ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুর সৈনিকের প্রস্থান

প্রকাশিত: ০৩:২৬, ২৩ জানুয়ারি ২০১৯

সুর সৈনিকের প্রস্থান

জীবনের শেষ বাক্যটি লিখেছিলেন তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দিনকয়েক আগে, ‘আমাকে যেন ভুলে না যাও, তাই একটা ছবি পোস্ট করে মুখটা মনে করিয়ে দিলাম।’ না, তাকে কেউ ভুলে যেতে পারে না, ভুলে যাবেও না। বাঙালীর হৃদয়ে-মননে সুরের আলোড়নে, যুদ্ধজয়ের স্মৃতিতে তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেনও অমলিন। তেষট্টি বছরের এক জীবনে ছিলেন অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। যেখানেই রেখেছেন হাত সেখানেই ফলেছে সোনা। হৃদয় উজাড় করে দিয়েছেন সুরের জগতে সুরেলা ভালবাসা। দেশের জন্য, জাতির জন্য, সংস্কৃতির জন্য ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তার হাত ও কণ্ঠের ছোঁয়ায় প্রাণ পেত শব্দেরা। আর সেই শব্দগুলো নড়েচড়ে উঠত তার সুরের স্পর্শ নিয়ে। ‘আমার একদিকে পৃথিবী একদিকে ভালবাসা’ বলে যখন গেয়ে উঠতেন তখন জানা হতো পৃথিবীর প্রতি তার গভীর প্রেম ও মমত্ববোধ গভীর থেকে গভীরতর। ‘জাগো বাংলাদেশ জাগো’ বলে সম্মিলিত কণ্ঠে যখন তিনি তুলতেন ধ্বনি, তখন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত কেঁপে উঠত জাগরণের ধ্বনিতে। দেশপ্রেম তাকে যেমন পনরো বছর বয়সে যুদ্ধে যেতে অনুপ্রাণিত করেছে, তেমনি দেশাত্মবোধক সঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি দেশের প্রতি, জাতির প্রতি, যুদ্ধজয়ের প্রতি তার ভালবাসা, দায়িত্ব, কর্তব্যবোধকে তুলে ধরেছেন। যখন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে উচ্চবাচ্য করা যেত না, তখন তার সুরের জাদুতে উন্মীলিত হয়েছিল কালজয়ী গান, ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না।’ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন কিশোর আহমদ ইমতিয়াজ বুলবুল। পঁচিশে মার্চ রাতের গণহত্যা দেখার পর প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন বন্ধুসহ। প্রথমে অবাঙালী তথা বিহারীদের বাসা থেকে অস্ত্র ছিনতাই করে ছোট একটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ গঠন করেন। গ্রেনেড নিয়ে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে ‘অপারেশন’ চালান। নিউ মার্কেটের এক নম্বর গেটে পাকিস্তানী বাহিনীর লরিতে আক্রমণ করেন। আজিমপুরের ওয়েস্ট এ্যান্ড হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র বুলবুল আগস্টে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ত্রিপুরার মেলাঘরে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যান। এক দফা প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসে ঢাকার লালবাগ এলাকায় কাজ শুরু করেন সহযোদ্ধাসমেত। তাদের প্লাটুনকে বলা হতো ‘ওয়াই (ইয়াং) প্লাটুন।’ অক্টোবরে আবার ভারত যাওয়ার সময় কুমিল্লা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঝামাঝি তন্তুর চেকপোস্টে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারদের হাতে বন্দী হন বুলবুলসহ চার গেরিলা যোদ্ধা। নির্মম নির্যাতন চলে তাদের ওপর। কিন্তু তাদের কাছ থেকে সামান্য তথ্যও উদ্ধার করতে পারেনি হানাদাররা। পরে তাদের উলঙ্গ অবস্থায় বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে। ক’দিন পর বুলবুলসহ চার গেরিলাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শান্তি কমিটির অফিসে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। সেই রাতেই সেখান থেকে পালিয়ে যান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির ও শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলায় সাক্ষ্য দিতে এসে একাত্তরের ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরেছিলেন। ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার পরের বছর খুন হয় তার অনুজ আহমেদ মিরাজ। দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ ভুগছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। তখন তার বুকে দুটি রিং পরানো হয়। যুদ্ধ থেকে ফেরার পর টানা দেড় দশক শুধু দেশের গান তৈরি করেছেন। তিন শতাধিক চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। দেশের সঙ্গীত অঙ্গনে অবদানের জন্য ২০১০ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। সুরের মায়া কাটিয়ে সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক, মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল চলে গেলেন মহাপ্রস্থানের পথে। কিন্তু রয়ে গেছেন বাঙালীর মনে। তার বিদেহী আত্মার প্রতি মাগফিরাত কামনা করি।
×