ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা সাহিত্যের নাগরিক কবি

প্রকাশিত: ০৭:২৭, ২৫ জানুয়ারি ২০১৯

বাংলা সাহিত্যের নাগরিক কবি

কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা নলিনীকিশোর গুহের সম্পাদনায় প্রকাশ হয়। তারপর একেএকে তার কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হতে থাকে। ফলে কবিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তখন থেকেই তার শুধু সামনে বাংলার কাব্যজগতকে জয় করা। আর এভাবেই কবির সামনে চলার পথ তৈরি হয়। মাত্র ১৯ বছর বয়সে কাব্য জগতে প্রবেশ করে কাব্যের রঙে রাঙিয়ে শিল্পের শিল্পতাকে একান্তে মনে-প্রাণে ধারণ করে একজন সত্যিকারের শব্দশ্রমিক হিসেবে নিজেকে বাংলা কাব্যভুবনে উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। পরবর্তিতে কবির কাব্যজীবনে তারই প্রভাব ফেলেছে। তিনি সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি নিষ্ঠা সততা ও দক্ষতার সঙ্গে সাংবাদিকতার কাজও করেছেন। ১৯৫৭ সালে ‘মর্নিং নিউজ’-এ চাকরি জীবন আরম্ভ করেন এবং ‘দৈনিক বাংলা’র সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। কবিতা যদি চিত্রকল্প হয়ে থাকে তবে বলব যে, কবি শামসুর রাহমান চিত্রকল্পের নৌকায় চড়ে শব্দ ছন্দ ভাষার মাঝি হয়ে কবিতাকে চিত্রকল্পের একদম নান্দনিক রূপ চিত্রায়িত করেছেন। এক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে শামসুর রাহমান যদি একটু বেশি এগিয়ে থাকেন তবে তাতে তেমন দোষের কিছু নেই বলেই মনে হয়। যেহেতু তার সমকালীন কবিদের অনেককে পেছনে ফেলে আপন কবিসত্তা নিয়ে শব্দকে হাতিয়ার বানিয়ে ছন্দ ভাব ভাষা উপমা কল্পনা শক্তিকে তিনি কাজে লাগিয়ে একজন বোদ্ধা লেখক রূপে প্রকাশ হয়েছেন। আর তাই কবিতা যদি হয় চিত্রকল্পের একান্তে শিল্পময় প্রকাশ তবে সেক্ষেত্রে কবি শামসুর রাহমানের কবিতাদ্বয়ে চিত্রকল্পের রঙে রাঙানো চরম সার্থকতার প্রকাশ ঘটেছে। বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে কাব্যে তিনি নববিন্যাস অবকাঠামো তৈরি করেছেন। কবিতাকে তিনি শুধু শব্দে শব্দে গেথে ছন্দে ভাবে রসে ভাষায় বোধে নির্মানই করেননি কবিতাকে সচেতনভাবে শিল্পের চিত্রকল্পের রূপ দান করেছেন। এখানেই কবির কবিসত্তা আপন মহিমায় সুকুমার হয়ে আকাশের মতো উদার হয়ে সাগরের মতো উত্তাল ঢেউ হয়ে পাখির ডানার মতো চিত্রময় শিল্পময় ছন্দময় রসময় ভাবময় একদম নিরেট নান্দনিক হয়ে উঠেছে। আমরা তাই কবি শামসুর রাহমানকে সমকালীন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান শক্তিমান শব্দশ্রমিক উপাধি দিতে পারি। যেমন, একজন কৃষক কিংবা শ্রমিক অনেক কষ্টে রোদ-বৃষ্টি ঝড় উপেক্ষা করে লাঙ্গল কাঁধে নিয়ে হাতুড়ি পিটিয়ে নিরলস গায়ের রক্ত-ঘাম মাটিতে ফেলে জমিতে সোনার ফসল ফলায় কারখানায় উৎপাদনে সহায়তা করে; তেমনি কবি শামসুর রাহমানও একজন দক্ষ কৃষকের মতো সাহিত্যের জমিতে শব্দচাষ করে এবং কাব্যের কারখানায় শব্দকে আগুনে পুড়িয়ে হাতকে লোহা করে একেবারে শব্দশ্রমিক রূপে গড়ে তুলেছেন। বাংলা কাব্যে তিনি এক অনন্য ও অসাধারণ শব্দচাষী এবং শব্দশ্রমিক হয়ে আছে। আধুনিক নগরজীবনের কারিগর কবি শামসুর রাহমান যেমন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান বহুমাত্রিক কবি ও লেখক। তেমনি তিনি আবার শিল্পের বিপ্লবী এবং ভীষণ প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন। বিশেষ করে তার লেখা কবিতায় অন্যায় অত্যাচার দুঃশাসন মৌলবাদিতা সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাশাসনের বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদের ভাষা হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। তিনি ‘হাতির শুঁড়’ নামে একটি প্রতিবাদী কবিতা স্বৈরাশাসক আইয়ুব খানকে বিকট বিদ্রƒপ করে লিখেছিলেন। এই কবিতাটি ১৯৫৮ সালে কবি সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আর এমনি করেই কবি শামসুর রাহমান ভীষণ প্রতিবাদী মন নিয়ে কলমের কালিকে শাণিত করে নির্ভীকচিত্তে সকল ভয়কে উপেক্ষা করে একেএকে ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’ ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’ ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’ ‘প্রতিক্রিয়াশীল ও মৌলবাদিতার বিরুদ্ধে কবিতা’ লিখেছেন। শুধু তাই নয়, ১৯৯১ সালে স্বৈরাশাসনের পতনের পর তিনি ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা’ও লেখেন। আসলে কবি হিসেবে তিনি প্রতিবাদী এবং অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যোবোধে সাম্য শান্তিতে বিশ্বাসী একজন নিরেট পরিচ্ছন্ন মানুষ ছিলেন। একজন কবির সব কবিতায় সফলতার মুখ দেখে না, সকল কবিতা মানুষের মুখে মুখে প্রচারও হয় না। কিছু কিছু কবিতা আছে যা মানুষকে সমাজকে কালকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে রাখে, হৃদয় গভীরে তোলপাড় সৃষ্টি করে; মনন চেতনাকে জাগ্রত করে আন্দোলিত করে। তখন সেই কবিতা বা সেসব কবিতা চির অমরতার রূপলাভ করে থাকে। আর তাই যুগ যুগ ধরে কাল থেকে কালান্তরে যুগ থেকে যুগান্তরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অমর কবিতাগুলো পাঠককে মানুষকে প্রেরণা দেয়। কবি শামসুর রাহমানের ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’ বিখ্যাত কবিতাখানি ঠিক তেমনই একটি জ্যোতির্ময় নান্দনিক অমর কবিতা। অমর কবিতা এই জন্যই বললাম যে, এই কবিতাটি কবিকে বর্তমান কালের সীমানা ছাড়িয়ে আগামী দিনে শতাব্দীতে সহ¯্রাব্দে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো বাংলা সাহিত্যাকাশে জ্বলজ্বল করছে ও করবে এবং কবিকে বাঁচিয়ে রাখবে। কারণ, এই কবিতায় কবি স্বাধীনতা পাওয়ার জয়গান গেয়েছেন, স্বাধীনতা পেতে কতটা কষ্ট যাতনা ত্যাগ বিসর্জন দিতে হয়েছে এদেশের সাধারণ মানুষদের, কত মা তার সন্তানকে, কত বোন তার ভাইকে আর কত স্ত্রী তার প্রিয়তম স্বামীকে হারিয়েছে; তারই জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি একেছেন এবং সাবলীল শব্দে ভাবে ভাষায় কবিতার মূল বক্তব্যকে তুলে ধরেছেন। কবি তাই বলেছেন- ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা / তোমাকে পাওয়ার জন্যে আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়? / আর কতবার দেখতে হবে খা-বদাহন? তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা, / সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো, সিঁথির সিঁদুর গেলো হরিদাসীর। ................................................. স্বাধীনতা, তোমার জন্যে / মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে নড়বড়ে খুঁটি ধরে দগ্ধ ঘরের। .................................................. নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা’ শামসুর রাহমানের অসংখ্য চমৎকার সুন্দর সুন্দর মধুময় নান্দনিকময় আর চেতনাময় কবিতার মধ্যে ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি তার অনেক ভাল কবিতার মতো অনেক বেশি চেতনাধর্মী এবং আবেগময়। কবি এই কবিতায় একজন দেশপ্রেমিক স্বাধীনতাপ্রিয় প্রতিবাদী তরুণ বিপ্লবীর রক্তাক্ত শার্টের বর্ণনা দিয়েছেন। এখানে আসাদের দেশপ্রেমের আত্মত্যাগের চেতনা ও মহিমা অন্ধকার রাতে পূর্ণিমার আলোর মতোন ফুটে উঠেছে। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে আসাদের মৃত্যু হয়। লেখক আসাদের শার্টকে মানবিকতার রূপে করে তুলেছেন অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রাণের পতাকা। আসাদের শার্টই যেন আজ আমাদের এক টুকরো লাল-সবুজের পতাকা হয়ে উঠেছে। কবি তাই বলেছেন- ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট / উড়ছে হাওয়ায়, নীলিমায় ........................................................................ বর্ষিয়সী জননী সে-শার্ট উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন ¯েœহের বিন্যাসে ....................................................................... আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখ- বস্ত্র মানবিক; আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা’ কবি শামসুর রাহমান নিজে যেন কবিসত্তার স্বপ্নকে চাওয়াকে কল্পনাকে তার চলার পথকে বিনির্মাণ করেছেন ‘আলাদা এক রাজ্য’ নামের কবিতার পঙ্ক্তিতে। এই সমাজে শহরে একজন কবি একা, একাই তার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়, কবির কল্পনা হাজার বাতির চাইতে জ্বলজ্বল। তবু কবি উশকো খুশকো লম্বা চুল নিয়ে কবিকে চলতে হয়, কবির ঠিকানা নেই আবার ঠিকানা আছে, কবিকে তাই পথ হারালে চলবে না, কবির হাত ধরে কেউ নিয়ে যাবে না; কবিকেই শান্তিময়ীর পরম ছোঁয়ায় সকল ক্লান্তি থেকে মুক্তির পথ বের করতে হবে এবং কবিকে কলমের কালিতে গড়ে তুলতে হবে এক রাজ্য। এই রাজ্যে কবিই রাজাধিরাজ। এখানে একজন কবির আকাশছোঁয়া কল্পনাশক্তিই মূলত প্রকাশ পেয়েছে। কবি শব্দে শব্দে বলছেন- ‘এই যে কবি ভর দুপুরে / হন্তদন্ত হয়ে এখন যাচ্ছো কোথায় কোন ঠিকানা লক্ষ্য করে? ............................................................... পথ হারালে যাবে কোথায় এ শহরে / আলোবিহীন কোন অজনা আস্তানাতে ? কেউ কি তোমার হাতটি ধরে নিয়ে যাবে / শান্তিময়ী তারও কাছে, ............................................................... এখন তুমি এই শহরে রাজা বটে। হাতে একটি কলম পেলে আলাদা এক রাজ্য জানি উঠবে গড়ে’ ভাষার জন্যে আত্মাহুতি পৃথিবীর ইতিহাসে একেবারে বিরল যে, বাঙালী জাতি নিজেদের জীবন দিয়েছিল। ভাষার জন্য ভালবাসা শ্রদ্ধা এবং আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে একটা জাতি তার কথা বলার স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। রক্তের বিনিময়ে কেনা মায়ের ভাষা বিশ্বসভায় আজ স্থান করে নিয়েছে। আর আমাদের এই প্রিয় বাংলা ভাষার লাল টকটকে থোকা থোকা বর্ণমালাকে অনেক হীন রাজনীতির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করতে হয়েছে। এমনকি ভাষার বিরুদ্ধে বর্ণমালার বিরুদ্ধে এবং বানান সংস্কারের অহেতুক অজুহাতে বাংলা ভাষার উপরে বর্ণমালার ওপরে চরম আঘাত করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো তৎকালীন বর্বর পাক-শাসকেরা। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আসীন করার লক্ষ্যে, এই ভাষাতে কথা বলার অধিকারে ’৫২-এর ভাষা-আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের ওপর নির্মম আঘাত রাজপথে রক্ত ঝরানো সবকিছু দেখে জেনে আর বুকভরা কষ্ট নিয়ে কবি শামসুর রাহমান লিখলেন তার অন্যতম কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতাখানি। এই কবিতায় কবি ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, ভাষার জন্য আন্দোলনকারীদের ওপর আঘাত, বাংলা বর্ণমালার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের চিত্রকে তুলে ধরেছেন। যে ভাষার বিরুদ্ধে এত ষড়যন্ত্র, এত ত্যাগ এবং আত্মাহুতি সে ভাষা যেন বড়ই দুঃখিনী। বাংলা দুঃখিনী মায়ের মতো বর্ণমালাও বড় দুঃখিনী। কবি তাই বলছেন... ‘নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায় মমতা নামের প্লুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড় ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে শিউলিশৈশবে ‘পাখী সব করে রব’ ব’লে মদনমোহন তর্কালস্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি, অবিচ্ছিন্ন, পরস্পর মমতায় লীন, ঘুরেছি কাননে তা নেচে নেচে, যেখানে কুসুম-কলি সবই ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সঙ্কেতে। .............................................................. তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার? উনিশ শো’ বাহান্নার দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি / বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী। ............................................................... এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি, / এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষ মাস! তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো, / বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা। পৃথিবীর মানচিত্রে যত দেশ আছে এবং জাতি বসবাস করে সকল দেশই স্বাধীনতার জন্য লড়াই সংগ্রাম করেছে দেশ স্বাধীন করেছে এবং স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি অর্জন করেছে। স্বাধীনতা পরম পাওয়া, এই স্বাধীনতা এমনি এমনি আসে না, বুকের রক্ত ঢেলে জীবন দিয়ে লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বপ্নের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। কবি শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার মধ্যে স্বাধীনতা মানে যে মুক্ত পরাধীনতার শিকল থেকে বেরিয়ে আসা এই বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কেনা আমাদের প্রিয় সাধের স্বাধীনতা দেখতে কেমন, কেমন তার রূপ-রস-গন্ধ-ছন্দ এবং প্রেরণাদায়ক ও আবেগময় তার প্রতিচিত্র এই কবিতার মধ্যে কবি এঁকেছেন। এই কবিতায় কবি মহান স্বাধীনতাকে রবিঠাকুরের অজর কবিতা কবি নজরুলের জাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ পাখিদের গান আর পিতার জায়নামাজ মায়ের শাড়ির কাঁপন বোনের মেহেদির রং বলে সম্বোধন করেছেন। স্বাধীনতাকে তিনি ইচ্ছেমতো কবিতা লেখার কবিতার খাতাও বলেছেন। মূলত, ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতা পাঠ করলে কবিতাটির পরতে পরতে সৌন্দর্য মুগ্ধকর ও নান্দনিকতার রূপ দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া স্বাধীনতা যে কতটা একান্তে আপন তাও এখানে তুলে ধরা হয়েছে। কবি কবিতায় বলেছেন- ‘স্বাধীনতা তুমি / রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান স্বাধীনতা তুমি / কাজী নজরুলের ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা- ................................................................. স্বাধীনতা তুমি / পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন স্বাধীনতা তুমি / উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন স্বাধীনতা তুমি / বোনের হাতের ন¤্র পাতায় মেহেদীর রং ................................................................. স্বাধীনতা তুমি / বাগানের ঘর, কোকিলের গান বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা / যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা’ শামসুর রাহমানের কবিতায় বিশেষ করে গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের পাশাপাশি নগর জীবনের নাগরিক সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না আন্দোলন-সংগ্রাম জয়-পরাজয়ের বাস্তব চিত্রটি ফুটে উঠেছে। এ ছাড়া তার কবিতা ও গানে স্বাধীনতা দেশপ্রেম, মানবতা এবং মানবিক মূল্যবোধের চেতনা দারুণভাবে উঠে এসেছে। এর হেতু হিসেবে বলা যেতে পারে যে, শামসুর রাহমান তার ব্যক্তি জীবনে মানবতা রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি একজন সত্যিকারের সমাজ সচেতন মানবিক কবি। তার আত্মজীবনী ‘কালের ধুলোয় লেখা’ বইটি পাঠ করলে সেখানে দেখতে পাই যে, শুধু জীবনের ঘটনায় মুখ্য হয়ে ওঠেনি; এখানে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি দেশ যুদ্ধ রাজনীতি অর্থনীতি ইতিহাস এবং যাপিতজীবন চলার পথে সব দেখাকে জানাকে সত্যের আলোতে উপস্থাপন করেছেন। আর এসব তার কাব্যে বার বার প্রতিফলিত হয়েছে। ফলে তার কবিতা কালকে অতিক্রম করে বর্তমানকে পেরিয়ে আগামী সুন্দর সবুজ ভবিষ্যতের গতিময়তাকে নিবিড় করে ছুঁয়েছে। তার কবিতাপাঠে নতুন করে বাঁচতে শেখায়, বিশ্বাসের জায়গাকে বদ্ধমুল করে তোলে আর বিবেক চেতনাকে শাণিত করে। তার কবিতার বইগুলো পাঠে পাঠককে একেবারে নতুন এক ভুবনে ভাবনার জগতে অন্য রূপ-রসের স্রোতে টেনে নিয়ে যায় বহমান নদীর মতো। কবি তার কাব্যগ্রন্থে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে শিল্পের বিচারে অনেক বেশি মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
×