ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আমদানিতে ডিজিটাল জালিয়াতি

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২৪ জানুয়ারি ২০১৯

চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আমদানিতে ডিজিটাল জালিয়াতি

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ নিষিদ্ধ ঘোষিত ও উচ্চ শুল্কের বিপুল পরিমাণ আমদানি পণ্য ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে খালাস করে নেয়ার ঘটনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। এনবিআর চেয়ারম্যান দফতর থেকে ইতোমধ্যে এ ঘটনায় কারা জড়িত তাদের সকলকে চিহ্নিত করে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম সিআইএস) ও শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের লক করে দেয়া আমদানির বিপুল পরিমাণ চালান খালাস হয়ে যাওয়ার ঘটনায় সরকার হারিয়েছে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব। প্রাথমিক তদন্তে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া রাজস্বের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা হবে বলে ধারণা করা হলেও তা আরও বহু বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে, এ ঘটনা নিয়ে আদালতের নির্দেশে সিআইডি, এনবিআর, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এবং চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের পৃথক তিনটি টিম তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া এনবিআরের সদস্য (শুল্কনীতি) ফিরোজ শাহ আলমও মঙ্গলবার থেকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে অবস্থান করছেন। আগামী তিন চার দিনের মধ্যে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট, কাস্টমস হাউস ও চট্টগ্রাম বন্দরের জড়িতদের চিহ্নিত করা হতে পারে বলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গোপন সূত্রের খবরের ভিত্তিতে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর প্রাথমিকভাবে আমদানির ২১টি চালান খালাস কাজে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছিল। কাস্টমস হাউসের এ্যাসাইকুড়া ওয়ার্ল্ড সিস্টেম থেকে বদলি হয়ে যাওয়া কয়েক কর্মকর্তার ইউজার আইডি ব্যবহার করে এসব পণ্য খালাস করে নেয়া হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে ২৫ ও ১৫ শতাংশের শুল্কের আমদানি পণ্য ও নিষিদ্ধ ঘোষিত পণ্যই মূলত জালিয়াতির মাধ্যমে খালাস করে নেয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃপক্ষ ধারণা করছে, চট্টগ্রাম কাস্টস হাউস, চট্টগ্রাম বন্দর ও সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট মালিকদের একটি সিন্ডিকেট এ ঘটনার সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে জড়িত। ইতোমধ্যে চিহ্নিত হওয়া সাত সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট মালিকের মধ্যে শুধু একজনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হলেও অন্যরা গা ঢাকা দিয়েছে। জালিয়াতির এ ঘটনা উদ্ঘাটন করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা। গোপন খবরের ভিত্তিতে সংস্থার মহাপরিচালক ড. শহীদুল ইসলাম ও কয়েক কর্মকর্তা এই অভিযোগের ওপর তদন্ত চালিয়ে এর সত্যতা নিরূপণে সক্ষম হন। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শাখাকেও তদন্তে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। অপরদিকে, গেল অর্থবছর ও চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত রাজস্ব আহরণে ধস নামার অন্যতম কারণ হিসেবে জালিয়াতির এ ঘটনাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কেননা, উচ্চ শুল্কহারের পণ্য জালিয়াতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস হয়ে যাওয়ার কারণে সরকার অর্থাৎ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সূত্র জানায়, জালিয়াতির এ ঘটনা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে দেখা যায়, কম্পিউটার সিস্টেমে লক করা আমদানি পণ্যের চালানসমূহ চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন শেডে রয়েছে বলে দৃশ্যমান। অথচ, এসব পণ্য গোপনে খালাস হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, কাস্টমস, বন্দরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে দিনের পর দিন নিষিদ্ধ ও লককৃত আমদানির চালান পরস্পরের যোগসাজশে খালাস করে নিতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি জালিয়াতির এ ঘটনা শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসার পর এখন এ সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট সকলে নড়েচড়ে উঠেছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের পক্ষে ইতোমধে পুরো বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট মহলগুলোকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। শুল্ক ও গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের পক্ষে এসব সংস্থার কাছে গত ১১ ও ১৪ জানুয়ারি প্রেরিত পৃথক পৃথক পত্রে জানানো হয়েছে, একজন অবসরপ্রাপ্ত রাজস্ব কর্মকর্তা ও আরেকজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার নামে ইস্যুকৃত এ্যাসাইকুড়া ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের ইউজার আইডি অপব্যবহার করে অভিনব পন্থায় শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে। এসব পত্রে জানানো হয়েছে, এ দফতর থেকে বিভিন্ন সময় আমদানি কিছু পণ্যের খালাস স্থগিত করার জন্য চট্টগ্রাম হাউস কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু সে সব পণ্য চালান জালিয়াতির মাধ্যমে খালাস করে নেয়া হয়েছে। সংস্থার প্রাথমিক অনুসন্ধানে অত্যাধুনিক কৌশল ব্যবহার করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে মিথ্য ঘোষণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি পণ্যের চালান খালাস করে নেয়ার চমকপ্রদ তথ্য উঠে আসে। গত ১৪ জানুয়ারি প্রদত্ত পত্রে জানানো হয়েছে, আমদানিকারক জাফর এন্টারপ্রাইজ, যার ঠিকানা ৫/৬ আহসান উল্লাহ রোড, গুলশান, ঢাকা কর্তৃক আমদানিকৃত তিনটি বিএলএর পণ্য চালানের বিষয়ে গোপন সংবাদ থাকার পর অনাপত্তি ব্যতীত এসব পণ্য খালাস না করার জন্য চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। এরপর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এ্যাসাইকুড়া ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদফতরের নামের বিপরীতে পণ্য চালান বি/এল লক করা হয়। পরবর্তীতে আমদানিকারক মনোনীত সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট কর্তৃক খালাস স্থগিতকৃত বিএলের বিপরীতে বিল অব এন্ট্রি দাখিলের আবেদন পাওয়া যায়। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে পণ্য চালানের বি/এল আনলক করে এর বিপরীতে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে তাৎক্ষণিক খালাস স্থগিত ও পরবর্তীতে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের অনাপত্তি ব্যতিরেকে খালাস প্রদান না করার জন্য চট্টগ্রাম কাস্টমকে পত্র দিয়ে অবহিত করা হয়। অথচ, কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন না করে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত পণ্যের চালান খালাস করে নেয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, খালাস হয়ে যাওয়া পণ্যের বিপরীতে সরকার হাজার কোটি টাকারও বেশি যে রাজস্ব হারিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সঙ্গত কারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তদন্ত কমিটি পৃথক পৃথকভাবে তাদের তদন্ত এগিয়ে নিতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত কি পরিমাণ নিষিদ্ধ ও উচ্চ মূল্যের শুল্কের আমদানির চালান জালিয়াতির মাধ্যমে খালাস হয়ে গেছে তা সুনির্দিষ্ট করতে সময় নেবে বলে নিশ্চিতভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে আগামী সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত কমিটিসমূহের পক্ষে প্রাথমিক একটি রিপোর্ট পাওয়ার আশা করা হচ্ছে।
×