ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আর নয় ‘গৃহপালিত বিরোধী দলের’ অপবাদ

সন্ত্রাস-দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবার সংসদে ঝড় তুলবে জাপা

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৩ জানুয়ারি ২০১৯

সন্ত্রাস-দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবার সংসদে ঝড় তুলবে জাপা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো গত পাঁচ বছরে সংসদে কার্যকর বিরোধী দল ছিল না। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ ৪০ সংসদ সদস্য নিয়ে বিরোধী দলের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ’১৪ সালের মতো এবারের নির্বাচনেও বিরোধী দলে জাতীয় পার্টি। তাই আবারও প্রশ্ন বিরোধী দল হিসেবে কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারবে দলটি। যদিও এবারের প্রেক্ষাপট অনেকটাই ভিন্ন। গত মেয়াদে সরকার ও বিরোধী দলে অবস্থান ছিল জাপার। এবার শুধু বিরোধী দল। তাদের গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবেই লোকে জানত। এই অপবাদ ঘোচাতে চাইছে জাপা। তাছাড়া বিরোধী দলের নেতৃত্বের এবার পরিবর্তন এসেছে। অবশ্য এরশাদের অসুস্থতার কারণে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা কতটুকু কার্যকর হবে তাই দেখার বিষয়। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একাদশ সংসদ কার্যকর করতে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের পাশাপাশি সংসদে ঝড় তুলবে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। এবার নিজেদের শক্ত বিরোধী দল হিসেবে তুলে ধরতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়ার কথা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। সংসদ অধিবেশনে তার শাসনামলের উন্নয়নের চিত্রও তুলে ধরবেন এরশাদসহ দলীয় নেতারা। সে লক্ষ্যেই পুরোপুরি প্রস্তুতি নিতে দলের এমপিদের তৈরি হতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও সংসদ উপনেতা জিএম কাদেরকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়েছে। তাদের কাজ হচ্ছে বিগত দিনে এরশাদের শাসনামলে দেশে যে হারে উন্নয়ন হয়েছে সেগুলোকে সামনে এনে সরকারকে ঘায়েলের চেষ্টা করা। সেই সঙ্গে থাকবে ডকুমেন্টারি ফাইল। পাশাপাশি রাজনৈতিক সমালোচনা এড়াতে শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকা অনুসরণ করবে জাপা। কার্যকর সংসদ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে নিজেদের সমর্থন বাড়াতে চায় দলটি। এদিকে সংসদ অধিবেশনে যোগ দিতে মুখিয়ে থাকলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে উদ্বিগ্ন এরশাদ। এর আগে নতুন সংসদে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালনের এবারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে না বলে জানিয়েছেন দলের নেতারা। শেষ পর্যন্ত নেতাদের কথাই সত্যি হলো। তারা বলেছেন, সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করেই তারা বিরোধী দলে বসছেন। বিদায়ী সংসদে দলটি একই সঙ্গে সরকার এবং বিরোধী দলে থাকায় এ নিয়ে অনেক সমালোচনা ছিল। বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন, বিভিন্ন সময় দলটির সিদ্ধান্ত বারবার পরিবর্তন হওয়ায় বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। দশম জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি ৩৪ আসনে বিজয়ী হয়েছিল। সংরক্ষিত আসন মিলিয়ে ৪০ এমপি নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে দলটি। একাদশ জাতীয় সংসদে বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে অংশ নেয়। তারপরও জাপা ২২ আসনে জয় পায়। আর আটটি আসনে জয় পায় ঐক্যফ্রন্ট। তবে সংরক্ষিত আরও চারটি আসন পাবে জাপা। যদিও জাতীয় পার্টি এবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট গঠন করেছিল, তবুও আসন বিবেচনায় বিরোধী দলে যাচ্ছে জাপা। এ প্রসঙ্গে জাপার কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের জানান, জাতীয় পার্টি সংসদে গঠনমূলক সমালোচনা করে সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেবে। বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষের কথা বলবে। এতে সাধারণ মানুষের মাঝে জাতীয় পার্টির গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। তিনি বলেন, দেশের মানুষ সহিংস রাজনীতি পছন্দ করে না। জাতীয় পার্টি সংসদে কতটা শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকা রাখবে, তা কাজের মাধ্যমে প্রমাণ হবে। আমরা একটি জবাবদিহিমূলক সরকার গঠনে কাজ করব। জাপা নেতারা জানান, তবে এবার সরকারের স্বার্থেই জাতীয় পার্টির বিরোধী দলে থাকার সিদ্ধান্ত টেকসই হতে পারে। অপরদিকে হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মকা- নিষিদ্ধ, প্রাদেশিক সরকার, নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার ও পূর্ণাঙ্গ উপজেলা প্রবর্তনসহ ১৮ বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার তৈরি করেছিল দলটি। নির্বাচনের আগে জাতির মুক্তির জন্য এরশাদের ১৮ দফা ইশতেহার ঘোষণা করা হয়েছিল। ক্ষমতায় না গেলেও প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় জাপার ইশতেহার বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাবে জাপা। একথা জানিয়ে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুর সবুর আসুদ বলেন, উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, সরকার পরিচালনা ও নির্বাচনের পদ্ধতি, এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন করে প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন, দুই স্তরের সরকার কাঠামো এবং নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার, পূর্ণাঙ্গ উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, শিক্ষা পদ্ধতির সংস্কার, স্বাস্থ্য সেবা সম্প্রসারণ, সন্ত্রাস দমনে কঠোর ব্যবস্থা। তাদের মতে নতুন প্রজন্মের জন্য আগামী অর্ধ শতাব্দী সময়কে সামনে রেখে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাতীয় পার্টি নতুনভাবে এই ১৮ দফা কর্মসূচী ছিল জাপার। সংসদে কেমন ভূমিকা রাখবেন জানতে চাইলে পার্টি মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে, যারা আগুন সন্ত্রাস করে তারা জনগণের পছন্দে নয়। সংসদে আমরা দরিদ্র, মেহনতি মানুষের কথা বলব, সাংবাদিকদের কথা বলব। আমরা গণমানুষের আস্থা অর্জন করে দ্বাদশ সংসদে জাতীয় নির্বাচনে প্রত্যাশিত ফল অর্জন করব। জাপা নেতারা জানান, সংসদে মন্ত্রিত্বে এবং বিরোধী দলে থাকা, এটা খারাপ দেখায়। সাংবিধানিকভাবেও সাংঘর্ষিক। সে জন্য পার্টি চেয়ারম্যান চিন্তা করেছেন যে, আমাদের মন্ত্রিসভায় যাওয়ার দরকার নেই। আমরা বিরোধী দল মানে যাকে বলে নির্ভেজাল বিরোধী দল, সেই ভূমিকাটাই পালন করতে চাই। জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য এটিইউ তাজ রহমান বলেন, সরকারও চাচ্ছে যে, একটা নির্ভেজাল বিরোধী দল মানে সরকারে না থেকে একটা বিরোধী দল থাকুক। অন্যদিকে এবারের নির্বাচনসহ বিভিন্ন সময় জাতীয় পার্টি তাদের সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেনি। এমনকি দলটির শীর্ষ নেতা নিজে একটা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সেই সিদ্ধান্ত বদল করেছেন। এতেও দলটির বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এমন প্রসঙ্গে জিএম কাদের বলেছেন, জাতীয় পার্টি কখনই প্রশ্নবিদ্ধ বিরোধী দল হবে না। সংসদে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা রেখেই সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করবে জাপা। এরশাদ ভাল আছেন ॥ জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ভাল আছেন, সুস্থ আছেন। সিঙ্গাপুরে তার চিকিৎসা চলছে, আশা করি তিনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। সোমবার দুপুরে এরশাদদের বনানী অফিসে উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে তিনি এরশাদের শারীরিক অবস্থার অগ্রগতির কথা জানান। এসময় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কাদের আরও বলেন, রাষ্ট্রপতি থাকাকালে, এরশাদ দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করেছিলেন। আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ে বিচার ব্যবস্থা নিয়ে গেছেন, উপজেলা পদ্ধতি প্রণয়ন, রাস্তাঘাট ও ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ করে অভূতপূর্ব উন্নয়ন করেছেন। তিনি বলেন, পরবর্তীতে দেশে যে উন্নয়ন কর্মকা- হয়েছে তার ভিত্তি তৈরি করেছিলেন এরশাদ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এরশাদের আমলেই দেশে দুর্নীতি তুলনামূলকভাবে কম ছিল। মানুষের মধ্যে শান্তি ও স্বস্তি ছিল, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন এইচএম এরশাদ। এ সময় পার্টি মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি সংসদে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। হতদরিদ্র মানুষের কথা বলেতে জাতীয় পার্টি কখনই পিছপা হবে না। গঠনমূলক সমালোচনা এবং সংসদীয় রীতিনীতি অনুসরণ করে গণমানুষের পক্ষে অবস্থান নেব আমরা। সাধারণ মানুষর পক্ষে থেকে ৮০ ভাগ জনসমর্থন অর্জন করে আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রত্যাশিত ফল অর্জনের লক্ষ্য আছে জাতীয় পার্টির। এ সময় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আজম খান, রেজাউল ইসলাম ভূইয়া, শফিউল্লাহ শফি, সুলতান মাহমুদ, এম এ রাজ্জাক খান, হাসিবুল ইসলাম জয়, গোলাম মোস্তফা, সৈয়দা পারভীন তারেক, ডাঃ সেলিমা খান, নিগার সুলতানা রানী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
×