ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ছোট ভাই খুনের বিচার দেখে যেতে পারলেন না বুলবুল

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৩ জানুয়ারি ২০১৯

ছোট ভাই খুনের বিচার দেখে যেতে পারলেন না বুলবুল

শংকর কুমার দে ॥ ছোট ভাই মিরাজ আহমেদ খুনের বাদী ছিলেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ছোট ভাইয়ের খুনের বিচার দেখে যাওয়ার আগেই বিদায় নিলেন তিনি। ছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধী মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। এ জন্যই প্রতিশোধ নিতে খুন করা হয় ছোট ভাই মিরাজকে। শুধু তাই নয়, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল নিরাপত্তার জন্য বছরের পর বছর পুলিশ পাহারায় ছিলেন, ছিলেন গুরুতর অসুস্থ। বুলবুলের হার্টে আটটি ব্লক ধরার পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে অসহায়ের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। বুলবুলের ফেসবুক স্ট্যাটাস নজরে এলে তার চিকিৎসার ব্যয় বহনের দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার রাতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত এভাবেই কেটে গেছে বরেণ্য এই শিল্পীর করুণ জীবন। জনকণ্ঠ প্রতিবেদকের কাছে ছোট ভাই হত্যাকা-ের ঘটনা, মামলার তদন্তের বিষয়, নিজের নিরাপত্তাহীনতা, ছিলেন অনেকটা গৃহবন্দী, মারাত্মক অসুস্থতা, প্রধানমন্ত্রীর সহানুভূতিতে দ্রুততম সময়ে হলো চিকিৎসার ব্যবস্থা, সঙ্গীতের ভুবনের অনেক কাহিনী জীবদ্দশায় বর্ণনা করে গেছেন প্রথিতযশা বরেণ্য শিল্পী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ’১৮ সালের ১৬ মে এই বরেণ্য শিল্পীর সঙ্গে শেষ দেখায় কথা হয় অনেক। এক বুক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তিনি বলছিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তো ঠিকই হলো, কিন্তু ছোট ভাইয়ের বিচার আজও পেলাম না। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধীর আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হয়ে এখন আমি নিরাপত্তাহীন। গৃহবন্দী। পুলিশ পাহারায় আছি। একজন শিল্পী কি পুলিশ পাহারায় থাকতে পারে। শিল্পীরা থাকেন মুক্ত জীবনে। এক জীবনে সেটা আর হলো না। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আর নেই- টিভির স্ক্রলে তার মৃত্যুর খবরটি দেখেই মনের অজান্তে চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু বের হয়ে এলো। বুলবুল গত বছর ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরেই মূলত তার সঙ্গে যোগাযোগ, কথোপকথন, ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক এই প্রতিবেদকের। মর্মস্পর্শী ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি যা বলে গেছেন তা তুলে ধরা হলো : বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘একটি ঘরে ছয় বছর গৃহবন্দী থাকতে আমি আজ অসুস্থ। আমার হার্টে আটটা ব্লক ধরা পড়েছে। এরই মধ্যে কাউকে না জানিয়ে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। সেখানে সিসিইউতে চার দিন ছিলাম। আগামী ১০ দিনের মধ্যে হার্টের বাইপাস সার্জারি করানোর জন্য প্রস্তুত আছি।’ বুলবুল বুধবার ফেসবুকে আরও লেখেন, ‘আমি এখন ২৪ ঘণ্টা একমাত্র সন্তানকে নিয়ে পুলিশী পাহারায় গৃহবন্দী থাকি। এ এক করুণ অধ্যায়।’ গৃহবন্দী থাকার বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘বন্ধুরা, সরকারের নির্দেশে ’১২ সালে আমাকে যুদ্ধাপরাধীর ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় সাক্ষী হিসেবে দাঁড়াতে হয়েছিল। সাহসিকতার সঙ্গে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিতে হয়েছিল ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলখানার গণহত্যার সম্পূর্ণ ইতিহাস। ওই গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া পাঁচজনের মধ্যে আমি একজন। হত্যা করা হয়েছিল একসঙ্গে ৪৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে। কিন্তু এই সাক্ষ্য দেয়ার কারণে আমার নিরপরাধ ছোট ভাই মিরাজকে হত্যা করা হবে, তা কখনও বিশ্বাস করতে পারিনি। সরকারের কাছে বিচার চেয়েছি, বিচার পাইনি।’ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ফেসবুকে লেখা তার এই স্ট্যাটাসে নিজের চিকিৎসার জন্য কারও কাছ থেকে কোন সহযোগিতা চাননি। তিনি লিখেছেন, ‘কোন সরকারী সাহায্য কিংবা শিল্পী, বন্ধুবান্ধবের সাহায্য আমার দরকার নাই। আমি একাই যথেষ্ট। শুধু অপারেশনের আগে ১০ সেকেন্ডের জন্য বুকের মাঝে বাংলাদেশের পতাকা আর কোরআন শরিফ রাখতে চাই।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আসে বুলবুলের দেয়া ফেসবুকের এ পোস্টটি। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পেছনের কথা ॥ আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে ২০১৩ সালের এই মার্চ মাসে বুলবুলের ছোট ভাই মিরাজ খুন হন। তারপর খুনের রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব দেয়া হয় থানার পুলিশকে। থানার পুলিশ রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হলে তদন্তভার দেয়া হয় সিআইডিকে। কারা কখন কিভাবে কোথায় তাকে খুন করে লাশ ফেলে গেছে দীর্ঘ ৫ বছরে সিআইডিও খুনের রহস্য উদঘাটনের কুল কিনারা করতে পারেনি তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ পাঁচ বছরে তদন্তের রহস্য উদঘাটিত তো হলেই না, বরং খুনের রহস্য আরও ঘনীভূত হয়েছে। ছোট ভাই মিরাজ হত্যার বিচার পাননি বড় ভাই আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ও তার পরিবার। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে সাক্ষ্য দেন আহমেদ ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীর মামলা চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী দেয়ার কারণে বড় ভাই ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুলের ওপর প্রতিশোধ নিতে তার ছোট ভাই মিরাজ আহমেদকে পরিকল্পিতভাবে ঠা-া মাথায় খুন করা হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠিকই হয়েছে, কিন্তু বড় ভাই সাক্ষী হওয়ার কারণে ছোট ভাই খুন হওয়ার কোন বিচার তো হলোই না, বরং তদন্ত যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। তদন্তকারীদের সন্দেহ হয়, ছোট ভাই মিরাজ খুনের পর পরই বড় ভাই আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী হওয়ার কারণে এই খুনের ঘটনাটা ঘটেছে। ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুলের ছোট ভাই মিরাজ আহমেদ হত্যাকা-ের ঘটনার পেছনে জামায়াত-শিবিরের সম্পৃক্ততা থাকার বিষয়টির পথ ধরে তদন্ত তখন সামনের দিকে এগুতে থাকলেও কোথায় যেন তদন্ত আটকে গেছে, থেমে গেছে তদন্তের অগ্রগতির পথ। সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিশিষ্ট সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হওয়ার পর ছোট ভাই মিরাজ খুন হন ’১৩ সালের ৯ মার্চ। খিলক্ষেত কুড়িল বিশ্বরোডের রেললাইনের পাশ থেকে মিরাজ আহমেদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর খুনের রহস্য উদঘাটনের জন্য পুলিশকে তদন্তভার দেয়া হয়। তদন্ত তারপর সিআইডির কাছে ন্যস্ত করা হয়। সিআইডিতে মামলাটির তদন্তভার হস্তান্তরের পর মিরাজ হত্যাকা-ের ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের ব্যাপারে তদন্ত অব্যাহত আছে। খুনের পর সিআইডি ইতোমধ্যেই জামায়াত-শিবিরের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। মিরাজ খুনের পর তার সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, মিরাজ আহমেদের দুই ঠোঁটের ভেতর, মাথার পেছনে রক্ত জমাট বাঁধা ছিল। নাক ছিল ভাঙ্গা। গলায় শ্বাসরোধের চিহ্ন রয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে তাকে আঘাতের পর শ্বাসরোধ করে হত্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। খুনের ঘটনার ৪ দিন পর ১৩ মার্চ খিলক্ষেত থানায় বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন মিরাজ আহমেদের বড় ভাই প্রখ্যাত সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।
×