ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে কমেনি

প্রকাশিত: ০৭:২২, ২৫ জানুয়ারি ২০১৯

প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে কমেনি

উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও কিছু সামাজিক পশ্চাদগামিতাকে এখনও জয় করতে সক্ষম হয়নি। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে এখনও সিংহভাগ জনগোষ্ঠী গ্রামে বাস করে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে উচ্চ আর নিম্নবিত্তের ফারাক যেমন দৃষ্টিকটু পাশাপাশি লিঙ্গ বৈষম্য ও নারী-পুরুষ ভেদাভেদে দর্শনীয় ভূমিকা রাখে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে অনেক কর্মপরিকল্পনাকে সম্প্রসারিত করলেও কিছু সমস্যা এখনও বিদ্যমান। নারীদের ক্ষেত্রে তেমন সঙ্কট তো একেবারে মৃত্যুসম। গর্ভকালীন মায়েদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষায় আমরা এখনও আধুনিক সময়কে জয় করতে পারিনি। শারীরিক সুস্থতায় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও ব্যক্তিক সচেতনতা, পারিবারিক নজরদারি সর্বোপরি সামাজিক দায়বদ্ধতাকে সাধারণ মানুষের দ্বারে পৌঁছে দিতে না পারলে সমাজের অর্ধাংশ নারী জাতির মাতৃত্বকালীন সমস্যা লাঘব হতে আরও সময় লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সরকার এখানেও অনেক নতুন কার্যক্রম গর্ভকালীন মায়েদের ব্যবস্থা করলেও কিছু অভিশাপ নারীদের এমন অসহায় অবস্থাকে কোনভাবে পাশ কাটানো সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশের বাল্যবিয়ে আর অকাল মাতৃত্বের মতো সামাজিক অব্যবস্থা তেমন কোন ভাল জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। এটা শুধু বাংলাদেশের নয় সারা বিশ্বেও বাল্যবিয়ের মতো অনাকাক্সিক্ষত সমস্যা আজ অবধি বর্তমান। বিভিন্ন বিশ্ব জরিপে তা প্রকাশিতও হয়। আর বাল্যবিয়ে মানেই অকাল মাতৃত্ব। শরীর ও মনের স্বাভাবিক পরিপক্বতা ব্যতিরেকে কোন বালিকা যদি তার আজন্ম লালিত স্বপ্নের ‘মা’ হওয়ার কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয় তা হলে চিরায়ত ‘মাতৃত্ব’ শব্দটিই তার মর্যাদা হারায়। একজন অবোধ বালিকার যখন তার মায়ের স্নেহ আর ছায়ায় বড় হওয়ার কথা, সে সময় যদি তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হয় তা হলে ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা ভাবতেও কষ্ট লাগে। যে মেয়ে নিজেকে সামলাতে পারে না সে কি করে তার রক্তবিন্দু দিয়ে তৈরি করা জঠরে অন্য এক শিশুর ভার নেবে? তার ওপর আছে সামাজিক রক্ষণশীলতার জাঁতাকলে পিষ্ট পারিবারিক অসহযোগিতা। বর্তমান সরকার গর্ভকালীন ভাতারও বন্দোবস্ত করেছে মা ও তার জঠরের শিশু যাতে সুরক্ষিত থাকে। অনেক সময় দেখা যায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েরা সে ভাতার ধারে কাছেও যেতে পারে না। ফলে শিশু জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু হয় এক অনাকাক্সিক্ষত আবশ্যিক পরিণতি। শুধু তাই নয় মা হওয়ার জন্য শারীরিকভাবে সে সক্ষম কিনা সে বিষয়ও কখনও খতিয়ে দেখা হয় না। পর পর দুই মেয়ের জন্ম পরিবারে দুর্যোগ নেমে আসে। ছেলের আকাক্সক্ষায় উন্মত্ত পিতার প্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়ে অসহায় মাকে আবারও সন্তান ধারণ করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। এ তো গেল কট্টর সামাজিক অবয়বের করুণ আখ্যান। চিকিৎসার ব্যাপার জানতে যোগাযোগ করি বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বরিশাল মেডিক্যালের সাবেক গাইনি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডাঃ সেলিনা পারভীনের সঙ্গে। তিনি যা বললেন তাতে মনে হলো এক অবরুদ্ধ সামাজিক গ-ির মধ্যে আটকে পড়া মেয়েরা কবে যে স্বাধীনভাবে নিজেদের ব্যাপারে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে সে অপেক্ষা করা ছাড়া কোন পথ নেই। বাল্যবিয়ে ও অকাল মাতৃত্ব ছাড়াও প্রসবকালীন মৃত্যুর সংখ্যা এখনও অনেক বেশি। তার মতে সময় মতো এসব অসহায় মা আমাদের কাছে পৌঁছতে পারে না। দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা রোগীরা এমন অবস্থায় চলে যায় তাদের কিছু করারও থাকে না। তিনি বললেনÑ অনেক স্বামী বিদেশে চাকরি নিয়ে চলে যায়Ñ দেশে তার গর্ভবতী স্ত্রী। পরিবারের ওপর নির্ভরশীল এসব প্রবাসী পুরুষ নিশ্চিন্ত থাকে তার স্ত্রীর ব্যাপারে। গ্রাম-গঞ্জে বিভিন্ন প্রশিক্ষক চিকিৎসকদের পরামর্শ ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যখন রোগী তার কাছে আসে সে সময়টা খুব পর্যাপ্ত নয় চিকিৎসার জন্য। তার ওপর আছে যাতায়াত ব্যবস্থার হরেক রকম ঝক্কি-ঝামেলা। গণপরিবহনের ঝুঁকি সামলিয়ে গর্ভবতী কোন নারী ভাল চিকিৎসকের কাছে আসতে অনেক দেরি করে ফেলে। অনেক সময় দেখা গেছে গর্ভবতী মা হৃদরোগে আক্রান্ত কিংবা উচ্চ রক্তচাপে তার বাচ্চা ধারণ করা জীবনের ঝুঁকি হয়ে দাঁড়ায়। এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেনÑ একটা মেয়েকে নিজেই বুঝতে হবে সে মা হওয়ার ক্ষমতা রাখে কিনা। শুধু তাই নয় মাতৃত্বকালীন সময়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তার সচেতনতা এবং আগ্রহও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম থেকেই দেখাতে হবে কাছের কোন গাইনি বিশেষজ্ঞকে। উন্নত চিকিৎসায় প্রয়োজনে বিভাগীয় শহরগুলোতে আসতে হবে সময় হাতে নিয়ে। পারিবারিকভাবে একটা সুস্থ আবহও তৈরি করা জরুরী যাতে মা ও সন্তান যথেষ্ট পরিচর্যার মধ্যে গর্ভকালীন সময় পার করতে পারে। এক্ষেত্রে স্বামীর দায়বদ্ধতাও কোন অংশে কম নয়। গ্রামীণ পরিবেশে মেয়েরা ভাল ডাক্তার দেখানোর সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়। ধারে কাছের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দায়সারাভাবে চিকিৎসা সেবা নিয়ে সন্তান জন্ম দিলেও শেষ অবধি নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। গ্রাম-গঞ্জে আরও উন্নতমানের চিকিৎসা সেবা সম্প্রসারিত করতে না পারলে প্রসবকালীন মৃত্যু ঠেকানো কঠিন হয়ে যাবে। ২০১৬ সালের এক পরিসংখ্যানে বের হয়ে আসে বাংলাদেশে এক লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ১৯৬ জন মায়ের মৃত্যু হয়। জরিপে জানানো হয় মাতৃস্বাস্থ্য সেবার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও মাতৃমৃত্যু হারের কোন পরিবর্তন হয়নি। পশ্চাৎপদ সামাজিক রক্ষণশীলতা, পুরুষতান্ত্রিক মনোবৃত্তি, সংশ্লিষ্টদের অসচেতনতা, উন্নতমানের স্বাস্থ্য সেবার অপর্যাপ্ততা, পারিবারিক দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে চলা এমন সব চলে আসা মানসিকতাকে জয় করতে না পারলে মাও শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষা দুর্বল হয়ে যাবে এবং ভগ্নস্বাস্থ্য জন্মদাত্রী মায়েরও বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না। শরীরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের মতো প্রজনন অঙ্গটিও নারীদের সুস্বাস্থ্যের অন্যতম নিয়ামক। প্রজনন অঙ্গে বিন্দুমাত্র সমস্যা দেখা দিলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কোন নারীকে আগে সুস্থ করে তোলা সবচেয়ে জরুরী। গর্ভের সন্তান ধারণ তো পরের ব্যাপার। আমরা উচ্চরক্ত চাপ, হৃৎযন্ত্রের সমস্যা, ডায়াবেটিক কিংবা কিডনি নিয়ে যতটা উদগ্রীব এবং সচেতন মেয়েদের সন্তান ধারণের গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গটির ব্যাপারে ঠিক ততখানি নই। প্রসবকালীন চিকিৎসা সেবাকেও তেমন মর্যাদা দিতে না পারলে সদ্য পৃথিবীর আলো দেখা সন্তানটি মাতৃহারা হতে সময় নেবে না। সংশ্লিষ্ট সবাইকে এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে দায়বদ্ধতার প্রমাণ দিতে হবে।
×