ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এ্যাজমা থাকুক নিয়ন্ত্রণে

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ২২ জানুয়ারি ২০১৯

এ্যাজমা থাকুক নিয়ন্ত্রণে

এ্যাজমা বা হাঁপানি হলো শ্বাসনালির প্রদাহজনিত দীর্ঘমেয়াদি একটি রোগ। এই প্রদাহের ফলে শ্বাসনালি ফুলে যায় এবং অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। এতে হাঁপানির বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন- কাশি, শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ চাপ অনুভব করা, দম নিতে কষ্ট হওয়া এবং বাঁশির মতো শোঁ শোঁ আওয়াজ হওয়া ইত্যাদি। এ অবস্থায় শ্বাসনালিতে যদি ধুলা, ঠা-া বা গরম বাতাস প্রবেশ করে তাহলে রোগের মাত্রা বেড়ে যায়। তাই শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে এর প্রকোপ। তবে সঠিক ও নিয়মিত চিকিৎসার ফলে এ উপসর্গগুলো নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব। পরিসংখ্যান বলছে, সারা বিশ্বে ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ এ্যাজমা বা হাঁপানিতে আক্রান্ত। বাংলাদেশে এর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখের মতো। প্রতি বছর এদেশে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশকে চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। হাঁপানি কখন বা কেন হয় হাঁপানি যে কোন বয়সেই হতে পারে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এ রোগ বেশি দেখা যায়। দেখা গেছে, কারও কারও বংশগত কারণে বা পরিবেশগত কারণেও এ রোগ হতে পারে। এ ছাড়া ধুলোবালির মধ্যে থাকা মাইট নামের ক্ষুদ্র কীট, ফুলের পরাগরেণু থেকে; পশুপাখির পালক, ছত্রাক, মল্ট, ইস্ট, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে যারা থাকে তাদের এ রোগ হতে পারে। এ ছাড়া মানসিক চাপে থাকলে হাঁপানির তীব্রতা বেড়ে যেতে পারে। কারও কারও বিভিন্ন সুগন্ধি, মশার কয়েল বা কারও কারও কীটনাশকের গন্ধ থেকেও শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতে পারে। রোগ নির্ণয় হাঁপানির উপসর্গগুলো সাধারণত রাতে বা খুব সকালে বেশি হয় এবং শ্বাসনালীতে কোন ধরনের এ্যালজেন প্রবেশ করলে বা তাপমাত্রা পরিবর্তিত হলে এ উপসর্গের তীব্রতা বেড়ে যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে কাশি বা শ্বাসকষ্ট, বুকে বাঁশির মতো শোঁ শোঁ শব্দ শুরুর আগে নাক বা বুক চুলকায়, হাঁচি হয়, নাক দিয়ে পানি পড়ে, চোখ লাল হয়ে যায়। ওপরের উপসর্গগুলোর সঙ্গে বংশে কারও যদি হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস থাকে, তাহলে ধরে নেওয়া যায় তার হাঁপানি রয়েছে। রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায় হাঁপানি সম্পূর্ণ ভাল করার জন্য এখনও কোনও ওষুধ বের হয়নি। তবে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। হাঁপানি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগী পুরো সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। হাঁপানি নিয়ন্ত্রণের একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো সতর্কভাবে খেয়াল রাখা, কোন কোন কারণে রোগীর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায় তা নির্ণয় করা এবং তা থেকে দূরে থাকা। কারণ সব হাঁপানি রোগীর রোগের উপসর্গ কমা বা বাড়ার জন্য একই উত্তেজক দায়ী নয়। অনেক সময় পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপরও আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। হাঁপানির ওষুধ সঠিকভাবে ব্যবহার করলে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব। রোগ নিয়ন্ত্রণে ওষুধ হাঁপানির চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ব্যবহৃত হয়, যেমনÑ রোগ উপশমকারী ওষুধ, রোগ প্রতিরোধ বা বাধাদানকারী ওষুধ। এ ওষুধগুলো সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবেÑ কীভাবে কাজ করে, এগুলোর সঠিক মাত্রা কী, এগুলোর সাধারণত কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং কোন কোন ওষুধ ব্যবহার করা যাবে। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় এ্যাজমা রোগীদের মুখে খাবার ওষুধের চেয়ে ইনহেলার বেশি ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। কারণ এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে, কম পরিমাণ ওষুধ লাগে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এটা সঠিক নিয়মে ব্যবহার করলে খুব দ্রুত শ্বাসকষ্টের পরিমাণ কমে যায়। ইনহেলার এ্যাজমা রোগীর এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যা কিনা রোগী শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে টেনে নেয় এবং ওষুধ শ্বাসনালিতে পৌঁছায়। ইনহেলার সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা হাঁপানির ওষুধ সাধারণত ইনহেলারের মধ্য দিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিষেধক বা আরোগ্য-সহায়ক হিসেবে ইনহেলার ব্যবহৃত হয়। হাঁপানির ক্ষেত্রে প্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে ওষুধ গ্রহণ যথেষ্ট কার্যকরী, যেহেতু এটি সরাসরি ফুসফুসে গিয়ে পৌঁছোয় ও খুব সামান্যই শরীরের অন্যত্র গিয়ে মেশে। হাঁপানি রোগীদের অনেকেই মনে করেন, ইনহেলার হাঁপানির সর্বশেষ চিকিৎসা। ইনহেলার একবার ব্যবহার করলে পরে শ্বাসকষ্টের পরিমাণ কমানোর জন্য আর অন্য কোনো ওষুধ কাজে আসবে না। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। জেনে রাখা ভাল, হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের প্রথম চিকিৎসা হচ্ছে ইনহেলার। ইনহেলার শ্বাসকষ্ট লাগবে খুব দ্রুত কাজ করে, যেখানে সেবনযোগ্য ট্যাবলেট বা বড়ি খেলে ২০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা সময় লাগে। অ্যাজমা রোগের জন্য নানা ধরনের ইনহেলার আছে। চিকিৎসকের নিয়মিত পরামর্শে সেগুলো গ্রহণ করা উচিত। এছাড়া এ্যাজমা রোগ যেহেতু নিত্যদিনের সঙ্গী, তাই আপনাকে এর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। যারা ইনহেলার ব্যবহার করেন, তারা সার্বক্ষণিক তা সাথে রাখবেন। শ্বাসকষ্ট হলে ইনহেলার ব্যবহার করবেন। আর এ্যাজমার এ্যাটাক ইনহেলারে প্রশমিত না হলে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে। যা করণীয়, যা করণীয় নয় চিকিৎসার প্রথম ধাপ হলো নিয়মিত চেক-আপ করানো। নিয়ম মেনে ওষুধ সেবন করা। যে জিনিসের প্রভাবে হাঁপানি প্রকট হয় সেগুলো এড়িয়ে চলা। ওষুধ বা ইনহেলার হাতের কাছে রাখা। এ্যাজমার আক্রমণ থেকে বাঁচতে যথাযথ চিকিৎসা জরুরী। সঠিক নিয়মে চিকিৎসা চালিয়ে গেলে এ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব। নিয়মিত সঠিক ওষুধ ব্যবহার ছাড়াও হাঁপানির উত্তেজক থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। রোগীকে জানতে হবে, তার জন্য নির্দিষ্ট কোন উত্তেজক আছে কি না। এ ছাড়া সাধারণ উত্তেজককে অবশ্যই পরিহার করতে হবে, যেমনÑ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপান থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা। বাসায় কার্পেট, যা রাখা বিশেষ করে শোয়ার ঘরে। বাসার মধ্যে কোন পোষা জীব, যেমনÑ কুকুর, বিড়াল, পাখি না রাখা। বাসায় কোন কীটনাশক স্প্রে ব্যবহার না করা, কখনোই ভেকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার না করা। দেখা গেছে, এ্যাজমা সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা পাওয়ার পর ৭৫ শতাংশ রোগীই হঠাৎ এ্যাজমার আক্রমণ থেকে বেঁচে যায় এবং ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না। এ্যাজমার আক্রমণ থেকে বাঁচার উপায় ধুলাবালি এড়িয়ে চলতে হবে। বাসায় এমন পশু-পাখি না রাখা যেগুলো থেকে এ্যালার্জির প্রকোপ বাড়তে পারে। ধূমপান ছাড়ুন, ধূমপায়ীর আশপাশে থাকবেন না। বাইরে গেলে মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। ঠা-া পরিহার করতে হবে। কিছু ব্যায়াম আছে যা এ্যাজমা বাড়ায়। সেগুলো থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। এলার্জি জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না। পশমি জামা কাপড়, কম্বল ব্যবহার করা যাবে না। কড়া গন্ধের প্রসাধনী এড়িয়ে চলুন। সপ্তাহে একবার বিছানার চাদর, বালিশের কাভার বদলান। শীতে বাইরে বেরনোর সময় পর্যাপ্ত গরম কাপড় ব্যবহার করুন। নিয়মিত ইনহেলার নিতে হবে। নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। অরিতিক্ত ওজন কমাতে হবে। রোগ নিয়ন্ত্রণে রোগীর ভূমিকা হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে রোগীর নিজের ভূমিকা অনেক। রোগীকে জানতে হবে, তার রোগটির প্রকৃতি কী, এর চিকিৎসা কী, তিনি ইনহেলার ব্যবহার করবেন কি না, ইনহেলারের কাজ কী প্রভৃতি। গুরুত্বপূর্ণ হলো সঠিকভাবে ইনহেলার ব্যবহার করতে জানা। রোগীকে জানতে হবে কী চিকিৎসা তার প্রয়োজন, তার হাঁপানির উপসর্গ কখন বাড়ে, কখন ইনহেলার ব্যবহার করবে, কখন রোগটি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং কখন রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। যেহেতু হাঁপানি একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ, তাই এ রোগের ওষুধগুলো দীর্ঘমেয়াদী অবিরামভাবে ব্যবহার করতে হয়। কখনোই উপসর্গ কমে গেলে বা না থাকলে ওষুধ হঠাৎ বন্ধ করা কোনভাবেই উচিত নয়। মনে রাখতে হবে, এ্যাজমায় চিকিৎসা কদাচিৎই স্বল্পমেয়াদী হয়। এর মানে এও নয় যে একজন হাঁপানি রোগী সারাজীবনই এর জন্য ওষুধ নেবে। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন এ্যাজমা রোগী যদি নিয়মিতভাবে হাঁপানি প্রতিরোধক ওষুধ নিয়মিত তিন থেকে পাঁচ বছর ব্যবহার করে, তাহলে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে এ রোগ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ওষুধের মাত্রা সাধারণত উপসর্গের তীব্রতা অনুযায়ী নির্ণয় হয়ে থাকে, অর্থাৎ রোগের উপসর্গ কমে গেলে ধীরে ধীরে ওষুধের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হয়। কখনোই হঠাৎ করে কমানো উচিত নয়। আর এটি কেবল চিকিৎসকের পরামর্শেই সম্ভব। লেখক : বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান রেসপেরেটরি মেডিসিন বিভাগ বারডেম জেনারেল হাসপাতাল ও ইব্রাহিম মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯১১৪৬৩৮৮৮
×