ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মহিলাদের ডায়াবেটিসের বিশেষ সমস্যা

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ২২ জানুয়ারি ২০১৯

মহিলাদের ডায়াবেটিসের বিশেষ সমস্যা

ডায়াবেটিসের জন্য মহিলাদের মধ্যে বিশেষ বিশেষ কিছু সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যাগুলো হলো ছোটবেলায় দেরি করে ঋতুস্রাব হওয়া বা পরে তার গ-গোল, বিয়ের পর সন্তান ধারণের সমস্যা, স্বাভাবিক যৌনজীবন যাপনের সমস্যা, পরিবার পরিকল্পনার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতির বাধা নিষেধ, স্তনের অসুখ, রজোনিবৃত্তির (গবহড়ঢ়ধঁংব) জটিলতা, শরীরের হাড় ক্ষণভঙ্গুর হয়ে যাওয়া (ঙংঃবড়ঢ়ড়ৎড়ংরং) বা সামান্য হলেও জরায়ুর ক্যানসারের আশঙ্কা। মহিলাদের প্রজনন ক্ষমতা ও বিভিন্ন সেক্স হরমোনের ওপর ইনসুলিনের সরাসরি প্রভাব আছে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে ঋতুস্রাব শুরু হওয়া, সন্তান ধারণ ও রজোনিবৃত্তি প্রভৃতি সবক্ষেত্রেই কিছু সমস্যা দেখা দেয়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে প্রায়ই ঋতু শুরু হতে দেরি হয় বা অনিয়মিত হতে থাকে। যেহেতু ওই বয়সের মেয়েরা অধিকাংশই টাইপ-১ ডায়াবেটিস, তাই ইনসুলিনের দ্বারা ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে এলে ঋতুর সমস্যাও অনেক সমাধান হয়। আবার পলিসিস্টিক ওভারি থাকলে ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা থাকে। এই রোগে ইনসুলিন প্রতিরোধের ওষুধ যেমন মেটফরমিন, গ্লিটাজোন ব্যবহার করলে ডায়াবেটিস ও ঋতুস্রাব দুইই স্বাভাবিক হতে থাকে। ঋতুজনিত সমস্যা যাদের ডায়াবেটিস অনেক দিনের জন্য আছে ও কিছু জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, তাদের বেশি হয়। শতকরা ২২ থেকে ৪৭ ভাগ মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুজনিত সমস্যা, যেমন মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে যাওয়া (অসবহড়ৎৎযড়বধ), অত্যধিক রক্ত¯্রাব হওয়া বা ঘনঘন হওয়া প্রভৃতি সবরকম সমস্যাই দেখা যেতে পারে। ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রিত না থাকে বিশেষ করে গ্লাইকোসিলেটেড হিমোগ্লোবিন ১০%-এর ওপরে থাকলে এই গ-গোল হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। সাধারণত এইসব মহিলারা খুব রোগা হন ও এল এইচ (খঐ), এফ এস এইচ (ঋঝঐ) প্রভৃতি হরমোন তাদের শরীরে কম থাকে। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস যা সব হরমোন নিঃসরণকারী গ্রন্থিদের নিয়ন্ত্রণ করে তার দোষেই এই ঋতুজনিত জটিলতা সৃষ্টি হয়। তার সঙ্গে সঙ্গে পিটুইটারি ও ডিম্বাশয় (ওভারি) গ্রন্থির বিকলতা এই সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেয়। আবার অনেক মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাবের সময় ব্লাডসুগার ও কমা বাড়া করতে দেখা যায়। ডায়াবেটিসের জন্য মহিলাদের যৌনজীবনেও কিছু কিছু সমস্যা দেখা দেয় তবে তা পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। যৌনপথের ঘনঘন ইনফেকশন, পিচ্ছিলতার অভাব প্রায়শই দেখা যায়। আর এসব বেশি সমস্যা দেখা যায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত না হলে। ডায়াবেটিসের জন্য সন্তান ধারণ ক্ষমতা অনেক সময় বিঘিœত হয়। তবে ঋতু¯্রাব অনিয়মিত হলেই এর সম্ভাবনা বেশি। পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম, যা থেকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হতে পারে, এই সমস্যা বেশি দেখা দেয়। প্রকৃত অর্থে সন্তান ধারণে (ঈড়হপবঢ়ঃরড়হ) খুব সমস্যা না হলেও সন্তান বয়স ও বৃদ্ধির (ঋবৎঃরষরঃু) ক্ষেত্রে বেশি সমস্যা হয় ও প্রায়ই গর্ভপাত (এ্যাবরশন) ঘটে যায়। তাই প্রকৃত অর্থে ডায়াবেটিস মহিলাদের গর্ভধারণ, পরিকল্পনা মাফিক হওয়া উচিত ও অন্তত তিনমাস আগে থেকে ইনসুলিন দিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে নেয়া দরকার। ডায়াবেটিস যাদের আছে, তাদের গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা নেয়া খুবই জরুরী। বারে বারে সন্তান উৎপাদনে ডায়াবেটিসের মাত্রা আরও খারাপ হতে থাকে। তাই ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে যত কম সন্তান হয় ততই ভাল। গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা যা সাধারণত ব্যবহার হয় তা সবই ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং একইরকম কাজ দেয়। তবে স্থায়ী গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা যেমন লাইগেশন অপারেশন বা পুরুষদের ভ্যাসেকটসি সবচেয়ে নিরাপদ। এছাড়া কনডোম, কপারটি প্রভৃতির ব্যবহার সমান ফলদায়ক। ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়া বা অতিরিক্ত থ্রাম্বোসিসের ভয়ে আগে গর্ভনিরোধক পিল ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ব্যবহার হতো না। কিন্তু বর্তমানে খুব কম ডোজের যে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টোজেন ট্যাবলেট পাওয়া যায় তা তুলনামূলকভাবে অনেক নিরাপদ। খুব কম দেখা গেলেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মহিলাদের অনেক সময় স্তনের সমস্যা দেখা দেয় তাকে বলে ‘ডায়াবেটিক ম্যাস্টোপ্যাথি’। এই রোগে স্তনের মধ্যে শক্ত, বেদনাহীন একটা টিউমারের মতো বস্তু তৈরি হয়। অনেক সময় একে ক্যানসারের সঙ্গে ভুল করা হয়। কিন্তু আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ও বায়োপসি দ্বারা সঠিক রোগ নির্ধারণ সম্ভব ও এর থেকে কোন খারাপ অসুখ তৈরি হয় না। এই সমস্যা বেশি দেখা যায় টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে এবং প্রায় ১৩-১৮ বছর ডায়াবেটিস থাকার পর। শুধু ডায়াবেটিসের জন্য মহিলাদের রজোনিবৃত্তি (গবহড়ঢ়ধঁংব) বা ঋতুবন্ধ হয়ে যাওয়ার সাধারণত কোন সমস্যা হয় না। তবে কারও কারুও ক্ষেত্রে দেখা গেছে এটা বয়সের তুলনায় অনেক আগেই হতে পারে। ডায়াবেটিসের সঙ্গে অন্য কারণে ডিম্বাশয়ের কার্যক্ষমতা (ঙাধৎরধহ ঋধরষঁৎব) হ্রাস পেলে অকালে মেনোপজ হতে পারে। ডায়াবেটিসের মহিলাদের মেনোপজের যে সমস্যা যেমন গা হাত-পা জ্বলা, খিটখিটে ভাব, অনিদ্রা এসব যে বেশি হয় বলা যায় না। তবে এই বয়সে মেনোপজের জন্য যে মানসিক বিষাদ সৃষ্টি হয় তা ডায়াবেটিস থাকলে প্রায় দ্বিগুণভাবে দেখা দেয়। এই সমস্যা ভেবে এই বয়সে যে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করা হয় তা ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে খুব সাবধানে করা উচিত। অস্টিও পোরোসিস (ঙংঃবড়ঢ়ড়ৎড়ংরং) বা হাড় পাতলা ও কম জোর হয়ে যাওয়া বয়স্ক মহিলাদের একটি বিশেষ সমস্যা। ডায়াবেটিস রোগ এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এই সমস্যায় ঘন ঘন হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই সমস্যা বেশি দেখা যায় টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে। এছাড়া হাইপোগ্লাইসেমিয়া, ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি (কিডনির অসুখ) ও ডায়াবেটিক ডায়রিয়া এই সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেয়। আর চোখের সমস্যা যেমন রেটিনার অসুখ বা ছানি এবং নার্ভ বা জয়েন্টের অসুখ থাকলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। এই সমস্যা এড়িয়ে চলতে গেলে ডায়াবেটিসের কঠোর নিয়ন্ত্রণ দরকার। এছাড়া দরকার মতো ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। কোলেস্টেরল কমানোর স্ট্যাটিন জাতীয় ওষুধ এই রোগে সাহায্য করে। বহুদিন ধরে ডায়াবেটিস থাকলে বা সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী জটিলতাগুলো থাকলে, অস্টিওপোরোসিসের কথা মহিলাদের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে ভাবতে হবে। এছাড়া ঘন ঘন পড়ে যাওয়া এড়িয়ে চলতে লাঠি বা ওয়াকার, পর্যাপ্ত আলো, ধরে ফেলার জন্য দেওয়ালের হাতল প্রভৃতির ব্যবস্থা থাকা দরকার । জরায়ুর ক্যানসার (ঊহফড়সবঃৎরধষ ঈধহপবৎ) ডায়াবেটিস মহিলাদের মধ্যে আনুপাতিকভাবে প্রায় দ্বিগুণ। তবে এর সংখ্যা আমাদের দেশে খুব বেশি নয়। তবে এই সব মহিলাদের ডায়াবেটিসের সঙ্গে স্থূলকায়তা, উচ্চরক্তচাপ ও অলস স্বভাব প্রায়শই যুক্ত থাকে। তাই এর জন্য কতটা ডায়াবেটিস পৃথকভাবে দায়ী তা বলা সহজ নয়। গর্ভনিরোধক হরমোন পিলের ব্যবহারও কিছুটা দায়ী হতে পারে। ডায়াবেটিস মহিলাদের ক্ষেত্রে কিছু আলাদা সমস্যার সৃষ্টি করে তা বেশির ভাগই জনন ক্ষমতা ও রজোনিবৃত্তি সম্পর্কিত। সুষ্ঠু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ অনেক সমস্যারই সমাধান করে। আর গর্ভাবস্থায় সঠিক ডায়াবেটিস চিকিৎসা শুধু মহিলার ভবিষ্যত স্বাস্থ্য নির্ধারণ করে না, আগত শিশু বা ভবিষ্যতের সমাজের গঠনও নির্ধারণ করে। ডাঃ শাহজাদা সেলিম এমবিবিএস, এমডি (এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম), এমএসিই (ইউএসএ) সহকারী অধ্যাপক এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
×