্প যখন মুখ থুবড়ে পড়েছিল অর্থাৎ দেশ বিভাজনের পর যখন উচ্চবিত্ত হিন্দু পরিবারগুলো ভারতে চলে গিয়েছিল তখন জামদানি শিল্পে এক চরম সঙ্কট সৃষ্টি হয়। মুসলিম তাঁতীরা সব বেকার হয়ে পড়েন। শিল্পী মোহাম্মদ ইদ্রিস তখন এই শিল্প রক্ষায় এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছিলেন। কামরুল হাসানের সহায়তায় তিনি জামদানি তাঁতীদের জন্য ন্যায্যমূল্যে সুতার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই সঙ্গে এঁকেছেন বিভিন্ন নকশা। বিপণনেও সহযোগিতা করেন নানাভাবে। জামদানি শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়ায় শুধুমাত্র তারই জন্য। এই ঐতিহাসিক শিল্পকে তার যথাযথ মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি। এই ইতিহাস আজ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। গুণী এই শিল্পী বাংলা ১৩৩৮ সনের ২৭ বৈশাখ রংপুরের মুনশীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি যোগ দেন কামরুল হাসানের ডিজাইন সেন্টার যা পরে বিসিকের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ১৯৯১ সালে তিনি সেখান থেকে উপপ্রধান ডিজাইনার হিসেবে অবসর নেন। মোহাম্মদ বসির উদ্দিন আহমেদ ও আছিয়া খাতুনের চার ছেলে এবং তিন কন্যার মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তিনি পারিবারিক জীবনে এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের পিতা। ৮৭ বছর বয়সী এই শিল্পী আজ শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে হসপিটালে ভর্তি। পরিবার থেকে সবাইকে দোয়া করতে বলেছেন তিনি। সেই সঙ্গে আক্ষেপ করে তার ছেলে বলেন, রাষ্ট্রীয় কোন সম্মান তাঁকে দেয়া হয়নি। যার শিল্পকর্ম আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে সেই ইতিহাসকে লালন করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব।’ আগামী ২৭ বৈশাখ তিনি ৮৮ বছরে পা রাখবেন। হে গুণী ‘আগাম শুভ জন্মদিন’।
×