ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লোভাছড়া ...

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ২৫ জানুয়ারি ২০১৯

লোভাছড়া ...

আজকাল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমরা খুব সহজেই বিভিন্ন দর্শনী ও স্থান সম্পর্কে ধারণা পেয়ে থাকি। আমি ভ্রমণপ্রিয় মানুষ তাই সবসময় খোঁজখবর রাখি নতুন কোথায় যাওয়া যায়। যেহেতু কর্মজীবী মানুষ সেহেতু আগের থেকেই পরিকল্পনা করেই বের হতে হয় অজানার উদ্দেশ্যে। অনেক দিন থেকেই ইচ্ছে ছিল সিলেটের সীমান্তবর্তী অঞ্চল মেঘালয়ের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড়ের পূর্ব অংশে কানাইঘাট উপজেলার স্বচ্ছ পানির নদী লোভাছড়াতে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেরানোর কিন্তু সময়ের অভাবে হয়ে উঠছিল না। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম আসছে শুক্রবারেই বেরিয়ে পড়ব। বারে বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ দিন তাই কাজের চাপও বেশি এর পরেও দ্রুত চেষ্টা করছিলাম কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার কারণ কাল সকাল বেলায় বেরিয়ে পড়তে হবে নতুন গন্তব্যের পানে। কিন্তু অফিসের কাজ তো আর আমার পেছন ছাড়ে না শেষ পর্যন্ত সেই গতানুগতিক ধারায় রাত ৮টার দিকে বের হলাম অফিস থেকে। অফিস থেকে বের হয়েই উঠে পড়লাম তিন চাকার পরিবহনে। বাসায় পৌঁছে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম একটু আগেই কারণ কাল সকাল হলেই বেরিয়ে পড়তে হবে নতুন পথে। যেই ভাবা সেই কাজ শুয়ে পড়লাম একটু আগেই কিন্তু চোখে তো ঘুম নেই। কি আর করা মোবাইল ফোনে দৃষ্টি ফেললাম। ঘুরে বেড়াতে থাকলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। নিদ্রা দেবী কখন যে আবিষ্ট হলেন টেরই পেলাম না। সেই সাতসকালে মায়ের ডাকাডাকি ঘুম ভাঙল। শীতের সকাল বেশ ভালই লাগছিল তাই ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা করছিল না। তাই আরেকটু সময় নিদ্রা দেবীর আবেশে গেলাম। কিছু সময় পর আবার কানের সামনে মা শুরু করলেন ডাকাডাকি না পারতে ঘুম থেকে উঠতেই হলো আমাকে তখন ঘড়ির কাঁটাতে সকাল ৭টা হবে। সবাই তৈরি হয়ে গেছে শুধু আমি ছাড়া তাই ঘুম থেকে উঠেই অনেক কষ্ট করে তৈরি হয়ে নিলাম আমি। সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার একেবারে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় খাসিয়া-জৈইন্তা পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে বালুভরা বেশ কিছু স্বচ্ছ পানির নদী। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লোভাছড়া নদী। নদীর প্রতি আমাদের সবারই রয়েছে অসম্ভব টান। আর নদীর নাম লোভাছড়া নাম শুনে তো প্রেমে পরার অবস্থা। কিন্তু সময় সুযোগ দুটোর সম্মিলন না হওয়ায় যাই যাই করেও যাওয়া হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত এবার লোভায় বেড়ানোর ইচ্ছে আর দমিয়ে না রেখে রওনা হলাম। আমাদের যাত্রা সঙ্গী আমার চার চাকার পাইলট ফরহাদ। গাড়িতে উঠতেই ফরহাদ জানতে চাইল কোন পথ ধরে যাব আমরা লোভা ছড়াতে। লোভা ছড়াতে যেতে হলে প্রথমে আমাদের যেতে হবে কানাইঘাটে। সিলেট নগরী থেকে কানাইঘাট যাওয়ার কয়েকটি পথ আছে। সিলেট জাফলং মহাসড়কের ওপর দরবস্ত বাজার থেকে হাতের ডান দিকে রাস্তা চলে গেছে কানাইঘাট পর্যন্ত। মাইক্রোতে ঘন্টা দেড়েক এর মতো সময় লাগে। কানাইঘাট উপজেলা সদর সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত এবং এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্য সুন্দর। নদীর ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে যাত্রা শুরু করতে হয় লাভাছড়ার দিকে। কিন্তু আমাদের রুট ছিল সিলেট নগরী থেকে দরবস্ত বাজার হয়ে ছোট ও বড়চতুল অতিক্রম করে হাতের বাম দিক দিয়ে বরবন্দ ও সুরই ঘাটের পর লোভা বাগানের নিজস্ব রাস্তা দিয়ে। বলে রাখা ভাল লোভা বাগানের রাস্তা দিয়ে যেতে গেলে অবশ্যই বাগান কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। আমরা চলছি যাত্রা পথের দূরত্ব ঘুচিয়ে। রাস্তার দুপাশের দৃশ্য ছিল মন ভোলানো ঘন সবুজ ধান গাছের সারি , কিছু দূরে উঁচু নিচু টিলা, কোথা ও কোথা ও বাঁশ বাগান, কাশ ফুলের সারি, দূরে নীলাভ পাহাড় উঁকি দিচ্ছে যেন। আমাদের যাত্রা সঙ্গী মা, সানান্দা, সুকান্ত, সপ্তক, কেয়া যে যার মতো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত। তবে বেরসিক রাস্তার জন্য মাঝে মাঝে বেগ পেতে হচ্ছিল আমাদের। এদিকে আমাদের সবচেয়ে ছোট ভ্রমণ সঙ্গী সপ্তক বলে উঠল ওর ক্ষিদা পেয়েছে তাই এখনই গাড়ি থামাতে হবে। আশপাশে কোন ভাল খাবারের দোকানের দেখাই পেলাম না। শেষমেশ রাস্তার পাশে দোকানেই সবার শেষ ভরসা। গাড়ি থেকে নেমেই সবাই কি আছে খাবার দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। সিঙ্গাড়া, পেয়াজি, বেগুনি, ছোলা এই সবই আছে। কিন্তু বিপদের কথা সব কিছুই ঠাণ্ডা। তাই কেউ আর খেতে রাজি হচ্ছিল না। এখন কি করা আমি দোকানদারকে বললাম রুটি কি বানিয়ে দেয়া যাবে। উত্তর হ্যাঁ হওয়ায় আমি বললাম সঙ্গে ডিম পোঁচ করে দিতে। সবার পেটেই চলছে রাম রাবণের যুদ্ধ তাই কখন খাবার তৈরি হয়ে সামনে হাজির হবে তার অপেক্ষায়ই সবাই করছিলেন। শেষমেশ আমাদের সামনে রুটি আর ডিম পোঁচ হাজির হলো। সবাই কোন কথা না বলে আহার শুরু করে দিলেন। বেশ ভালই লাগছিল গরম গরম অমৃত মনে হচ্ছিল। পেট পূজার পর্ব শেষ করে আমরা চললাম গন্তব্য পথে। দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌঁছালাম লোভা বাগানের গেটে সেখান থেকে রাস্তার দুই দিকে চা গাছের মনোরম দৃশ্য ও সর্পিল পাহাড়ি রাস্তা অতিক্রম করে আমরা পৌঁছাই বাংলাদেশের দ্বিতীয় ঝুলন্ত সেতুর সামনে। ১৯২৫ সালে ইংরেজরা লোভাছড়ায় যাতায়াতের জন্য সেতুটি নির্মাণ করে। আকর্ষণীয় এই সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে লোভা ছড়ার নান্দনিক শোভা উপভোগ করা সত্যিই অসাধারণ। আমার সব ভ্রমণ সঙ্গীরা যে যার মতো ছবি তুলতে লাগলেন। এর পর আমরা গেলাম চা বাগান এ ঘুরে দেখার জন্য। অসাধারণ সে দৃশ্য চা পাতাগুলো যেন সূর্যের সঙ্গে খেলা করছে। পদব্রজে আমরা গিয়ে হাজির হলাম সাহেবের বাংলোয়। এবার আমাদের ভ্রমণ সঙ্গীরা লোভা নদীতে ঘুরে বেড়াতে চাই কি আর করা আবার এগিয়ে গেলাম নদীর পানে। চলেছি পরিচ্ছন্ন সুরমা নদী দিয়ে। লোভার মুখ হচ্ছে সুরমা ও লোভাছড়া নদীর সঙ্গমস্থল। সুরমা নদী দিয়ে আমাদের ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছুটে চলে লোভাছড়া নদী অভিমুখে। নদীর বুক ভিড় করা নৌকা নেই। একটা দুটো ইঞ্জিনচালিত নৌকা হঠাৎ হঠাৎ ঢেউ খেলিয়ে চলে যাচ্ছে। দূরে পাহাড়ের বুকে সুর্যের আলো। এসব মিলিয়ে যেন আমাদের এক অচীন দেশ ভ্রমণ। সুরমা পেরিয়ে আমাদের যাত্রা লোভাছড়ায় শুরু হতেই শুরু হলো এক চঞ্চলতা। সামনে মনোরম সৌন্দর্য দেখলে চঞ্চলতা তো আসবেই। সঙ্গে বেশ জোড় হাওয়া চারদিক ছড়িয়ে আমাদের নৌকায় আছড়ে পড়ল, আছড়ে পড়ল আমাদের চোখে মুখে। এ এক অন্য রকম মুগ্ধতা। দেখতে দেখতে সূর্যদেবের পাটে যাবার সময় ঘনিয়ে এলো আমরা ফিরে চললাম শহর পানে। যাবেন কিভাবে- সিলেট শহর থেকে কানাইঘাটে আসতে হলে সিলেট-তামাবিল রোড অথবা, জকিগজ্ঞ রোডে কানাইঘাট উপজেলা সদরে আসা যায়। কানাইঘাট বাজার ঘেঁষে প্রবাহিত সুরমা নদীর দু’পারেই দুটি বাস স্টেশন আছে। উপজেলা সদর থেকে সুরমা নদী দিয়ে নৌকায় ঝুলন্ত ব্রিজে আসতে পারবেন। এতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগবে। ইঞ্জিনচালিত নৌকা দিয়ে কানাইঘাট বাজার থেকে (রিজার্ভ করে) ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা খরচ পড়ে। তবে রিজার্ভ ছাড়াও নৌকা পাওয়া যাবে।
×