ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সেদিন তোর নাও মাঝি শূন্য হয়ে থাকবেরে পড়ে...

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২৩ জানুয়ারি ২০১৯

সেদিন তোর নাও মাঝি শূন্য হয়ে থাকবেরে পড়ে...

মোরসালিন মিজান ॥ নির্মম সত্য এই যে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যারা লিখতে পারতেন সেইসব শিক্ষিতজন মুক্তিযুদ্ধে যাননি। তাদের সংখ্যা এতই কম, যাননি বললে বিশেষ ভুল হবে না। একাত্তরের অনেক কিছুই দেখা হয়নি তাদের। উপলব্ধি করা হয়নি। তাই ইতিহাস লেখার সময় ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। গান এবং সুরের বেলায়ও তা-ই। কী যেন নেই। ভেতরটা ঠিক বাজে না। কিন্তু ঠিক উল্টোটি ঘটেছিল আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের বেলায়। সদ্য প্রয়াত সুরকার গীতিকার একইসঙ্গে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তর তাকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছিল। সত্তাকে গড়ে দিয়েছিল। আর তাই মুক্তিযুদ্ধকে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া বাংলাদেশকে ধারণ করে আছে তার গান। মাতৃভূমির প্রতি প্রেম, মানুষের জন্য বুকভর্তি ভালবাসা ছিল। গানে গানে তা প্রকাশ করেছেন। এ কারণেই তার গান গানের অধিক। এ কারণেই তার লেখা ও সুর করা গান জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকেছে সব সময়। দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বহু গান লিখেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। সুরও করেছেন। সুরের কথাই আগে বলা যাক। তার সুরে আশ্চর্য এক মায়া জড়িয়ে ছিল! আবেগ আর আবেদন ছিল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা গানে নিজের এসব গুণ উজাড় করে দিয়েছেন তিনি। বিখ্যাত গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু লিখেছিলেন: সবক’টা জানালা খুলে দাও না/আমি গাইবো, গাইবো বিজয়েরই গান।/ওরা আসবে চুপি চুপি,/যারা এই দেশটাকে ভালবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ...। হ্যাঁ, গীতিকার একটু এবস্ট্রাক্ট থাকার চেষ্টা করেছিলেন। সব খুলে বলতে যাননি। চাননি। কিন্তু বুলবুল কথাগুলোকে এমনভাবে সুরে বেঁধেছিলেন যে, ব্যক্ত করা আবেগ, অব্যক্ত বেদনা সবই গান হয়ে যায়। গুনগুন করে গাইতে থাকেন শ্রোতা। বিটিভি যুগে রাত ৮টার সংবাদ দেখতেন সব দর্শক। সারাদেশের মানুষ দেখতেন। আর সেই সংবাদের শুরুটা হতো এই কালজয়ী গানের সুরে। এভাবে গানটি শুধু গান হয়ে থাকেনি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মদানের ইতিহাসকে নতুন মাত্রায় উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়। বীর সন্তানেরা যে আসলে হারিয়ে যায়নি, তারা যে বাংলার আকাশে বাতাসে ফলে ফসলে মিশে আছেন, তা স্মরণ করিয়ে দেয় প্রিয় এই গান। অনুভূতির জায়গাটুকু বুলবুল সৃষ্টি করেছিলেন। মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের লেখা আরেকটি গানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কথাগুলো এরকম- দস্যি ছেলে সেই যুদ্ধে গেল ফিরলো না আর/আজও শূন্য হৃদয়ে তার গুমড়ে গুমড়ে যায় হাহাকার/খোকা আসবে, ঘরে আসবে যেন মরণের সীমা ছাড়িয়ে...। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল নিজেই তো দস্যি ছেলে। যুদ্ধ শেষে তিনি ফিরে আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু আরও কত বুলবুল হারিয়ে গেছে! মুক্তিযুদ্ধে সন্তান হারানো জননীর কষ্ট তার চেয়ে ভাল আর কে বুঝবে? গানটির সুর করতে গিয়ে পাগলী মায়ের আর্তনাদটুকু হাহাকারটুকু বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেছিলেন তিনি। সেই থেকে এর আলাদা তাৎপর্য। বিশেষ দিবসগুলোতে কে না গায় এই গান! কার চোখ জলে ভিজে ওঠে না? আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল সারাজীবন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার পক্ষে কাজ করেছেন। কোথাও এর ব্যত্যয় হতে দেখলে বড় কষ্ট পেতেন তিনি। প্রতিবাদ করতেন গানে গানে। সিনেমার সেই জনপ্রিয় গানটির কথাই ধরা যাক, নিজের লেখা গানে প্রশ্ন রেখে তিনি বলছেন: আজো কেন তোমার বুকে ঘুরছে তারা,/একাত্তরের দালাল যারা...। এখানে ‘তুমি’ মানে দেশমাতা। ‘তুমি’ মানে সরকার। রাষ্ট্র। ‘তুমি’ মানে জনগণ। সকলকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের এতকাল পরও কেন স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আলবদরদের আস্ফালন শুনতে হবে? এ কোন বাস্তবতা? ভাবিয়ে তুলে তার গান। বাঙালীর গৌরবের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিতে তিনি লিখেনÑ একাত্তরের মা জননী, কোথায় তোমার/মুক্তি সেনার দল।/যারা অস্ত্র হাতে ধরেছিল,/মাগো তোমার তরেই মরেছিল।/ও মা যাদের ভয়ে পালিয়েছিল শত্রæ সেনার দল...। বুলবুলের গানের বড় অংশ জুড়ে ছিল দেশ। অনেকে বলেন, দেশের গান জনপ্রিয় হয় না। লোকে শুনে না। লিখতে পারলে, সুর দিতে পারলে কেন শুনবে না? জলজলে উদাহরণ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তার কত যে দেশাত্মবোধক গান! চিরকালের হয়ে আছে। তার লেখা ও সুর করা একটি গানের কথা তুলে ধরা যাক। সেখানে তিনি বাংলাদেশের রূপের বর্ণনা দিয়ে বলছেন: সুন্দর, সুবর্ণ, তারুণ্য, লাবণ্য/অপূর্ব রূপসী রূপেতে অনন্য/আমার দু’চোখ ভরা স্বপ্ন/ও দেশ, তোমারই জন্য...। দেশ নিয়ে নিজের স্বপ্নের কথাও গানে গানে তুলে ধরেছেন। লিখেছেন: থাকবে নাকো দুঃখ দারিদ্র্য/বিভেদ- বেদনা-ক্রন্দন/প্রতিটি ঘরে একই প্রশান্তি/একই সুখের স্পন্দন...। এ গান কে জানেন না? সাবিনা ইয়াসমীনের সঙ্গে নিজের অজান্তেই কত লোক ঠোঁট মেলান! মেলান না? দেশাত্মবোধক গানকে জনপ্রিয় করার পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মকে উজ্জীবিত করার সচেতন প্রয়াস তার গানে লক্ষ্য করা যায়। অভিন্ন বোধ থেকে কিছু ছন্দবদ্ধ কথাকে প্রতিজ্ঞার পর্যায়ে উন্নীত করেছেন সুরকার। তেমনি একটি গান: মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেবো না,/তোমার মাথার খোঁপারই ফুল বাসি হতে দেবো না,/তোমায় মাগো কারো ঘরের দাসী হতে দেবো না...। গানটিতে যে বলা সেটিকে দৃঢ় করে বুলবুলের সুর। শ্রোতা গানটি শুনতে শুনতে যেন নিজেই এর অংশ হয়ে যান। দেশমাতার সম্মান রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা করেন। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল দেশের মতোই মানুষকে ভালবাসতেন। তার গান প্রেমেপূর্ণ ছিল। সিনেমার জন্য এমন অনেক গান তিনি লিখেছেন কিংবা সুর করেছেন। সস্তা চটুল কোন কথা বা সুর নয়। বরং মানব মানবীর প্রেমকে নিয়ে গিয়েছেন অন্য উচ্চতায়। হিংসা বিদ্বেষ নয়, শাশ্বত ভালবাসার কাছে নত হওয়ার বাণী প্রচার করেছেন তিনি। তার লেখা কিংবা সুর করা এমন গানের মধ্যে রয়েছেÑ আমার সারা দেহ খেওগো মাটি, আমার বুকের মধ্যেখানে, আমি তোমারই প্রেম ভিখারি, আইলো দারুণ ফাগুনরে, আমি তোমার দুটি চোখে দুটি তারা হয়ে থাকব, পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমারই ছোঁয়াতে যেন পেয়েছি, তোমায় দেখলে মনে হয় হাজার বছর আগেও বুঝি ছিল পরিচয়...। এখনও মুখে মুখে ফেরেÑ আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে, আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান, বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম, এই বুকে বইছে যমুনা, প্রেম কখনো মধুর কখনো সে বেদনাবিধূর...। তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল: পড়ে না চোখের পলক, যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে, তুমি আমার জীবন আমি তোমার জীবন, তোমার আমার প্রেম এক জনমের নয়, তুমি হাজার ফুলের মাঝে একটি গোলাপ, আমার হৃদয় একটা আয়না, ফুল নেবে না অশ্রæ নেবে বন্ধু, বিধি তুমি বলে দাও আমি কার, তুমি মোর জীবনের ভাবনা, তুমি আমার এমনই একজন...। আরও কিছু গানের কথা বলা যেতে পারে। এই যেমন- জীবন ফুরিয়ে যাবে ভালোবাসা ফুরাবে না জীবনে, অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন, নদী চায় চলতে তারা চায় জ্বলতে, চিঠি লিখেছে বউ আমার...। না, এত লিখেও জনপ্রিয় গানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। কী করে এত এত জনপ্রিয় গান করা সম্ভব হলো? উত্তর খুঁজতে, আগেই বলা হয়েছে, ফিরে যেতে হবে একাত্তরে। মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নিজেকে নিজের দেশকে দেশের মানুষকে গভীরভাবে বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন ক্ষণজন্মা গীতিকার সুরকার। তাকে বোঝার জন্য গৌরবোজ্জ্বল সেই ইতিহাসটি স্মরণ করা জরুরী। জানা যায়, মাত্র মাত্র ১৫ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। আজ ভাবতে অবাক লাগে, ওইটুকুন বয়সে বুলবুলের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল দেশবোধ। দেশচেতনা। একটি স্বাধীন ভূখণ্ড নিজের মতো করে বাঁচার আকুতি তাকে অস্ত্র হাতে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। যতদূর তথ্যÑ ঢাকার আজিমপুরে ওয়েস্টটেন্ট হাইস্কুলে পড়ালেখাকালীন সময় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তিনি। প্রথমে বন্ধু সজিবের নেতৃত্বে বিহারিদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে একটি ছোট মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করেন তারা। ঢাকার অদূরে জিঞ্জিরায় ঘাঁটি তৈরি করে পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে লড়ে যান। বুলবুলের বড় ভাই ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ টুলটুলও ছিলেন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে ঢাকায় গেরিলা অপারেশনে অংশ নেন বুলবুল। পরে তিনি ভারতে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে ফের বন্ধু সজিবের গ্রæপে যোগ দেন। ইয়াং প্লাটুনের এই যোদ্ধা একাধিকবার পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকারদের হাতে আটক হয়ে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। এভাবে দেশ কী, কত কষ্টে এই দেশ পাওয়া তিনি তা নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। এবং এইসব উপলব্ধি আবেগ গানের কথায় সুরে প্রকাশিত হয়েছে। এ কারণেই আরও অনেক গীতিকার ও সুরকার থেকে তিনি আলাদা। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল জীবনের শেষদিন পর্যন্ত একাত্তরের চেতনাকে বুকে ধারণ করেছিলেন। জানা যায়, যুদ্ধের এক পর্যায়ে আটক হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে ছিলেন তিনি। সে সময় ঈদের দিন শহীদ সিরু মিয়া দারোগা ও তার সন্তান শহীদ কামাল আনোয়ার এবং শহীদ নজরুলসহ ৩৮ জনকে কারাগার থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ৩৮ জনকে পরে হত্যা করে গণকবর দেয় পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী ও রাজাকাররা। পরবর্তীতে স্বাধীন দেশে বহুল প্রত্যাশিত যোদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে ট্রাইব্যুনালে গিয়ে সাক্ষী দেন প্রত্যক্ষদর্শী বুলবুল। তার সাক্ষ্য মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তি নিশ্চিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এবং এরই জেরে তার ভাইকে খুন হতে হয়। ওই বিয়োগান্তক ঘটনায় ভীষণ কষ্ট পান আবেগী মানুষটি। এর পরও মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশ চেতনাকে শেষদিন পর্যন্ত বুকে বাঁচিয়ে রাখেন। এ কারণেই হয়ত তার সুরও বেঁচে ছিল। বেঁচে থাকবে ভবিষ্যতেও। সেদিন তোর নাও মাঝি/শূন্য হয়ে থাকবে রে পড়ে...। না, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুর কথা পড়ে থাকবে না। বাংলাদেশ থাকলে তার গানও থাকবে। কালজয়ী সৃষ্টির মধ্যে চিরদিন বেঁচে থাকবেন গানের এই বুলবুল।
×