ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বসবাস ফুটন্ত লাভায়

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৫ জানুয়ারি ২০১৯

বসবাস ফুটন্ত লাভায়

মশিউর রহমান খান ॥ শত উদ্যোগেও পুরান ঢাকার নিমতলী থেকে অবৈধ কেমিক্যাল কারখানা স্থানান্তর করা যাচ্ছে না। এসব কেমিক্যাল কারখানা ও গোডাউন সরাতে সিটি কর্পোরেশনের সমন্বয়ে সরকারের র‌্যাব ও ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থা দফায় দফায় উচ্ছেদ অভিযানে ঘোষণা দিলেও কয়েকদিন পর অজ্ঞাত কারণেই তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে নিমতলী এলাকার কারখানা সরানোর পরিবর্তে উল্টো নতুন নতুন বাড়িতে আরও কেমিক্যাল কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে। দেশের ইতিহাসে নিমতলীর ভয়াবহ অবর্ণনীয় দুর্ঘটনার পর গত ৮ বছরে একচুলও নড়েনি কেমিক্যাল, গুদাম কারখানাও। আইন লঙ্ঘন করে আবাসিক ভবনে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি অথচ কারখানায় যুগের পর যুগ ধরে একই অবস্থায় রয়ে গেছে। এলাকাবাসী রাতে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির ফুটন্ত লাভার ওপর ঘুমাতে যায়। প্রায় ৪শ’ গুদামের এই আগ্নেয়গিরি যে কোন সময় আবার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তার জলন্ত লাভা ছড়িয়ে দিতে পারে আশপাশের এলাকায়। যে কোন মুহূর্তেই এক শলা আগুনে পুনরায় হতাহত হতে পারে শত শত নিরীহ মানুষ। মূলত বস্ত্র, প্লাস্টিক ও গাড়ির যন্ত্রাংশের কাজের জন্য বর্তমানে সারাদেশে প্রচুর কেমিক্যালের ব্যবহার করা হয়। তাই চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে পুরান ঢাকায় এসব কারখানা গড়ে উঠে। যার বেশিরভাগেরই নেই কোন ফায়ার সার্ভিস কিংবা সিটি কর্পোরেশনের কেমিক্যাল গোডাউন কিংবা কারখানার অনুমোদন। যেসব কারখানার অনুমোদন রয়েছে সেগুলোও রয়েছে বুড়িগঙ্গার ওপারে। আবাসিক বাড়ি ভাড়ার চেয়ে কেমিক্যাল কারখানার জন্য ভাড়া দিলে পাওয়া যায় ৫ গুণ বেশি ভাড়া। অবৈধ কারখানা মালিকদের কাছে তাই বাড়ি ভাড়া দিতে আগ্রহী মালিকরা। প্রকাশ্যে এসব অবৈধ কারখানা চললেও কোন সরকারী প্রতিষ্ঠানই এদের সরাতে সমর্থ হয়নি। সংশ্লিষ্ট সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হয়ে চুপসে গেছে। কেউ কেউ নামকাওয়াস্তে দায়িত্ব পালন করেই দায় সারছেন। অবৈধ এসব কারখানা উচ্ছেদে এ পর্যন্ত কোন প্রকার অভিযানও পর্যন্ত করতে দেখা যায়নি। ফলে প্রকাশ্যে নির্বিঘœ অবৈধ এসব ব্যবসা চালাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সহযোগিতা, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ছত্রছায়া সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও বিস্ফোরক অধিদফতরের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, যোগসাজশে কেমিক্যাল কারখানা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতোই দিন দিন বড় করছেন, যা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। শুধু একটি দুর্ঘটনায়ই ১২৪ জন মানুষ নিহত হওয়ার পরও কোনক্রমেই তারা এসব অবৈধ ব্যবসা থেকে সরতে রাজি নয় ব্যবসায়ীরা। তারা প্রকাশ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোন কিছুই যেন করতে পারছে না ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। এমনকি বিস্ফোরক অধিদফ-তরকেও এসব কারখানাকে নির্ধারিত স্থানে সরাতে কার্যকরী কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। অপরদিকে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ শুধু নোটিস দিয়েই খালাস। তাদের মতে, চেষ্টা চলছে, কিন্তু আইনানুযায়ী আমাদের তেমন কিছু করণীয় নেই। মূলত অবৈধ এসব কারখানা সরাতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন প্রতিষ্ঠানই উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে না। কেমিক্যাল কারখানা স্থানান্তরের সঙ্গে যুক্ত এমন বিভিন্ন সংস্থার কয়েক বছরের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করে, বারবার নোটিস দিয়ে, নাগরিকদের মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি করে, যে কোন দুর্ঘটনার ভয়াবহতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে, ব্যবসা বন্ধের জন্য ট্রেড লাইসেন্স বন্ধ করে দিয়ে, এমনকি সরকার এসব কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের জন্য নির্ধারিত জমি প্রদান করলেও উদ্যোগ গ্রহণের পর গত ৮ বছরে পূরণ ঢাকা থেকে একচুলই সরেনি এসব অবৈধ রাসায়নিক কারখানা। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার বংশাল থানার আরমানিটোলা, বাবুবাজর, মিটফোর্ড, লালবাগ থানা এলাকার শহীদনগর ও ইসলামবাগ এবং চকবাজার থানা এলাকায় ৪শ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে রয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের কয়েকটি ওয়ার্ডে এসব ভবন গড়ে তোলা হয়েছে। এই ভবনে গ্লিসারিন, সোডিয়াম এ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেনপার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কিটোন, থিনার, আইসোপ্রোপাইল ও টলুইনের মতো ভয়ঙ্কর রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ রয়েছে। এসব রাসায়নিকে সামান্য আগুনের স্পর্শে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। এমকি কয়েক মিনিটেই আগুন ছড়িয়ে যেতে পারে সমস্ত এলাকায়। নিমতলীর ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ যেসব ভবনে কেমিক্যাল কারখানা রয়েছে তার একটি তালিকা তৈরি করে। তালিকায় পুরান ঢাকার চারশ’ আসাবিক ভবনের খোঁজ পায় সংস্থাটি। এরপর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে এসব ভবন মালিককে কয়েক দফা নোটিস দেয় সংস্থাটি। কিন্তু এতে সামান্য কাজ হয়নি। উল্টো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করেই নতুন করে আরও কিছু আবাসিক ভবনে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট রাসায়নিক কারখানা গোডাউন। উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীর একটি বাড়ির নিচতলায় থাকা রাসায়নিকের গুদাম অগ্নিকা-ের ঘটনায় নারী-শিশুসহ ২৪ মানুষ মারা যায়। এ ছাড়া দুই শতাধিক মানুষ দগ্ধ হন। স্মরণকালের সবচেয়ে বড় এই অগ্নিদুর্ঘটনার পর কয়েকটি সরকারী সংস্থা পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা সরানোর সুপারিশ করে। এর অনেক পর আবাসিক ভবন থেকে রাসায়নিক গুদাম সরাতে ফায়ার সার্ভিসকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন ব্যাপক ঘোষণা দিয়ে একযোগে অভিযানে নামেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ওই চেষ্টা আর বাস্তবায়ন হয়নি। মাত্র কয়েকটি দোকানে ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে অভিযান পরিচালনার পরই থেমে যায় অভিযান। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদার জনকণ্ঠকে বলেন, এসব কারখানা সরাতে আমরা বারবার প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছে চিঠি থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে জনসচেতনতা তৈরি চেষ্টা করেছি ব্যবসায়ীরা এ এখান থেকে সরছেন না। গত বছর কিছু কারখানার বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযানও পরিচালনা করা হয়েছে, সম্প্রতি আমরা এসব কারখানা সরাতেও কোন প্রকার ব্যবসা না করতে পারে তা বন্ধ করতে এলাকার ছোট-বড় সব কেমিক্যাল কারখানা ও গোডাউনের আগে দেয়া সব ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছি। গত বছর থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স বইয়ের নবায়ন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এরপরও তারা সিটি কর্পোরেশন আইন অমান্য করে অবৈধভাবেই ব্যবসা চালাচ্ছেন। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান (অব:) জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা অনেক আগেই এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করেছি। সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো তৈরি হওয়া এসব কেমিক্যাল কারখানা এই স্থান থেকে সরিয়ে নিতে দফায় দফায় চিঠিও দিয়েছি। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য সরকারের কোন অনুমোদন না থাকায় আমরা অতি ঝুঁকিপূর্ণ এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন প্রকার আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারছি না। তবে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ তথা মেয়রের পক্ষ থেকে যে কোন প্রকার সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হলে আমরা আগুনের ভয়াবহতা থেকে মানুষকে ও তাদের সম্পদ রক্ষায় সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব।
×