ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তারুণ্যের জয়গান ॥ বইমেলা

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ২৫ জানুয়ারি ২০১৯

তারুণ্যের জয়গান ॥ বইমেলা

শীতের কুয়াশার বিদায়ের হাতছানি, বাতাসে পাতা ঝরার শব্দ। সেই শব্দ যেন ডাক দিয়ে যায় অমর একুশে গ্রন্থমেলার। অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাঙালীর প্রাণের মেলা। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই এই মেলাকে ঘিরে তৈরি হয় নানা পরিকল্পনা। বইমেলাকে কেন্দ্র করে পুরো জাতির মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি হয়। জাতি দাঁড়ায় ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে। বাঙালী জাতির সংস্কৃতিগত ইতিহাস নিয়ে যারা ধূম্রজাল সৃষ্টি করে তাদের কাছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রতিবাদস্বরূপ, যা আমাদের চেতনাকে শাণিত করে। ফারাক করে দেয় বাঙালী এবং অবাঙালীকে। জাতিকে জ্ঞানের ব্যঞ্জনা দান করে। একুশে বইমেলার এই নিজস্বতা আমাদের একান্তই। একান্তই যেমন ভাষার জন্য জীবনদান। স্মৃতিগুলো অবিস্মরণীয় রাখতে এবং ভাষা শহীদদের স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে, তারুণ্যের স্পর্শে তাই অমর একুশে বইমেলা আমাদের কাছে মহীয়ান। পাকা ধানের ম ম গন্ধ যেমন বাবুই পাখিকে কাছে ডেকে আনে। কৃষক যেমন ফসলের জন্য মমত্ব প্রকাশ করে। ঠিক তেমনি বাবুই পাখি আর কৃষকের মতো বইপ্রেমীরাও ছুটে আসে বইমেলায়। নতুন বইয়ের খোঁজে তারা ঘর থেকে বের হয়। এক স্টল থেকে অন্য স্টলে ঘুরে বেড়ান। কারুকার্যময় প্রচ্ছদ দেখে তারা মুগ্ধ হয়। নতুন নতুন বই তাদের কাছে টানে। একরোখা পাঠকদের হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও সপ্তাহের একটি সময় নির্ধারিত করা থাকে বইমেলার জন্য। পরিবার নিয়ে বইমেলায় ঘুরতে আসার মাঝেও এক প্রকার আনন্দ খুঁজে পান তারা। ছাত্রছাত্রীরা তাদের দিনের একটি অংশ আলাদা করে রাখেন এই মেলার জন্য, সুযোগ পেলে প্রতিদিনই আসা হয় এমনও আছেন অনেকে। বইমেলার পুরোটা সময় সবাই মুখিয়ে থাকেন প্রিয় লেখকের নতুন বইয়ের জন্য, আবার অনেকে নতুন লেখকদের বই খুঁজে বেড়ান নতুন স্বাদের জন্য। তবে বইমেলায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশই তরুণ। বইমেলা নিয়ে তাদের প্রত্যাশা থাকে অন্যদের থেকে একটু আলাদাই। বইমেলা মানেই তারুণ্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর বইমেলায় প্রবেশ করতে হয়। অবশ্য প্রবেশ টিকেট লাগে না। মেলায় আসা প্রায় প্রতিটি মানুষ কোন না কোন বই কিনে থাকেন। এ দিক থেকে তরুণদের আগ্রহটাই বেশি। অনেকেরই প্রিয় লেখকদের বইয়ের তালিকা আগে থেকেই করা। অপেক্ষা শুধু বইমেলা শুরুর। কেউবা আবার নতুন লেখকদের বই কেনে। এ দিক থেকে তরুণদের মধ্যে নতুন করে নতুন কিছু কেনার আগ্রহ তৈরি হয়। পাঠকের হাতে নতুন বই তুলে দিতে প্রকাশকদের রাতের ঘুম যেন হারাম হয়ে যাচ্ছে। গ্রন্থমেলার শেষ সময়ের প্রস্তুতি হিসেবে তাই এখন বাংলাবাজার, ফকিরাপুল, সূত্রাপুর, শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেট, পাটুয়াটুলী, কাঁটাবনসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার প্রেস, পেস্টিং, কম্পোজ ও বাইন্ডিং কারখানাগুলোতে বিরামহীন ব্যস্ততা। মেলার প্রথম দিন থেকে নতুন বই আনার চেষ্টা করছে প্রকাশনা সংস্থাগুলো। লেখক, প্রকাশকদের মধ্যে চলছে শেষ সময়ের টান টান উত্তেজনা। প্রচ্ছদ শিল্পীদেরও দম ফেলার ফুরসত নেই। সব মিলিয়ে সাজ সাজ রব বইমেলাকে ঘিরে। বরাবরের মতোই এবারও বইমেলায় তরুণদের উপস্থিতিই থাকবে বলে ধারণা করা যায়। বন্ধু, বান্ধবী, এমনকি জোড়ায় জোড়ায় ঘুরতে ঘুরতেই তরুণ-তরুণীরা আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে বই কেনে। ফেব্রুয়ারিজুড়ে বইমেলায় জমজমাট থাকে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। লাখো মানুষের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলা একাডেমি এবং আশপাশের অঞ্চল। বই কিনতে যেমন মানুষের ভিড় থাকে বইমেলায়, তেমনি বই দেখতে, প্রিয় লেখকদের সঙ্গে ছবি তুলতে, কথা বলতেও অনেকেই চলে আসেন বইমেলায়। সত্যি কথা বলতে কী, নতুন বইয়ের গন্ধে বিভোর হয়ে ঘুরে বেড়ানোও কিন্তু সীমাহীন আনন্দ। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা আসেন বইমেলায়। যদিও তারুণ্যের দল-ই বেশি। বইমেলাকে কেন্দ্র করে অনেক লেখকের বই প্রকাশিত হয় পাঠকদের জন্য। সেখানে বর্ষীয়ান এবং জনপ্রিয় লেখকদের বই যেমন বের হয়, তেমনি নতুন লেখকদের বইও প্রচুর পরিমাণে প্রকাশিত হয়ে থাকে। কয়েক বছর ধরে টিভি চ্যানেলগুলো বইমেলাকে নিয়ে লাইভ অনুষ্ঠান করছে, যা সাহিত্যানুরাগীদের জন্য একটা বড় পাওয়া অবশ্যই। থাকে বইমেলার প্রতিদিনের খবর নিয়ে বুলেটিন। লিটলম্যাগ চত্বরে বসে কবিদের হাট। যেখানে মূলত প্রতিষ্ঠিত কবি-লেখকদের চেয়ে তরুণ কবিদেরই বেশি দেখা যায়। জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোও প্রতিদিন বিশেষ আয়োজন করে থাকে বইমেলা নিয়ে। বই প্রকাশনাকে একটি শিল্প হিসেবে ধরলে এ শিল্পে প্রচুর সৃজনশীল মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়ে থাকে। সৃজনশীল বললাম এ কারণে- বইয়ের মতো সৃজনশীল কাজে সৃজনশীল মানুষই কাজ করেন। প্রতিটি স্টলে খ-কালীন চাকরির সুযোগ পেয়ে থাকেন বহু তরুণ-তরুণী। শুরুর কথা অমর একুশে গ্রন্থমেলা ব্যাপকভাবে পরিচিত একুশে বইমেলা নামে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন যারা, মূলত তাদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভাষার জন্য যুদ্ধ করে মুখের ভাষা রক্ষা করার যে অনন্য উদাহরণ, এটা জীবিত রাখার মানসেই একুশে বইমেলা নামকরণ করা হয়েছে। তাই প্রতি বছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে যে বইমেলা হয় তাকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা নামে অভিহিত করা হয়। মেলার আয়োজন চলে ফেব্রুয়ারির ১ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত এবং বছরটা যদি অধিবর্ষ হয় তাহলে ২৯ তারিখ পর্যন্ত মেলা চলে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিজুড়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন হয়ে থাকে। বাংলা একাডেমির বটতলা চত্বরে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৩২টি বই দিয়ে চিত্তরঞ্জন সাহা বই প্রদর্শনী ও বিক্রির শুরু করছিলেন, সময়ের বিবর্তনে সেটাই আজ লাখো মানুষের প্রাণের মেলা হয়েছে আর ছড়িয়ে পড়েছে বইমেলার ব্যাপ্তি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে তৎসংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন সাহা একাই বইমেলা চালিয়েছেন। বই বিক্রি ও প্রদর্শনী মানুষের মধ্যে সাড়া ফেললে আরও কয়েকজন বই প্রকাশক এতে আগ্রহবোধ করেন এবং চিত্তরঞ্জন সাহার সঙ্গে যোগ দেন। ফলে ১৯৭৮ সালে তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী এটাকে বাংলা একাডেমির সরাসরি তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসেন। যদিও ১৯৮৪ সালেই প্রথম এটা মেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পরিপূর্ণভাবে। আর ২০১৪ সাল থেকে মেলা সম্প্রসারণ করা হয় সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত। মেলাকেন্দ্রিক প্রকাশনা ও বিজ্ঞাপনী লেখক আসলে পাঠকদের বই কেনার চাহিদা মূলত বইমেলা কেন্দ্রিক। সে কারণে প্রকাশকরাও অধিক হারে বই বের করেন বইমেলা উপলক্ষে। তাই বইমেলা এলে এই নিয়ে ব্যস্ততার চিত্র দেখা যায়। গণ্যমান্য, প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ লোকজন সেমিনারে ঝড় ছুটিয়ে দেন, ‘মেলাকেন্দ্রিক প্রকাশনা’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অবশ্য এর ঠিক বিপরীত চিত্রও দেখা যায়! বইমেলা এলে আরেকটা বিষয় নিয়ে ধুন্দুমার আলোচনা হয় বিজ্ঞাপনী লেখক! বিজ্ঞাপন দিয়ে এরা বইয়ের দুনিয়া শেষ করে দিচ্ছেনÑ এরকম অভিযোগ। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগটি অমূলক নয়। সারা বছর পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিনে এক ধরনের লেখকদের লেখা ছাপা হয়। তারা ভালো লেখক, প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক। কিন্তু বইমেলার সময় তাদের ছাপিয়ে বিক্রির তালিকায় উঠে যান আরেক দল লেখক। সস্তা-বাজার-বিজ্ঞাপন-অলেখক ইত্যাদি বলে যতই নাক সিঁটকান, একটু ভেবে দেখলে এটাও কি অবাক করার ব্যাপার নয় যে- যাদের গল্প-কবিতা সারা বছর লোকে পত্রিকায় দেখে, তাদের প্রতি মানুষ আগ্রহ বোধ করে না? নতুন লেখক এবং ফেসবুকের প্রভাব মেলায় তরুণ লেখকদের অসংখ্য বই প্রকাশ হয়। তবে নতুন লেখকদের অভিযোগ থাকে যে, তার নিজের বইয়ের বিশ বা পঁচিশ শতাংশ বই নিজেরই কিনতে হবে এমন প্রতিশ্রুতিতে প্রকাশক বই প্রকাশ করেছে। আবার অনেকেই টাকার বিনিময়ে বই প্রকাশ করছে। আবার নতুন লেখকদের মধ্যে বই প্রকাশ করে মেলা শেষে লেখক সম্মনী পেয়েছে এমন উদাহরণও রয়েছে। তবে তাদের লেখা বেশিরভাই নিয়মিত পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশ হয়। পাঠকদের মধ্যে অনেকেই ফেসবুকে যে বইয়ের লাইক বা কমেন্ট বেশি এমন বই কিনতে আগ্রহী হয়। ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমে তারা বিভিন্ন গ্রুপে বইমেলা সংক্রান্ত সব খবর, নতুন লেখক ও নতুন বইয়ের রিভিও করে থাকেন। এতে তারা বইমেলা থেকে নিজেদের সংগ্রহ করা বই ও লেখকের সম্বন্ধে নানা তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকদের যাবতীয় প্রাথমিক উৎসাহ নিবারণ করেন। ফলে পাঠকরা বইমেলা নিয়ে আরও উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ফেব্রুয়ারি মাসে তারা বইমেলাকে কেন্দ্র করে নতুন বইয়ের রিভিও ও বইপাঠ প্রতিযোগিতাও করে থাকেন বিভিন্ন ক্যাম্পাসভিত্তিক ক্লাবের মাধ্যমে। আর অনেকে আলেচনায় থাকতে ফেসবুকে বইয়ের বিজ্ঞাপন, নতুন বইয়ের গ্রুপ করে থাকেন। তবে বর্তমান সময়ে নিজর ঢোল নিজে পেটানোই যুক্তিযুক্ত নয় কি? প্রথম বই জীবনের প্রথম বই তাও আবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হওয়া, লেখক মাত্রই এ নিয়ে থাকেন বাড়তি উত্তেজনায়। নিজ সন্তান ভূমিষ্ঠের আগে মা ঠিক যেভাবে আনন্দে উদ্বেলিত থাকেন লেখকও প্রথম বই হাতে পাওয়ার স্বপ্নে থাকেন বিভোর। আসলে বইমেলায় প্রথম বই প্রকাশের আনন্দই আলাদা। বইপ্রেমীদের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে উঠে মেলা প্রাঙ্গণ। তখন বইপোকাদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে মেলার চারপাশ। কেউবা ঢুুঁ মেরে থাকেন প্রিয় লেখকের সন্ধানে। পছন্দের লেখককে দেখা মাত্র তারা ছুটে যান তাদের কাছে। সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করেন। দুই এক কপি ছবি তুলতেও ভুল করেন না। কেউবা তোলেন সেলফি। এভাবে বইপ্রেমী-দর্শনার্থী-ক্রেতা-বিক্রেতাদের কলতানে মুখর হয়ে ওঠে বইমেলার আঙ্গিনা। তখন বাতাসে কেবলই উড়ে বেড়ায় নতুন বইয়ের গন্ধ। এভাবে বইমেলার আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মূলত বইমেলা জমে উঠে প্রথম সপ্তাহ থেকে। আর সেটা পূর্ণতা পায় ২১ ফেব্রুয়ারিতে। মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় মূল কেনা-বেচা। তবে বই বাছাই করার জন্যে কমপক্ষে চার-পাঁচ দিন মেলায় যেতে হবে। যদিও বহু মানুষ ফেব্রুয়ারির ২৮ অর্থাৎ শেষ দিন যান বইমেলায়। শিশু প্রহর বইমেলায় শিশুদের জন্যও থাকবে নানা আয়োজন। শুক্র ও শনিবার মেলা শুরু হচ্ছে বেলা ১১টায়। এই দু’দিন থাকছে ‘শিশু প্রহর’ নামে শিশুদের জন্য আলাদ সময়। তবে প্রথম দিন শুক্রবার হওয়ায় এদিন শিশু প্রহর থাকছে না। প্রতিবারের মতো এবারও শিশু প্রহরে বাজবে ‘চলছে গাড়ি সিসিমপুরে, চলছে গাড়ি সিসিমপুরে... এই গান। আর গান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট বাচ্চারা মঞ্চে নাচানাচি করতে থাকে। মঞ্চের চারপাশে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকা ছানাপোনাদের উল্লাস যেন তখন আর বাধ মানে না। শিশুদের আনন্দ দিতে শিশু চত্বরের মঞ্চে সিসিমপুরের বন্ধুরা তো ছিলই। ‘টুকটুকি’ ‘হালুম’, ‘সিকু’, ‘ইকড়ি’রা যখন মঞ্চে নাচ-গানে ব্যস্ত, তখন তাদের চরিত্র অনুযায়ী গান বাজানো হয়। মূলত বাচ্চাদের বিনোদন দিতেই সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যানের সিসিমপুরের আয়োজনে শিশু চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় তাদের জন্য আনন্দ আড্ডা। ছোট্ট বন্ধুরা টেলিভিশনের পর্দার সিসিমপুর চোখের সামনে দেখছে। তাই টুকটুকি, ইকরি এবং হালুমদের দেখে ওদের আনন্দ যেন হবে একটু বেশিই। শিশুরা যেন দেখেশুনে মনের মতো বই কিনতে পারে তাই এই আয়োজন। সংস্কৃতির মেলবন্ধন বিশ্ব ভালবাসা দিবস এবং বসন্তের প্রথম দিনটি একুশে বইমেলার সময়েই আসে। তাই যেন বইমেলায় আনন্দের ঢেউ নামে অন্য ধারায়, অন্য রকমভাবে। তরুণ-তরুণীরা বসন্ত উদযাপনে বইমেলার সঙ্গে একাত্ম হয়ে মেতে উঠবে। বইমেলা হয়ে উঠবে আরও প্রাণবন্ত, সজীব ও অর্থবহ। তাই সবকিছু মিলে এটাই হবে মেলার প্রাপ্তি। বইমেলা উপলক্ষ বাংলা একাডেমি মঞ্চ ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকছে প্রতিদিন। প্রবাসী লেখক শুধুমাত্র বইমেলাকে কেন্দ্র করে ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী ঠিক যত সংখ্যক লেখকের আগমন ঘটে দেশে আর কোন উৎসব বা মেলাকে কেন্দ্র করে এমনটি ঘটে না। একদিকে বিশ্ববাঙালীর উপস্থিতি অন্যদিকে দেশের সব অঞ্চলের কবি, সাহিত্যিক, লেখক এবং পাঠকের অংশগ্রহণে আমাদের বইমেলা হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত, পরিণত হয় মিলনমোহনায়। বইমেলায় অংশ নিতে আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, কানাডা, ভারতসহ বিশ্বের বিভন্ন দেশে বসবাসকারী শত শত লেখক, পাঠক দেশে আসার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছেন। ইতোমধ্যে দেশে এসে পৌঁছেও গেছেন কেউ কেউ। ঐতিহ্যের বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে বইমেলাকে অন্যতম প্লাটফর্ম মনে করেন প্রবাসীরা। বাংলা ভাষা-ভাষীর নিজস্ব বই অমর একুশে গ্রন্থমেলায় শুধু বাংলাদেশী প্রকাশনার বই থাকে। এ বইমেলায় বিদেশী প্রকাশনার কিংবা বিদেশী ভাষার বই থাকে না। কারণ অমর একুশে বইমেলা করা হয় ভাষার মাসকে কেন্দ্র করে। তাই অন্যান্য ভাষাকে বর্জন করা হয়। তবে অন্য ভাষার বই যদি বাংলা ভাষায় অনূদিত হয় এবং সে বই বাংলাদেশী কোন প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হলে সেটা একুশে গ্রন্থমেলাতে থাকতে পারে। এদিক থেকে বিবেচনা করে একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের জন্য নিজস্ব একটি ব্যাপার। নিরাপত্তা ব্যবস্থা গত কয়েক বছরের মতো এবারও বইমেলায় থাকছে ব্যাপক নিরাপত্তা। বাংলা একাডেমি ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশ পথে মহিলা ও পুরুষদের জন্য থাকবে পৃথক ‘সিকিউরিটি চেক’-এর ব্যবস্থা। টিএসসি থেকে শুরু করে মেলার ভেতর ও বাইরে থাকবে কমপক্ষে দুই শতাধিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। এ ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে থাকবে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারও। বইমেলার ভেতরে ও বাইরে পর্যাপ্তসংখ্যক সাদা পোশাকে ও ইউনিফর্মে পুলিশ ডিউটিতে নিয়োজিত থাকবে। স্ট্যান্ডবাই থাকবে সোয়াট, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ও ডগ স্কোয়াড। তাই মেলা প্রাঙ্গণ বইপ্রেমীদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। সমাজের অন্ধকার ও কুসংস্কার দূর করতে আমাদের জ্ঞানের পথের যাত্রা সমুন্নত রাখতে হবে। ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেল বলেছেন, ভয় হলো কুসংস্কারের মূল উৎস এবং সমাজে ভীতসন্ত্রস্তর অন্যতম জনক। সমাজে বিরাজমান সেই ভীতসন্ত্রস্ত এবং কুসংস্কারকে জয় করতে হলে আমাদের জ্ঞানের পথে যাত্রা ভিন্ন বিকল্প পথ নেই। আর সেই জ্ঞানের আধার হলো বই। ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারি পার হলে ভাঙে এ মিলনমেলা। বইমেলা আমাদের অন্তরে যে বন্ধন তৈরি করে তা ভাঙে না কখনই। দেশের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে। অনুপ্রেরণা যোগায়। বাঙালী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ‘অমর একুশে বইমেলা’ আবার কবে ফিরে আসবে এই অপেক্ষায়। সৃষ্টি হয় লেখক-পাঠক মেলবন্ধন, যা আমাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরবে আরও উর্ধে। বছরের এই মাসটির জন্য সারাদেশের লেখক, পাঠক, প্রকাশক ও পুস্তক ব্যবসায়ী অতি আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করেন। একুশে বইমেলা আমাদের এখন আত্মার আত্মীয়। সবার জীবনে বই হোক আনন্দের এবং জ্ঞানের খোরাক। বই হোক আমাদের সর্বকালের সেরা বন্ধু। সত্যিকার অর্থে বইয়ের ভাষা লেখক যেমন বুঝে শুনে হৃদয় দিয়ে লেখেন, সেভাবে পাঠককের বুঝে শুনে হৃদয় দিয়ে পড়তে হবে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা পাঠকদের সেই শুভবুদ্ধির উদয় ঘটাতে পারবে,সব অন্ধকার দূর হবে বইয়ের স্পর্শে। মুছে যাক সকল অন্ধত্ব, গোঁড়ামি ও কুসংস্কারসহ নানা সামাজিক অবক্ষয়। নব নব ভাবনায় দীক্ষিত হোক পুরো জাতি। জয় হোক প্রগতির। জয় হোক বাঙালীর প্রাণের মেলার। [email protected]
×