ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৫ জানুয়ারি ২০১৯

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ দুর্যোগের দেশ। আবহাওয়া ও জলবায়ুর কারণে এদেশে বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ নেমে আসে। সরকারের সহযোগিতায় আমাদের দেশের জনগণ বুঝে গেছে কীভাবে দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়। আমাদের জনগণ এখন খুবই সচেতন। যে কোন দুর্যোগের আগে সরকারী-বেসরকারী সব প্রতিষ্ঠানের লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্যোগকবলিত মানুষকে রক্ষার জন্য। দুর্যোগ সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের সচেতনতা এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, দেশে প্রকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানির ঘটনা আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে ‘রোল মডেল’। বড় ধরনের দুর্যোগে সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার সকাল দশটায় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সিভিল মিলিটারি মানবিক সহায়তা কার্যক্রম সমন্বয় গ্রুপের (আরসিজি) চতুর্থ সেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল গ্রান্ড বলরুমে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে বিভিন্ন দেশের ১৫০ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্যোগ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। তবে দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগও উপেক্ষা করতে পারি না। মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগেও অনেক ক্ষতি হয় দেশের। তিনি বলেন, দুর্যোগ-ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় সরকারের বিনিয়োগ, দুর্যোগের পূর্বাভাস ব্যবস্থার উন্নয়ন, নতুন আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন এবং দুর্যোগের প্রস্তুতি ও উদ্ধার কার্যক্রমে স্বেচ্ছাসেবীদের নিবেদিত প্রচেষ্টাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে যে কোন দুর্যোগে প্রাণহানির সংখ্যা ‘ব্যাপকভাবে’ হ্রাস পেয়েছে। আমরা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাতেও এখন সিপিপি মডেল অনুসরণ ও সম্প্রসারণ করছি। দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ কার্যক্রমের পরিবর্তে আমরা টেকসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল হিসেবে পরিচিত, বাংলাদেশ দুর্যোগ স্থিতিস্থাপকতা অর্জনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মানুষ দুর্যোগ প্রতিরোধ করতে না পারলেও দূরদর্শী পরিকল্পনার মাধ্যমে দুর্যোগে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন সরকার প্রধান। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমরা ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রশমন কর্মসূচীর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছি। বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি কার্যকরভাবে মোকাবেলায় বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের মধ্যে সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সাফল্যের একটি চিত্রও প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জার্মানওয়াচ প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-২০১৭ অনুযায়ী ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বিশ্বে ১১ হাজার ৫০০ আবহাওয়াজনিত দুর্যোগ হয়েছে। এর ফলে প্রায় ৫ লাখ ২৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এসব দুর্যোগে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩.৪৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৯ নম্বরে। ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে পরপর দু’বার বাংলাদেশের অবস্থান ৬ নম্বরে ছিল। জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ভূমিকা নগন্য হলেও ভৌগোলিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ থাকছে প্রথম সারিতে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, টর্নেডো, বজ্রপাত, ভূমিধসের মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাংলাদেশের অত্যন্ত বেশি বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশকে বেশ কয়েকটি প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়েছে। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সাইক্লোনটি আঘাত হেনেছিল ১৯৭০ সালে, তাতে প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। এত বড় মানবিক বিপর্যয়ের পরও তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সে সময় দুর্গত এলাকায় উদ্ধার এবং ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা ১৯৭২ সালে সাইক্লোন প্রস্তুতি কর্মসূচী (সিপিপি) প্রস্তুত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বড় আকারের মানবিক সঙ্কটের ঘটনা বাড়ছে। তাই এ অঞ্চলে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে অসামরিক-সামরিক সমন্বয়ের গুরুত্বও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের সার্বিক জাতীয় কৌশলের অংশ হিসেবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ছাড়াও বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্স, বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, আনসার-ভিডিপি, বাংলাদেশ স্কাউটস, বিএনসিসির সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ২০১৭ সালে রাঙামাটিতে পাহাড় ধসের সময় উদ্ধার অভিযান চালাতে গিয়ে পাঁচ সেনা সদস্যের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের সাহসিকতার ফলে আরও বহু মানুষের জীবন এবং সম্পদ রক্ষা পেয়েছিল। বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা মিয়ানমারের ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত’ প্রায় ১১ লাখ নাগরিকদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ, অবকাঠামো নির্মাণ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অসামরিক-সামরিক সমন্বয়ে পরিচালিত কার্যক্রম মানবিক সহায়তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজ পরিচালনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ২৩৬ কোটি টাকার সরঞ্জাম কিনে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও অন্যান্য সংস্থাকে দিয়েছে। পাশাপাশি যানবাহন দুর্ঘটনা, অগ্নিকা-, ভবন বা সেতু ধস, সন্ত্রাসী আক্রমণের মতো মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলার জন্যও সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশকে ২০১৭ সালে কনসালটেটিভ গ্রুপের সভাপতি মনোনীত করায় গ্রুপের সকল সদস্য দেশকে তিনি ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি আমরা বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ গ্রহণ করেছি। এ পরিকল্পনার আওতায় আগামী এক শ’ বছরের জন্য টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। নেদারল্যান্ডস সরকার আমাদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ আছেন। আমরা তাদের সঙ্গে ২১০০ আমাদের যে ডেল্টা প্লান তা বাস্তবায়ন করব। এটা বাস্তবায়ন হলে দুর্যোগ মোকাবেলা এবং খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য ত্রাণ মন্ত্রণালয় বিগত কয়েক বছরে ২৩৬ কোটি টাকার সরঞ্জামাদি ক্রয় করে সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে হস্তান্তর করেছে। তিনি বলেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরী। পার্শ্ববর্তী দেশের এক্সপার্টদের সঙ্গে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বিনিময় দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ডাঃ এনামুর রহমানসহ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।
×