ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দাম না পাওয়ায় অনেক কৃষক ক্ষেত থেকে আলু তুলছে না

আলুর দাম তলানিতে

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ২২ জানুয়ারি ২০১৯

আলুর দাম তলানিতে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বগুড়ায় বেড়েছে আলু চাষের জমির পরিধি। পাইকারী বাজারে নেই ক্রেতাদের আনাগোনা। আলুর দামও তলানিতে এসে ঠেকেছে। দাম না মেলায় অনেক কৃষক ক্ষেত থেকেই আলু তুলছেন না। গত বৃহস্পতিবার খোলাবাজারে পাকড়ি (লাল) আলুর দাম কেজিপ্রতি ১৫-১৬ টাকায় নেমে আসে। হাটে সেই আলু আরও কমে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে। আর সাদা হলেন্ডার স্টিক বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ ৪৫০ টাকা। আর গ্রানোলা জাতের আলুর দাম ছিল প্রতি মণ মাত্র ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। সেই হিসেবে এই আলুর দাম পড়েছে মাত্র ৭ টাকা ৫০ পয়সা কেজি। হাটের চিত্রের চেয়ে মাঠের চিত্র আরও খারাপ। মাঠের কৃষক আলুর দাম পাচ্ছে সর্বোচ্চ ১০ টাকা কেজি। এবার ফলন ভাল হওয়ার সুবাদে হাটে আলুর স্তুপ। কিন্তু একে তো দাম কম, তার ওপর ক্রেতার অভাবে ওই আলু বিক্রি করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় অনেক কৃষক ক্ষেত থেকেই আলু তুলছেন না। সপ্তাহ জুড়ে ঘুরে মিলেছে মাঠের এ চিত্র। বগুড়ায় মোট সবজি আবাদের ৫০ শতাংশ এলাকা এখন আলুর দখলে। বগুড়ার চ-ীহারার কৃষক আব্দুল মানিক, মোকামতলা বাজার এলাকার সবুর সওদাগর, নয়মাইল বাজারের মিনহাজ উদ্দিন ও শেরপুরের আকবর মিয়া জানান, বাজার পরিস্থিতি দেখে ক্ষেত থেকে আলু তোলা বন্ধ রেখেছি। এখন আলু তুললে লসে বিক্রি করতে হবে। আবার দেরিতে তুললে পরবর্তী ফসল চাষ বিঘিœত হবে। যে কারণে আমরা পড়েছি উভয় সঙ্কটে। এদিকে এখনও বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলে অব্যাহত শৈত্যপ্রবাহ রয়েছে। কমছে না ঘন কুশায়াও। আবহাওয়া ক্রমেই চলে যাচ্ছে আলু চাষীদের প্রতিকূলে। জমিতে ছড়িয়ে পড়ছে রোগবালাই। অথচ এখন মাঠে পড়ে রয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ আলু। কৃষি বিশেষজ্ঞ বজলুর রশিদ বলেন, গাছ শুকিয়ে যাওয়ার পর আলু না তুললেও অন্তত ১৫ দিন মাটিতে আলু ভাল থাকবে। ওই কয়েক দিনে বাজার কিছুটা চাঙা হতে পারে। বগুড়ার পাইকারি আলুর বাজার কতদিন এমন মন্দা থাকবে তা নিয়ে কৃষি ও কৃষি বিপণন দফতরের কর্মকর্তারা স্পষ্ট কিছু জানাতে পারেননি। কৃষকরা জানান, এ সময়ে মূলত পাকড়ি (লাল) প্রজাতির আলুর ফলন হয়। বৃহস্পতিবার মহাস্থান হাটে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা মণ দরে ওই আলু বিক্রি হয়েছে। সাদা হলেন্ডার স্টিক বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ ৪৫০ টাকা। আর গ্রানোলা জাতের আলুর দাম ছিল প্রতিমণ মাত্র ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। সেই হিসেবে এই আলুর কেজি হাটে পড়ে মাত্র ৭ টাকা ৫০ পয়সা কেজি। যদিও এক কেজি পাকড়ি প্রজাতির আলুর উৎপাদন খরচ প্রায় ১০ টাকা। সঙ্গে আন্যান্য খরচ আরও ২ টাকা যোগ হবে। হাটের এই দামও যদি কৃষক পেত তাহলে লাভ হবার কথা। কিন্তু জমিতে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা মণের বেশি দাম পাওয়া দুষ্কর। বগুড়া, শিবগঞ্জ, মোকামতলা, শেরপুর, শাজাহানপুর ও কাহালু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চারদিকে শুধু আলু আর আলু। তারপরও আলু চাষিরা হতাশ। তাদের চেহারায় শঙ্কার ছাপ। ভরা মৌসুমে বাজারে আলুর দাম নেই। খুচরা বাজারে যে আলুর কেজি ১৮ টাকা, সেই আলু ক্ষেতে বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ টাকা দরে। এর পরও হাটে ক্রেতা নেই। বোরো ধান লাগানোর আগে আলু চাষ করেছিলেন এ অঞ্চলের ৯৯ শতাংশ কৃষক। আশাতীত ফলনের পর এখন উৎপাদন খরচ ওঠা নিয়েই শঙ্কিত তারা। মাটির গুণগতমানের কারণে উত্তরের অন্যান্য জেলার চেয়ে বগুড়ায় আলুর ফলন বেশি হয়। পুরো উত্তরাঞ্চল মিলে আলুর যা ফলন হয়, তার প্রায় দ্বিগুণ হয় বগুড়ায়। এ তথ্য কৃষি বিভাগের। পাশের জয়পুরহাটেও আলুর ফলন ভাল হয়। এ কারণে এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অনেক হিমাগার। বগুড়া থেকে আলু কিনে দেশের বিভিন্নস্থানে নিয়ে যান পাইকাররা। অনেকে আলু কিনে পাশেই হিমাগারে সংরক্ষণ করেন পরবর্তী সময় বেশি দামে বিক্রির জন্য। মৌসুমী ব্যবসায়ীরাও আলু কিনে মজুদ করেন এসব হিমাগারে। বগুড়ার মোকামতলা এলাকায় কৃষক আব্দুর রহমান প্রতিবছর জমিতে আলু চাষ করেন। তার মতে, গতবছর বাজার ভাল ছিল। তাই এবার আলু চাষীর সংখ্যা ও জমির পরিমাণ বেড়ে যায়। কিন্তু এবার শুরু থেকেই আলুর বাজার ঝুলে গেছে। এ কারণে এখন তাদের মাথায় হাত। তিনি জানান, এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করতে ১৫-১৬ হাজার টাকা খরচ হয়। সব মিলিয়ে প্রতি কেজি আলুর দাম পড়েছে প্রায় ১০ টাকা। সেই আলু এখন বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে বিনা লাভে। এখন ইচ্ছা করলেই হিমাগারে আলু রাখারও উপায় নেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, এবার উত্তরের ১৬ জেলায় তিন লাখ ৩৪ হাজার ৩৩ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩২ লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে শুধু বগুড়ায় ৬০ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ লাখ ৫৭ হাজার ১৯ মেট্রিক টন। কিন্তু এ পরিমাণের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ আলু বেশি উৎপাদন হয়েছে। এত আলু আগে কখনও উৎপাদন হয়নি। উত্তরের ১৬ জেলায় হিমাগারের সংখ্যা দেড় শতাধিক। এসবের ধারণক্ষমতা ১০ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭০ মেট্রিক টন। বাজারে দাম কম হওয়ায় হিমাগারের ধারণ ক্ষমতার পুরোটাই মজুদ করা হচ্ছে এবার। বগুড়ার মহাস্থান হাট ঘুরে দেখা গেল, সেখানে আলু কিনতে ব্যাপারীদের টানাহেঁচড়া নেই। হাটে আসা মনির উদ্দিন নামে একজন জানান, আলু নিয়ে সারাদিন বসে থেকেও ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছেন না। এখন হাটে-মাঠে কোথাও কাক্সিক্ষত আলুর দাম নেই। বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক নিখিল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, বগুড়ায় গতবছরের তুলনায় প্রায় চার হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আলু চাষ হয়েছে। কিন্তু শুরুতেই কৃষকরা বীজ সঙ্কট ও সারের উচ্চ মূল্যের কারণে ধাক্কা খায়। এ সমস্যা কাটিয়ে জমিতে আলুগাছ যখন বাড়তে শুরু করে, তখনই নেমে আসে হাড় কাঁপানো শীত আর ঘনকুয়াশা। তাপমাত্রা এখন ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে ওঠানামা করছে। সব বাধা অতিক্রম করে ভাল ফলন হয়েছে। এখন বাজার স্থিতিশীল হওয়ার অপেক্ষা।
×