ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিঠা পানির শুঁটকি

ইয়েলো গোল্ড- বিদেশে জনপ্রিয় হচ্ছে, মিলছে পাঁচতারা হোটেলেও

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২৪ জানুয়ারি ২০১৯

ইয়েলো গোল্ড- বিদেশে জনপ্রিয় হচ্ছে, মিলছে পাঁচতারা হোটেলেও

সমুদ্র হক ॥ মাছে-ভাতে বাঙালীর ঐতিহ্য চিরন্তন। তাজা মাছের নাড়ি ভূড়ি ফেলে টানা রোদে শুকিয়ে শুঁটকির প্রীতিও কম নয়। সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার লোনা পানির শুঁটকির জনপ্রিয়তায় ভাগ বসিয়েছে মিঠা পানির শুঁটকি। প্রাকৃতিক ও মানুষের সৃষ্ট কারণে দেশের বৃহত্তম চলনবিলের ভৌগলিক কাঠামো পরিবর্তনের (জলাভূমি কমে শুকনো ভূমি) পালায় গড়ে উঠেছে শুঁটকির আধার। একদার মৎস্যজীবীদের একটি অংশ পেশা পাল্টিয়েছে। উপকূলীয় এলাকার মতো তারাও এখন শুঁটকিজীবী। দক্ষিণাঞ্চলের ‘হোয়াইট গোল্ড’ (সাদা সোনা) খ্যাত চিংড়ির হাল ধরে উত্তরাঞ্চলের শুঁটকি ‘ইয়োলো গোন্ড’ (হলুদ সোনা) হয়ে সুনাম কুড়িয়েছে। সাধারণের কথা- লোনা পানির মাছের শুঁটকির স্বাদের চেয়ে মিঠা পানির মাছের শুঁটকির স্বাদ কম নয়। লোনা পানির রূপচাঁদা মাছের শুঁটকির স্বাদ যারা নিয়েছেন তাদের কাছে শোল বোয়াল টাকি মাছের শুঁটকির স্বাদ আরও ভালো লাগবে। একটা সময় সামুদ্রিক শুঁটকি পূর্বাঞ্চল-দক্ষিণাঞ্চলে এবং নদী ও বিলের মিঠা পানির মাছের শুঁটকি উত্তর ও উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে অধিক জনপ্রিয় ছিল। হালে চলনবিলের শুঁটকির নতুন স্বাদ সারাদেশের মানুষের মুখে উঠেছে। মিঠা পানির এই শুঁটকি মিলছে দেশের প্রতিটি এলাকায়। বিদেশ বিভূঁইয়ে মিঠা পানির মাছের শুঁটকির চাহিদা বেড়ে দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় দেশের নদী তীরবর্তী এলাকার জেলেরাও তাজা মাছ ধরার পাশাপাশি শুঁটকি তৈরিতেও মনযোগী হয়েছে। বাঙালীর খাদ্য তালিকায় শুঁটকি অভ্যাস বেড়ে গিয়েছে। শুঁটকির মুখরোচক রান্না চেটেপুটে সাবার করছে ভোজন বিলাসীরা। শুঁটকি মিলেছে পাঁচ তারকা খচিত হোটেলেও। চলনবিলের জলাভূমিতে আজ আর থৈ থৈ পানি নেই। অনেকটা ভূমি জুড়ে ধান পাট সবজিসহ নানা ফসলের আবাদ। বিলের নিচু ভূমির খালগুলোতে শুরু হয়েছে মাছের চাষ। খেয়া জাল, সুতি জাল, বেড়া জাল পলই দিয়ে মাছ ধরা হয়। মাছ আহরণের পর চার ভাগের তিনভাগই যায় শুঁটকি বানানোর জায়গায়। বিলের বিভিন্ন পয়েন্টে শুঁটকির চাতাল ও মাছ শুকানোর আলাদা স্থান তৈরি হয়েছে। বিল পাড়ে প্রবেশের পর শুঁটকির গন্ধ টেনে নিয়ে যায় চাতালের দিকে। এছাড়া ও বাঁশের বড় মাচাংয়ে বসানো হয়েছে ছোট ছোট অস্থায়ী চাতাল। এ ধরনের প্রায় এক হাজার অস্থায়ী চাতাল বসেছে। এইসব চাতালে মিঠা পানির নানা জাতের মাছের শুঁটকি বানানো হয়। শুঁটকি মাছের চাতালগুলোতে বেশি কাজ করছে নারী শ্রমিক। শোল, বোয়াল, পুটি, সরপুটি, খলসে, চেলা, ট্যাংরা, পাতাসি, মলা, ঢেলা, টাকি, ছাতেন, বাইম, কৈ, মাগুর, শিংগীসহ মিঠা পানির সব ধরনের মাছের শুঁটকি বানানো হচ্ছে। এমনকি চিংড়ি মাছের শুঁটকি তৈরি হয়। প্রতি মণ তাজা মাছ শুকালে ১৬ কেজি শুঁটকি মেলে। সাধারণত ৩ মণ তাজা মাছে এক মণ শুঁটকি পাওয়া যায়। প্রায় ১শ’ ২০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ২২টি জলাশয়ের ও ১৬টি নদীর সমন্বয়ে এই বিলের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর আয়তনের জলাভূমিতে মাছ আহরণ করে শুঁটকি তৈরি হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, দুবাই ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশে এই শুঁটকি যাচ্ছে। চলতি অর্থ বছরে ৮শ’ টনেরও বেশি শুঁটকি তৈরি হয়ে রফতানির তালিকায় যোগ হবে, এমনটি জানালেন একজন ব্যবসায়ী। শুঁটকি তৈরির পর এ. বি. সি. এই তিন গ্রেডে ভাগ করা হয়। এ গ্রেডের সকল শুঁটকি যায় বিদেশে। বি ও সি গ্রেড বিক্রি হয় দেশীয় বাজারে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, নীলফামারী, বরিশালসহ দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে এই শুঁটকি বাজারজাত হচ্ছে। মান ভেদে ছোট আকৃতির মাছের শুঁটকির দাম প্রতিমণ ১৬ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বড় আকৃতির মাছের শুঁটকির দাম প্রতি মণ ৩০ হাজার টাকা থেকে ৭০ হাজার টাকা। নাটোরের গুরুদাসপুরের নাজমুল আলম বললেন, গতবছর তার চাতালে ৭শ’ মণ শুঁটকি তৈরি হয়েছে। সবই ঢাকা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে গেছে। মূলত ঢাকা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে এই শুঁটকি বিদেশে যাচ্ছে। ঢাকার আশুলিয়ার ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক জানালেন, এই ব্যবসায় লাভ লোকসান দুই-ই আছে। শুঁটকি ভালভাবে শুকানো না হলে পঁচে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। চাটমোহরের ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দ জানালেন চলনবিলের শুঁটকির স্বাদ বেশি হওয়ায় বড় ব্যবসায়ীরা প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি করে । শুঁটকির এত চাহিদার পরও প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের তেমন ব্যবস্থা নেই। যারা রফতানি করে তারাই নিজের উদ্যোগে সংরক্ষণ ও প্যাকেটজাত করে। শুঁটকি ব্যবসায়ীরা বলছেন অপার সম্ভাবনার এই খাতটিকে এগিয়ে নিতে শুঁটকিজীবী ও চাতাল মালিকদের প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার। মৎস্য অধিদফতর এই কাজে এগিয়ে আসতে পারে। একই সঙ্গে শুঁটকির মান উন্নয়নে চাতাল মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের পরামর্শ দিয়েছে তারা।
×