ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এখনও নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার নানা ফন্দি

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ২৫ জানুয়ারি ২০১৯

এখনও নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার নানা ফন্দি

সদ্য সমাপ্ত এগারোতম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য একটি মহল সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত বিএনপিই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে, বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে বিভিন্ন ফরমে আলাপ-আলোচনা করছেন- নানাবিধ প্রমাণ সংগ্রহ এবং প্রস্তুত করছে- এই প্রক্রিয়া হয়তো আরও কিছু দিন চলবে। অনেকেরই প্রশ্ন বিএনপির নেতৃত্ব এভাবে উঠেপড়ে লেগেছে কেন? কিছু অর্জন হবে কি? এই বিষয় নিয়ে আলোচনাই বর্তমান নিবন্ধের উদ্দেশ্য। প্রথম প্রশ্ন : বিএনপির নেতৃত্ব এভাবে উঠে-পড়ে লেগেছেন কেন? দূর থেকে যতটুকুন অনুমান করা যায়, বিএনপিতে মোটাদাগে দুটি অংশ আছে, একটি কট্টরপন্থী, আরেকটি মডারেট। কট্টরপন্থী অংশটি পরিপূর্ণভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী শক্তি, ভারতবিরোধী এবং জামায়াতে ইসলাম ও পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে গভীর এবং ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা কখনই মেনে নিতে পারেনি, তারা চায় বাংলাদেশ পাকিস্তানের ভাবাদর্শে এবং আদলে পরিচালিত হোক; কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি ক্ষমতায় আসার ফলে বাংলাদেশের শান্তি, গণতন্ত্র, জাতীয় উন্নয়ন, এবং আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতার দিগন্ত অপ্রতিহত গতিতে প্রসারিত হতে থাকবে। এই অংশ প্রথম থেকেই নির্বাচন বিরোধী ছিল এবং এখন নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। এরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সর্বাত্মক প্রচেষ্টাও চালাচ্ছে। মডারেট অংশটিও ভারত বিরোধিতা এবং আওয়ামী লীগ বিরোধিতাকে রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করেন। তবে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে হয় না। তারাও নির্বাচনে পরাজয়ের ব্যাপারে নিজেদের গুরুতর ভুল-ত্রুটি থেকে কর্মীদের দৃষ্টি এবং চেতনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন এবং এই ব্যাপারে উভয় অংশই ঐক্যবদ্ধ। তারা হয়তো তৃতীয় শক্তির হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার কথাও ভাবেন- যদি তেমন কিছু একটা গ-গোল এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায়। কিন্তু তা হওয়ার নয়। দ্বিতীয় প্রশ্ন : নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কিছু অর্জন হবে কি? সে সম্ভাবনা আছে বলে একেবারেই মনে হয় না। কারণ, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কিছু অর্জন করতে গেলে বা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে জনগণই প্রধান এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। তৃতীয় শক্তির হস্তক্ষেপও জনগণের সমর্থন ছাড়া হয় না। অদ্যাবধি বাংলাদেশে আন্দোলনের ইতিহাস থেকে একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে যে, জনগণের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া কোন বড় বিজয় অর্জন সম্ভব নয়। কিন্তু সদ্যসমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনে জনগণই শেখ হাসিনাকে নিরঙ্কুশভাবে ভোট দিয়েছেন। শেখ হাসিনার কোন বিকল্প আছে বলে জনগণ মনে করেন না। এমন কি জনগণ অনেক বিতর্কিত ব্যক্তিকেও নৌকায় ভোট দিয়েছেন- শুধু শেখ হাসিনার জন্য, নৌকায় ভোট দিয়ে শেখ হাসিনাকে ভোট দিচ্ছেন- এই ভেবে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সহজ সরলভাবে চিন্তা করে থাকেন। এভাবে শেখ হাসিনার এই নিরঙ্কুশ বিজয়ের বিরুদ্ধে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে জনগণকে নিয়ে কোন আন্দোলন করার প্রশ্নই উঠে না। ‘বিএনপি-জামায়াতের জঙ্গী কর্মীবাহিনী, আইএসআই এজেন্ট’ জনগণ নয়। বিএনপি ইতিপূর্বে ‘বিএনপি-জামায়াতের জঙ্গী কর্মীবাহিনী, আইএসআই এজেন্ট’ দিয়ে সরকারকে অস্থিতিশীল করার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে দেখেছে- জনগণ সেসব প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপির নেতৃত্ব সেটা বোঝেন না, এমন নয়। এবার তাদের নেতাকর্মী এবং সমর্থকদের আন্দোলনে নামানো প্রসঙ্গে। মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মী এবং সমর্থকদের মধ্যে রয়েছে তীব্র অসন্তোষ তারা মনে করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনী নীতি ও কৌশল নির্ধারণ এবং নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন; বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট থাকা সত্ত্বেও, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে (বিএনপির নেতৃত্বে নহে) ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেয়া যেখানে কেবল নেতাই আছেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বিএনপি কখনই সুনির্দিষ্ট এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না-পারা, একদিকে নির্বাচন-বিরোধীদের চাপ, অন্যদিকে নির্বাচনকার্মীদের চাপ- এই দুয়ের মিশ্রণে বিভ্রান্তি, একদিকে লন্ডন থেকে তারেক জিয়ার সরাসরি নেতৃত্ব, অন্যদিকে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট- এ নিয়ে বিভ্রান্তি, মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সমর্থনপুষ্ট শক্তিশালী জনপ্রিয় প্রার্থীকে মনোনীত না করে লন্ডন থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া কর্তৃক মনোনয়ন প্রদান এবং তারেক জিয়ার মনোনয়ন বাণিজ্য সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা, তরুণ প্রজন্মের আস্থা অর্জনে ব্যর্থতা, মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মী ও সক্রিয় সমর্থকদের উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ব্যর্থতা, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য কার্যকরী নির্বাচনী কৌশল প্রণয়নে ব্যর্থতা এবং নিজেদের পক্ষে ইতিবাচক বক্তব্য ছাড়া কেবল আওয়ামী লীগ বিরোধী এবং জনগণের কাছে দুর্বোধ্য- লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের শুষ্ক স্লোগান- যা জনগণ গ্রহণ করেনি, ইত্যাদি নেতৃত্বের ব্যর্থতা। এবার আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি, আমি ভোট দিতে গিয়েছিলাম গ্রামে। ২৯ থেকে ৩১ তারিখ পর্যন্ত গ্রামে ছিলাম। ভোটের আগে এবং পরে বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথাবার্তা, গল্পস্বল্প করে তাদের মতামত এবং আমার সেন্টারে ফলাফলের সঙ্গে নির্বাচন-প্রশ্নকারীদের কথাবার্তা মিল খায় না। এই কেন্দ্রের মোট ভোটের সংখ্যা ৫১০০। প্রাপ্ত ভোট- আওয়ামী লীগ-২৬৩৬, বিএনপি- ১০৯৩, হাতপাখা- ২৬৫, গোলাপ ফুল- ৪৫, লাঙ্গল- ৬০-৬৫, কাঁচি- ৪। তাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ হচ্ছে, এই ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপারে নৌকার সিল দেয়া হয়েছে ৩৫০ থেকে ৪০০ বলে অভিযোগ। আওয়ামী লীগের ২৬৩৬ থেকে অভিযুক্ত ৪০০ ভোট বাদ দিলে দাঁড়ায় ২২৩৬। অভিযুক্ত ৪০০ ব্যালট বিএনপির বাক্সে পরত না। তাহলে ভোটের হিসাব দাঁড়াবে- আওয়ামী লীগ ২২৩৬, বিএনপি ১০৯৩। যদিও এই ধরনের অভিযোগের কোন সত্যতা নেই। এই কেন্দ্রের ভোটাভুটি থেকে বোঝা যায় প্রথমত. বিএনপি নেতাকর্মী (আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছি) এবং সাধারণ ভোটাররাসহ সকল দলের (এমনকি কাস্তে মার্কা-বাম জোট) সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে পেরেছেন। অভিযুক্ত সিল মারা ব্যালট বাদ দিলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী দ্বিগুণ ভোটে জয়ী হয়। দুপুরের দিকে ব্যালট পেপারে সিল মারা নিয়ে প্রায় আধাঘণ্টা উত্তেজনা বিরাজ করছিল, কিন্তু কোন মারামারি-হাতাহাতি হয়নি। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে। এবার আসা যাক, নির্বাচন কমিশন এবং বিদেশীদের কাছে অনুরোধ-উপরোধ প্রসঙ্গে। এতে কোন লাভ হবে বলে আমি মনে করি না। কারণ, বিদেশীদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা রয়েছে- তারা প্রথমে ভাববে পৃথিবীর কোন্ দেশে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয় না? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ প্রেসিডেন্টের চার বছর হয়ে গেল এখনও তদন্ত চলছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ, ইংল্যান্ডের বিগত নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ, জার্মানির বিগত নির্বাচনও প্রশ্নের উর্ধে নয়। বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচন সম্পর্কে তারা ভাববে টুকিটাকি ছোটখাটো সমস্যা (যেমন ভোটার সিরিয়াল পাওয়ায় অসুবিধা) ছাড়া যারা ভোটকেন্দ্রে গিয়েছেন তারা ভোট দিতে পেরেছেন, সম্ভাব্য নাশকতামূলক এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করতে গেলে ব্যবস্থা নেয়ার সময় ছোটখাটো আতিশয্য হতেই পারে। ভারতসহ এশিয়া আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকার মতো উন্নয়নকামী দেশে এ রকমই হয়। কিছু কিছু স্থানে বা কেন্দ্রে স্থানীয়ভাবে কিছু কিছু অনাকাক্সিক্ষত ও অনাবশ্যকীয় দুঃখজনক ঘটনা ছাড়া নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবেই হয়েছে। সামগ্রিকভাবে নির্বাচনের ফলাফলে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ভারত এমনকি পাকিস্তানও এই নির্বাচনকে গ্রহণ করেছে এবং শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিনন্দন জানিয়েছেন। একটা কথা বলে আমার নিবন্ধ শেষ করব- জনগণের স্বার্থে রাজনীতি, উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করতে এবং সেই লক্ষ্যে গণমুখী উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল সুসংহত করার জন্য আমাদের অনেক পথ চলতে হবে। এই লক্ষ্যে বিশ্বাসী সমাজতাত্ত্বিক-দার্শনিক, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সমাজকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক-কৃষক এবং তরুণ প্রজন্মকে নিজস্ব পরিধিতে উদ্যোগ নিতে হবে। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত পাঁচ বছরে এটাকে অন্যতম মূল লক্ষ্য স্থির করে এগোতে হবে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা একমাত্র শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব। একমাত্র তিনিই পারেন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এই পথে এগোতে। যেমনটা বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন বাঙালী জাতির স্বাধীনতা এবং মুক্তির সংগ্রামে। লেখক : সেক্রেটারি জেনারেল বাংলাদেশ শান্তি পরিষদ
×